রেলওয়ের দুর্দশা ও মন্ত্রীর গলাবাজি by মইনুল ইসলাম

২২ মে চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে মহানগর গোধূলী ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার সময় যে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হলো, সেটাই আমাকে রেলওয়ের বর্তমান দুর্দশা সম্পর্কে লিখতে বাধ্য করল। আমি ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি অনার্স কোর্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটের ট্রেনগুলোর নিয়মিত যাত্রী ছিলাম। তাই গত ৪৮ বছরের ট্রেন ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এবং একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে এই লেখাটা লিখছি। মহানগর গোধূলী ট্রেনটি কিছুদিন আগেও দেশের খানদানি কয়েকটি আন্তনগর ট্রেনের মর্যাদা পেত। কিন্তু বর্তমান রেলমন্ত্রীর অপরিণামদর্শী ও খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে ট্রেনটি এখন ‘লোকাল ট্রেনে’ পরিণত হয়েছে। এখন ট্রেনটি অতিরিক্ত চারটি স্টেশনে থামছে। তার চেয়েও অসহনীয় হলো, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কম্পার্টমেন্টগুলোর প্রতিটিতেই ফেনী স্টেশনের পর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত ৪০-৫০ জন যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকায় সবার দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হচ্ছে। এসব দাঁড়ানো যাত্রী বৈধ যাত্রী কি না, সে বিষয়েও সদুত্তর মেলেনি। (যাত্রা শুরুর ১০ মিনিট পর এক ঘণ্টারও বেশি সময় শীতাতপনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বিকল হয়ে থাকায় এসব কম্পার্টমেন্টের যাত্রীদের চট্টগ্রাম থেকে চিনকি আস্তানা স্টেশন পর্যন্ত নরক–যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছিল। ট্রেনটির জেনারেটর নাকি প্রায়ই বিকল হয়ে যাচ্ছে।) এহেন বিপুল যাত্রীবাহী ট্রেনটি রাত নয়টার স্থলে রাত সাড়ে বারোটায় ঢাকা বিমানবন্দর স্টেশনে পৌঁছানোর পর এই কষ্টকর অভিজ্ঞতার সমাপ্তি ঘটে। পরদিন ফিরতি যাত্রার সময় সুবর্ণ এক্সপ্রেস ঢাকা থেকে বেলা তিনটায় ছেড়ে এসে চট্টগ্রামে পৌঁছাতেও রাত পৌনে এগারোটা বেজে গিয়েছিল। মানে, সুবর্ণ এক্সপ্রেস পৌনে আট ঘণ্টা সময় নিয়েছে এবং আগের দিন মহানগর গোধূলী সাড়ে নয় ঘণ্টায় যাত্রা সম্পন্ন করেছে। ট্রেনে কর্মরত রেলওয়ে কর্মচারীরা জানালেন, এটাই নাকি অহরহ ঘটছে। অথচ বহুকাল আগের ট্রেন ‘উল্কায়’ পাঁচ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছে যেতাম আমরা। মহানগর প্রভাতি এবং গোধূলি ট্রেনগুলোও চালু হওয়ার পর বেশ কিছুদিন সাড়ে পাঁচ ঘণ্টায় গন্তব্যে পৌঁছাত।
তাহলে আমরা রেলওয়ের যে অগ্রযাত্রার কাহিনি শুনতে পাচ্ছি, সেটা কি শুধুই গলাবাজি? ২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চের বিএনপি-জামায়াতের নাশকতামূলক তাণ্ডবের জের কি এখনো চলছে রেলওয়েতে? নাকি রেলমন্ত্রীর অদক্ষতা ও নেতৃত্বের দুর্বলতা রেলের দুর্দশাকে আরও শোচনীয় করে তুলছে? সৈয়দ আবুল হোসেনের অযোগ্যতা ও খামখেয়ালিপনা ২০০৯-১২ পর্বে শেখ হাসিনার সরকারকে যে মহাবিপদে ফেলে দিয়েছিল, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। মন্ত্রিত্ব কারও আবদার মেটানোর জন্য বা কাউকে কৃপা বিতরণের জন্য প্রদত্ত হলে পুরো জাতিই বিপদে পড়ে যায়।
রেল মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী শুরু থেকেই ইমেজ–সংকটে পড়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, তিনি দৃঢ়ভাবে রেল মন্ত্রণালয়ের হাল ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। অথচ শেখ হাসিনা রেলওয়েকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার প্রদানের ঘোষণা দিয়ে চলেছেন!
অতীতেও বেশ কয়েকবার লিখেছি যে এ দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে রেলওয়ে ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে যোগাযোগকে অবহেলা করে সড়কযোগাযোগকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদানের নীতি মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। রেলওয়ে ও নৌ-যোগাযোগের মতো পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থার পরিবর্তে আমাদের নীতি প্রণেতারা এখনো কেন সড়কযোগাযোগকে অগ্রাধিকার দিয়ে চলেছেন তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক একটা দেশে নৌ-যোগাযোগ যে এখনো অবহেলিত ও অনুন্নত রয়ে গেছে, সেটা একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমি কোনোমতে মানতে পারি না। অনেকেই হয়তো জানে না যে যত্রতত্র অপরিকল্পিত সড়ক নির্মাণের কারণেই সারা দেশের নগর ও গ্রামগুলোতে পানি নিষ্কাশন বিপর্যস্ত হয়ে জলাবদ্ধতা তীব্র হয়ে উঠছে এবং নদ-নদী ও খাল-নালাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এটাও হয়তো অনেকের অজানা যে প্রতি বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্যের হিসাবে বাংলাদেশে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সড়কপথ রয়েছে (বেশির ভাগই অবশ্য কাঁচা রাস্তা)। এটা আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার প্রতিফলন। যে দেশের ওপর দিয়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা রিভার সিস্টেমের মতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ পানি নিষ্কাশনব্যবস্থার ২৩০টি বড় নদ-নদী এবং সাত শতাধিক খালের নেটওয়ার্ক প্রবাহিত, সে দেশে সড়কযোগাযোগকে অগ্রাধিকার প্রদানের নীতি যে কত বড় আহাম্মকি, তা নীতি প্রণেতারা এখনো উপলব্ধি করতে পারছেন না! নদ-নদী-খালের এই নেটওয়ার্ক আমাদের জন্য আল্লাহ তাআলার নেয়ামত, কিন্তু আমাদেরই ভুলে ওগুলোকে ভরাট করে ফেলে নানা রকম পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছি। ওগুলোর নাব্যতা বজায় রাখতে পারলে বন্যার সঙ্গে আমাদের সহাবস্থান যেমন অর্জিত হবে, তেমনি নৌপরিবহনের আধুনিক ও স্বল্পব্যয়ী নেটওয়ার্কও সহজলভ্য হবে।
এর পরের অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত রেলযোগাযোগ। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমলে এ দেশের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল প্রধানত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা-বাগানগুলোর উৎপাদিত চা রপ্তানি সহজ করার স্বার্থে। সে জন্য ২১৩ মাইল দীর্ঘ চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথটি আখাউড়া পর্যন্ত গিয়ে ৬৩ মাইল ঘুরপথ দিয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। আবার দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেলপথ ঢাকায় না এসে কলকাতায় চলে গেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের ৬৮ বছর পার হয়ে গেলেও কোনো সরকার ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ৬৮ মাইল ঘুরপথ বাদ দিয়ে লাকসাম বা কুমিল্লা থেকে দাউদকান্দি ও নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা পর্যন্ত রেলপথকে মাত্র ১৫০ মাইলে নামিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি আজও শুরু করতে পারেনি। অথচ লাকসাম-ঢাকা কর্ডলাইন নামে খ্যাত একটি প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি সম্পন্ন হয়ে রয়েছে প্রায় ৩৫ বছর আগে। কিছুদিন আগে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক কুমিল্লা-ঢাকা রেলপথ নির্মাণ কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে বলে ঘোষণা করেছেন। আশা করি, অতীতের মতো এবার আর ফাঁকা বুলি আওড়াননি মন্ত্রী মহোদয়। এই প্রকল্প সম্পন্ন হলে দেশের রেল–যোগাযোগব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হবে। (লাকসাম-আখাউড়া ডাবল লাইন প্রকল্প তখন আর গুরুত্বপূর্ণ থাকবে না।) নির্মাণাধীন পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের রেল–যোগাযোগব্যবস্থায় নতুন যুগের সূচনা হবে। ঢাকা নগরের মেট্রোরেল পাতাল রেলপথের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হলে এ দুটি রেল নেটওয়ার্ক একটা আধুনিক যুগে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে। একটা ব্যাপার খুবই দুঃখজনক যে ২০০৮ সালের পর চট্টগ্রাম-ঢাকা রেলপথে নতুন কোনো যাত্রী বগি সংযুক্ত হয়নি। শোনা যাচ্ছে, এবারের ঈদুল ফিতরের আগেই দেশে প্রায় ৩০০ নতুন বগি আমদানি করা হবে। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব নতুন ট্রেন চালু করার অঙ্গীকার কবে বাস্তবায়িত হয় সে জন্য। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথটি ডুয়াল গেজ কেন করা হলো না, সে প্রশ্নটিও এ পর্যায়ে সামনে চলে আসা উচিত। রেলওয়ের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এখন এতখানি অগ্রসর হয়েছে যে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে শুধু মিটারগেজ ট্রেন চালাতে হবে এমন ধারণা অচল হয়ে গেছে। ব্রডগেজ ট্রেন এখন চট্টগ্রাম ও সিলেটে যেতে পারবে। সারা দেশকে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বিদ্যুৎ–সুবিধার আওতায় নিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে দেশে বৈদ্যুতিক ট্রেন চালু করার ব্যাপারটিও আমাদের চিন্তায় রাখা উচিত।
রেলযোগাযোগ ও নৌ–যোগাযোগব্যবস্থা শুধু যে পরিবেশবান্ধব তা নয়, এগুলোকে দরিদ্রবান্ধব পরিবহনব্যবস্থাও বলা হয়। যাত্রীদের নিরাপত্তার বিচারেও সড়ক পরিবহনের চেয়ে রেলপথ উত্তম। আমাদের প্রতিবেশী ভারতের ট্রেনগুলোতে ভ্রমণের সুযোগ যাঁদের হয়েছে, তাঁরা ঠিকই উপলব্ধি করবেন, তারা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্কটিকে কতখানি সহজলভ্য ও আরামদায়ক করে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ভারতে গেলে আফসোসের অন্ত থাকে না আমাদের দেশের রেলওয়ের দুর্দশা দেখে। ব্রিটেনের মানুষ পারতপক্ষে সড়কপথে ভ্রমণ করে না, তাদের রেলযোগাযোগের স্বল্প ব্যয় ও আরামপ্রদ ব্যবস্থার কারণে। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের এই অবদানটিকে প্রশংসনীয় মনে করেছেন ঐতিহাসিকেরা।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে পাকিস্তান আমলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিরা নব্য ঔপনিবেশিক শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের রেলব্যবস্থা বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে এসেও এই বিপর্যয় কাটাতে যথাসম্ভব প্রয়াস নিতে আমরা গাফিলতি করছি কেন? মাননীয় অর্থমন্ত্রী এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী একাধিকবার বলেছেন, বর্তমান সরকার নতুন কোনো সড়ক নির্মাণকে আর অগ্রাধিকার দেবে না। এটা যদি সরকারের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে সরকারকে সাধুবাদ জানাই। এবার অনুগ্রহ করে রেলওয়ে ও নৌপরিবহনের উন্নয়নের দিকে নজর দেওয়া হোক। বিশেষত রেলওয়ে ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ তুলনামূলকভাবে সহজসাধ্য। তাই এবারের উন্নয়ন বাজেটে ‘থ্রাস্ট সেক্টর’ হিসেবে রেলওয়েকে বেছে নিন। প্রয়োজনে এই মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গতিশীলতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করুন। ট্রেনে ভ্রমণ এখনো দেশের অধিকাংশ মানুষের বেশি পছন্দনীয়। কিন্তু ট্রেনের টিকিট নিয়ে কালোবাজারিদের যে মচ্ছব, তা বহু দিন আগেই অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ফলে বাধ্য হয়ে এখন সড়কপথে যাতায়াত করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। (আমি নীতিগতভাবে কালোবাজারিদের কাছ থেকে টিকিট কিনি না।) এবার বহু দিন পর ট্রেনের টিকিট পেয়েছিলাম। কিন্তু যে যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হলো, তার আশু অবসান চাই। রেলমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, সেই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীরও।
ড. মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.