সিলেটে ব্লগার অনন্ত খুন

বাঁচাও বাঁচাও বলে সামনে দৌড়াচ্ছিলেন সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ। পেছন থেকে চার যুবক হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছিল। নুরানী দীঘির কোনায় এসে শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি। লুটে পড়েন মাটিতে। এ সময় ঘাতকরা তার মাথায় আরও কোপ দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে।’ সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা এভাবেই দেন ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা। তারা বলেন, খুনিদের ভয়ঙ্কর মূর্তি ও নির্মমতার কাণ্ড দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা হতভম্ব হয়ে পড়েছিলেন। এ সময় অনেকেই অনন্ত বিজয়ের মতো ভয়ে দৌড়াতে থাকেন। তখনও সিলেট নগরীর বন কলাপাড়া নুরানী দীঘি এলাকার দোকানপাট খোলা হয়নি। বাসাবাড়িতেও অনেকটা নিস্তব্ধ পরিবেশ। রাস্তা ফাঁকা। নুরানী দীঘির পাশের দোকানি আবদুস সুবহান সবেমাত্র দোকান খুলেছেন। চিৎকার শুনে তিনি দোকানের বাইরে বের হন। তার চোখের সামনেই ঘটেছে এমন লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড। ঘটনার পাশবিকতায় তিনিও কিছুটা ভড়কে যান। তার ওপর হামলার আশঙ্কায় তিনিও দোকানের আড়ালে অবস্থান নেন। খুনিরা চলে যাওয়ার পর বাইরে বের হন। বলেন, ‘ওরা নির্মমভাবে অনন্তকে কুপিয়ে খুন করেছে। এরপর অনন্ত পুকুরের কোন তেমুখী রাস্তার মুখে পড়ে থাকেন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়।’ আরেক ব্যবসায়ী সেলিম আহমদ যাচ্ছিলেন ওই রাস্তা দিয়ে। গন্তব্য সুবিদবাজার পয়েন্ট। নুরানী দীঘির একটু দূরে আসা মাত্র দেখেন দুই যুবক হেঁটে যাচ্ছে। তাদের বয়স ২৫ থেকে ৩০-এর মধ্যে। পরনে শার্ট ও প্যান্ট। তখনও বুঝে উঠতে পারেননি কি হয়েছে সামনে। কিন্তু দুই যুবকের হাতে দেখেন রক্তমাখা চাপাতি। পিঠে রাখা ব্যাগ থেকে ময়লা কাপড় বের করে ওরা চাপাতি মুছছে। এরপর তারা দুটি চাপাতি ব্যাগে ঢুকিয়ে জোর পায়ে বনকলাপাড়া গলির ভেতর দিয়ে চলে যায়। একটু সামনে এসে দেখেন অনন্ত দাশের লাশ পুকুরের কোনায় পড়ে আছে। রক্তমাখা দেহটি রাস্তার ওপর ছটফট করছে। তার মতো কয়েকজন দূর থেকে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলেও কেউ এগিয়ে আসেননি। এভাবে কেটে গেছে প্রায় ২০ মিনিট। কেউ পুলিশকে ফোন করছেন। কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকছেন। এ সময়ের মধ্যে খবর পৌঁছে যায় অনন্তর বাসায়। ছুটে আসেন তার দুই বোন। ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহ দেখে ঝাপটে ধরেন। তখন প্রত্যক্ষদর্শীরা এগিয়ে যান। খুনিরা পালিয়ে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর তাকে পরিবারের স্বজনরাই নিয়ে যান হাসপাতালে।
সিলেটের অনন্ত বিজয় দাশ। মুক্তমনা লেখক। ব্লগার হিসেবে নেট দুনিয়ায় পরিচিত নাম। নিজেও সম্পাদনা করেছেন ছোটোকাগজ ‘যুক্তি’। গণজাগরণ সংগঠকও। গতকাল সকালে নিজ বাসার পাশে বনকলাপাড়া নুরানী দীঘির পাড়েই নির্মমভাবে খুন করে চার দুর্বৃত্ত। ঘাতকদের দেখেছেন অনেকেই। কিন্তু কেউ চিনেন নি। ঘটনার পরপরই প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই মানবজমিনের কাছে ঘটনাকালের বিবরণ দিতে গিয়ে শিউরে উঠেছেন। ভড়কে গেছেন তারা। জানান, সকাল তখন পৌনা ৯টা হবে। বনকলাপাড়ার বাসা থেকে বের হয়ে সুবিদবাজার পয়েন্টে আসছিলেন অনন্ত। গন্তব্য কর্মস্থল ছাতকের জাউয়াবাজারের পূবালী ব্যাংকে। তিনি ওই ব্যাংকের উন্নয়ন কর্মকর্তা। সুবিদবাজার পয়েন্টে আসার আগেই পূর্বে থেকে ওত পেতে থাকা চার দুর্বৃত্ত তার ওপর ব্যাগে থাকা চাপাতি দিয়ে হামলা চালায়। এ সময় অনন্ত ফের বাড়ি অভিমুখে দৌড়াতে থাকেন। সঙ্গে পিছু পিছু দৌড়াতে থাকে ঘাতকরা। একই সঙ্গে তারা অনন্তের পেছন দিক থেকে কুপাতে থাকে। এতে কয়েকটি কুপ আঘাত করে অনন্তের মাথায়। বনকলাপাড়া নুরানী দীঘির কোনায় যাওয়া মাত্র সে মাটিতে লুটে পড়ে। পরে পরিবারের লোকজন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। অনন্ত বিজয় সুবিদবাজার নুরানী ১৩/১২ নম্বর বাসার রবীন্দ্র কুমার দাসের ছেলে। ২ ভাই, ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ মুক্তমনা ব্লগে লেখালেখি করতেন। তিনি পূবালী ব্যাংক জাউয়া বাজার শাখায় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডেভেলপম্যান্ট অফিসার হিসেবে কাজ করতেন। এ ছাড়া, বিজ্ঞানবিষয়ক ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র সম্পাদক ছিলেন অনন্ত। তার প্রকাশিত চারটি বই রয়েছে। সেগুলো হলো- পার্থিব, (সহলেখক সৈকত চৌধুরী), শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১১। ডারউইন: একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা, (সম্পাদিত), অবসর, ঢাকা, ২০১১। সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব: লিসেঙ্কো অধ্যায়, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১২। জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ (মূল: ফ্রান্সিসকো জে. আয়াল, অনুবাদ: অনন্ত বিজয় দাশ ও সিদ্ধার্থ ধর), চৈতন্য প্রকাশন, সিলেট, ২০১৪।
অনন্ত খুনের কারণ কি এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট কিছুই এখনও বলা হয়নি। তবে হামলার ধরন থেকে তার সঙ্গী ও স্বজনা ধারণা করছেন, সমপ্রতি খুন হওয়া ব্লগার অভিজিত দাশ, ওয়াশীকুর বাবু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এ হত্যারও ‘মিল’ রয়েছে। এ দুজনকে যে কায়দায় হামলা করে খুন করা হয়েছে, একইভাবে খুন করা হয়েছে অনন্তকেও। বিমানবন্দর থানার ওসি গৌসুল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, অনন্তের খুনের মোটিভ সম্পর্কে পুলিশের ধারণা নেই। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
তিনি বলেন, পুলিশ খুনের ঘটনাকে গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। খুনের ঘটনার পরপরই সেখানে ছুটে যায় এয়ারপোর্ট থানা পুলিশ। তারা খুনের ঘটনাস্থল ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। ঘটনাস্থল থেকে বেশি কিছু আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। এ সময় সিআইডি ও ডিবির কয়েক টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানে যান র‌্যাবের কর্মকর্তারাও।
পরে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ বলেন, অনন্তকে কারা খুন করেছে সে বিষয়টি খোলাসা হয়নি। তবে, পুলিশ সার্বিক বিষয় নিয়ে তদন্ত করছে। কোন গোষ্ঠী এ খুনের সঙ্গে জড়িত কিনা সেটি পুলিশ খতিয়ে দেখছে।
নিহত অনন্তের ভগ্নিপতি সিলেট ট্যাক্সে বার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সমর বিজয় সী শেখর বলেন, সকাল ৯টা ২০ মিনিটের দিকে তারা তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে আসেন একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে। এরপর কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ওসমানী হাসপাতালের উপপরিচালক আবদুস সালাম বলেন, অনন্ত ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে আনার পর ডাক্তাররা তাকে আমরা মৃত হিসেবে পাই।
এদিকে ঘটনার পর অনন্তের বনকলাপাড়া বাসায় কান্নার রোল পড়ে। তার বোনরা বারবার মূর্ছা যান। আর হাসপাতালে লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। তারা জরুরি বিভাগে রাখা লাশকে ঘিরে অঝোরে কাঁদেন। এ সময় গণজাগরণ সংগঠক রজত কান্তি গুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মৌলবাদী চক্রের হাতে খুন হয়েছেন অনন্ত। তিনি মুক্তমনা ব্লগার ছিলেন।
তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এভাবে অব্যাহত থাকলে আরও কত প্রাণ যাবে সেটি বলা যায় না। এদিকে, দুপুরে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকা থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন সংস্কৃতিকর্মীরা। তারা রিকাবীবাজার এলাকায় এসে সমাবেশ করেন। এ সময় আজকের অর্ধবেলা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। দুপুরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকাল সাড়ে ৩টায় তার বাসায় লাশ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন আত্মীয়স্বজনরা। পরে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য লাশ নিয়ে আসা হয় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে প্রগতিশীল সংগঠনের পক্ষ থেকে তার মরদেহে শ্রদ্ধা জানানো হয়। পরে লাশ নিয়ে নগরীতে র‌্যালি বের করা হয়। ব্লগার অনন্ত খুনের পর তার বাসায় শোকাহত পরিবেশে বোন পঞ্চ পুপা দাশ মানবজমিনকে বলেন, অনন্তের কোন দুষমন ছিল না। পারিবারিকভাবে কোন কারণও নেই। তবে কেন খুন হলো অনন্ত- প্রশ্ন রাখেন তিনি। বিকালে শাহপরান থানা পুলিশের ওসি তদন্ত আলম নিহত অনন্তের ঘর থেকে ৫টি বই জব্ধ করেন। এ ছাড়া অনন্তের ব্যবহৃত সিপিউটি উদ্ধার করা হয়েছে। ওদিকে, গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে আনসার বাংলা টিম-৮ টুইটারে এক বার্তায় ব্লগার অনন্ত খুনের দায় স্বীকার করেছে।
রহস্যময় মাইক্রোবাস: কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, খুনের ঘটনার সময় কালো গ্লাসের একটি মাইক্রোবাস এলাকায় দেখা যায়। খুনিরা বনকলাপাড়া গলির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়ার পরপরই ওই মাইক্রোবাসটিও গলির ভেতর দিয়ে যায়। পরক্ষণই মাইক্রোবাসটি ফিরে আসে এবং ওই মাইক্রোবাসটি করে খুনিরা চলে গেছে বলে জানান তারা। খুনিদের সবার পরনে ছিল শার্ট-প্যান্ট। সবার পেছনে ছিল ব্যাগ ঝোলানো। খুনের ঘটনার পর তারা হেঁটে হেঁটে গলির দিকে চলে যায়। এ সময় অনেকেই তাদের দেখে রাস্তা ছেড়ে বাসার ভেতর চলে যান।
আজ আধাবেলা হরতাল: গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক, যুক্তির সম্পাদক, বিজ্ঞান লেখক, মুক্তমনা ব্লগার ও লেখক অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যার প্রতিবাদে এবং খুনিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সিলেট নগরীতে আজ অর্ধবেলা হরতালের ডাক দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ, সিলেট। মঙ্গলবার দুপুরে ওসমানী হাসপাতালে সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু এক সংবাদ সম্মেলনে এ হরতালের ঘোষণা দেন। হরতালে সমর্থন দেন প্রগতিশীল ছাত্রজোট এবং উপস্থিত সিলেটের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীরা। সংবাদ সম্মেলনে দেবু অভিযোগ করে বলেন, ‘একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশাসন কোন পদক্ষেপই নিচ্ছে না। এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটতে থাকলে বাংলাদেশ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।’
হরতালে সমর্থন: ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস হত্যার ঘটনায় প্রগতিশীল ছাত্রজোট ও গণজাগরণ মঞ্চের সিলেটের ডাকে আজ সিলেটে অর্ধবেলা হরতালের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট, যুব মহাজোট, ছাত্র মহাজোট ও হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম) এবং বাংলাদেশ মাইনোরিটি ওয়াচ, সিলেট জেলা শাখার নেতারা। গতকাল হিন্দু মহাজোট সিলেট জেলা শাখার সহসভাপতি শুভ্রাংশু দে অপু স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে সব সংগঠনের পক্ষ থেকে হরতালের প্রতি এ সমর্থন জানান এবং আজ সকাল সাড়ে ১০টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে হরতালের সমর্থনে বিক্ষোভ মিছিল বের করার ঘোষণা দেয়া হয়। বিবৃতিতে নেতারা হরতাল সফল করার জন্য সিলেটের অসস্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী, রাজনৈতি, সামাজিক, সুশীলসমাজের নেতাদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তাৎক্ষণিক মিছিল: হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন সিলেটের স্থানীয় ব্লগার ও এক্টিভিস্টরা। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল হাসপাতালে তাৎক্ষণিকভাবে এক বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। বিক্ষোভ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় তারা অভিযোগ করে বলেন, ‘একের পর এক মুক্তমনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকদের হত্যার পরও প্রশাসনের কোন উদ্যোগ নেই। অভিজিৎ রায়, রাজীব হায়দার, ওয়াশীকুর বাবুকে যে কায়দায় হত্যা করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যা করা হয়েছে। আগে যদি হত্যাকারীরা শাস্তি পেতো তাহলে এভাবে অনন্ত বিজয়কে খুন হতে হতো না।’ তারা অবিলম্বে অতি দ্রুততার সঙ্গে অনন্ত বিজয় দাশের হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান। মিছিলে সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র দেবাশীষ দেবু, ছাত্র ইউনিয়ন সিলেট জেলা সংসদের সভাপতি ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী শহীদুজ্জামান পাপলু (পাপলু বাঙালি) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
বিক্ষোভ মিছিল: সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুপুর ১টায় বিক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আয়োজনে এ বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে শুরু হয়ে ক্যাম্পাসের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। অনন্ত বিজয় দাশ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের (২০০২-০৩ শিক্ষাবর্ষ) সাবেক শিক্ষার্থী ছিলেন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসের প্রথম যুক্তি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।
শেষ স্ট্যাটাসে যা লিখেছিলেন বিজয়: খুন হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন তিনি। পাঠকদের জন্য স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দেয়া হলো- “একজন ক্ষমতাসীন সাংসদ শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে চাবুক মারার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। চাবুক তো একসময় জমিদারদের হাতে হাতে থাকতো। প্রজাদের পান থেকে চুন খসলেই বলা নেই, কওয়া নেই চাবকিয়ে পিঠের চামড়া তুলে ফেলতো তারা। কিন্তু জমিদাররা পুকুর চুরি করলেও কারো মুখে রা কাটতো না! ভাগ্য ভালো বলতে হয় আমাদের, এখন সেই আর জমিদারি যুগ নেই, তবে বিলুপ্তপ্রায় অঙ্গ অ্যাপেনডিক্সের মতো কতিপয় উচ্ছিষ্ট জমিদার রয়ে গেছে এখনও! জনাব সাংসদ, আপনি কোন অপেনডিক্স বংশের জমিদার বলবেন কি? সাংসদের চাবুক মারার কথা শুনে আমারও অধ্যাপক আজাদের মতো জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কী পাস সেটা এখন আর জানার দরকার নেই, আপনি কী ফেল সেটাই না-হয় বলুন! মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা এদের নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে! কলিকালের শিক্ষা একেই বলে! সাংসদ ক্ষমতার জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার হয়েছেন, তাতেই লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন ভাবখানা ধারণ করে আছেন! একটা অনির্বাচিত সংসদের মেম্বার হয়েছেন, যেখানে লজ্জায় আপনাদের বিনম্র হওয়ার কথা, তা-না, উল্টো আপনাদের অনির্বাচিতদের ক্ষমতার দম্ভ দেখলে মনে হয়, বেহায়া আর কাকে বলে! সাংসদ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় আপনি কখনো গিয়েছেন কি-না সেটা জানার দরকার নেই আমাদের, আপনি বরং প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষককের নাম বলুন, বেঁচে থাকলে ওই শিক্ষককে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, শৈশবে এ রকম একটা বেয়াদপকে শিক্ষা দিয়ে নিজের অর্থপ্রাপ্তি ঘটানোর চেয়ে আপনার বরং কৃষিকাজই উত্তম ছিল। শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করার কী দরকার ছিল! জনাব সাংসদ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষককের বিরুদ্ধে সিলেট-বিদ্বেষ-এর অভিযোগ এনেছেন। তা জনাব, সিলেটের প্রতি এতো আলগা-প্রেম দেখানোর দরকারটাই বা কী! সিলেট কি বাংলাদেশের ভিতরে অন্য কোনো দেশের ছিটমহল, নাকি অন্য দেশের ভিতরে বাংলাদেশের কোনো ছিটমহল! আপনি কি কখনো প্রমাণ করতে পারবেন, আপনার তথাকথিত অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষক বাংলাদেশ-বিদ্বেষী! অধ্যাপকের প্রতি আপনাদের এতো গাত্রদাহের কারণটা কি? শুনেছি এই সাংসদের পিতা ছিলেন একাত্তরের পাকিস্তানের গণহত্যার সহযোগী শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্বাধীনতাবিরোধীদের বিপক্ষে একটি বজ্রকঠিন সাহসী কণ্ঠ। তিনি ক্লাসে, লেখালেখিতে, ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন, ৭১-এর চেতনার কথা বলেন, স্বাধীনতার কথা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের কথা বলেন। শিক্ষার্থীরা যেন অন্তর থেকে বাংলাদেশকে ভালোবাসে এজন্য দীর্ঘদিন ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বলেই বোধহয়, আমাদের সাংসদের অধ্যাপকের নাম শুনলেই গাত্রদাহ শুরু হয়। সমীকরণটা বেশ সোজা। সাংসদ অভিযোগ করেছেন, ওই শিক্ষকের কারণে নাকি সিলেটবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না!! হাস্যকর কথাবার্তা! সিলেটবাসী মেধার জোরে পরীক্ষা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, এতে কার কি সমস্যা আছে? আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে কোটাভিত্তিক ব্যবস্থা যারা চান সিলেটিদের জন্য, তাদের উদ্দেশে বলি, ঢাকাবাসী যদি দাবি করে শুধু ঢাকাইয়ারা ঢাবিতে পড়বে, অন্য কেউ না, চট্টগ্রামবাসী যদি দাবি করে শুধু চট্টগ্রামের লোকেরা কেবল পড়বে তাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, রাজশাহী, খুলনা, বরিশালে যদি এমন দাবি উঠে তবে তো বাংলাদেশ আর অখণ্ড দেশ বলার দরকার নেই... বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিত্তি করে একেকটা অঞ্চলকে স্বাধীন দেশ বানিয়ে দিলে চলবে! সিলেটিরা কি ঢাবিতে, চবিতে, রাবিতে লেখাপড়া করছে না? শাবিপ্রবিতে কি সিলেটিরা পড়ছে না? জনাব সাংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটার মানেই হচ্ছে বিশ্বপরিসরের বিদ্যালয়! তা আপনাদের মতো কতিপয় ‘ছিলটি মৌলবাদী’র বক্তব্য শুনলে মনে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে আপনারা নিজের এলাকার প্রাইভেট কিন্ডারগার্টেনের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না। হয়তো ক্ষমতাসীন সাংসদ হওয়ায় আপনি নিজে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনের পরিচালনা-কমিটির সদস্য, তাই বিশ্ববিদ্যালয় আর পারিবারিক সম্পত্তি কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে তফাৎ আপনি খুঁজে পান না। ‘ছিলটি-মৌলবাদী’দের কাছে সিলেট বাংলাদেশের কিছু নয়, সিলেট আলাদা একটা রাষ্ট্র! তাই বলি কী, সিলেটকে আগে বাংলাদেশ থেকে আপনারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলুন, আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করুন, তারপর না-হয় যতখুশি ‘সিলেটি-প্রেম’ দেখাবেন, আর তথাকথিত ‘সিলেট-বিদ্বেষী’দের খুঁজে বেড়াবেন। বাংলাদেশে থেকে, বাংলাদেশের খেয়ে, বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নিয়ে, বাংলাদেশি পাসপোর্ট হাতে নিয়ে, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সাংসদ হয়ে বেশরমের মতো ‘আঞ্চলিকতা’ করে বেড়াবেন তা তো হতে পারে না! আপনারা না-হয় আগে বাংলাদেশি আইডেনটিটি ত্যাগ করুন! ২০০৭ সালের দিকে আমি যখন ‘যুক্তি’র প্রথম সংখ্যাটা সম্পাদনা করি, সেখানে লেখক সুমন তুরহান-এর লেখা প্রকাশ করেছিলাম, যার নাম ছিল ‘সিলেটি মৌলবাদ’। এই লেখার শেষের দিকের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি: ‘সিলেট, মহাসমুদ্রের একটি ক্ষুদ্রতম চর, আর আমরা সেই চরের অধিপতিরা, আর কিছু করতে না পারলেও জন্ম দিয়েছি একটি স্বতন্ত্র মৌলবাদের। সিলেটি মৌলবাদ, অত্যন্ত নীরবে, বহুদিন ধরেই ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ মহামারী আকারে, এখনই এই প্রগতিবিরোধী আঞ্চলিকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো দরকার। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ করে রেখে কোনো ইতিবাচক অর্জন আনা সম্ভব নয়। কোনো মুক্তমনের মানুষই আঞ্চলিক মৌলবাদে দীক্ষিত হতে পারে না; পারেন না সংকীর্ণতার দেয়ালে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখতে। পৃথিবীটা অনেক বড়ো, তবে আমাদের সুশীল ভণ্ডরা এখনো বেশ আদিম, তাঁদের সময় এসেছে কুয়োর বাইরে বেরিয়ে এসে বিশাল বিশ্বটাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার। আমরা প্রত্যেকে মানুষ এবং আমরা প্রত্যেকেই বাঙলাদেশের বাঙাল্তিএই সহজ সত্যটি উপলব্ধি করতে সিলেটবাসীর আর কতোকাল লাগবে?’
আনসার বাংলা ৮ এর দায় স্বীকার
মুক্তমনা লেখক ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশকে হত্যার দায় স্বীকার করে টুইটারে একাধিক টুইট করেছে আনসার বাংলা ৮ নামের একটি আইডি। এক টুইট বার্তায় তারা লিখেছে, ‘আলহামদুলিল্লাহ! আমরা আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আল-কায়েদা উপমহাদেশ (অছওঝ) এর ভাইরা আরও এক ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক ব্লগারকে জাহান্নামে পাঠিয়েছেন! সে নাস্তিকদের আখড়া মুক্তমনার এডমিন এবং নিয়মিত বিভিন্ন নামে আল্লাহ ও তার রাসূল (সা.) এবং ইসলাম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করত।
এর আগে তারা অনন্ত বিজয়কে হত্যার দায় স্বীকার করে শিগগির টুইট বার্তা দেয়া হবে বলেও টুইটার বার্তায় জানায়। মঙ্গলবার সকালে নিজের অফিস পূবালী ব্যাংকে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে প্রায় ১শ’ গজ যাওয়ার পর অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হন অনন্ত বিজয়। ৪-৫ জন মুখোশধারী দুর্বৃত্ত ধারারো অস্ত্র দিয়ে তার মাথার সামনে, পেছন দিক, পাশে এবং ঘাড়ে একাধিকবার কোপ দেয়। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হলেও স্থানীয়রা তাকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। অনন্ত বিজয়ের হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে জোর তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ। তিনি জানান, টুইটার বার্তায় দায় স্বীকারের বিষয়টি আমরা শুনেছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হিটলিস্টে ছিল অনন্তের নাম: ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তারকৃত শফিউর রহমান ফারাবির হিটলিস্টে সিলেটের ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশের নাম ছিল বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে তারা বিষয়টি নিশ্চিত নয় বলেও জানায়। সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ জানান, গত ৮ই মার্চ সিলেট নগরীর মুন্সিপাড়ার ডি/১৬ নম্বর বাসা থেকে ঢাকা মহানগর  গোয়েন্দা পুলিশ ফারাবিকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় তার কাছ থেকে একটি হিটলিস্টও উদ্ধার করা হয়। সেই লিস্টে অনন্ত বিজয় দাশের নাম ছিল বলে শুনেছি। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নই। আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটনে পুলিশ ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ।
ব্লগার হত্যায় বৃটেনের নিন্দা
সিলেটে মুক্তমনার ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস রিপন হত্যার ঘটনাকে পাশবিক হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করে এর নিন্দা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। গতকাল এক টুইট বার্তায় তিনি এই নিন্দা জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের জন্য বাক-স্বাধীনতার জায়গা থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। গতকাল সকালে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস রিপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নয়টার দিকে কর্মস্থলে যাওয়ার উদ্দেশে নগরীর বনকলাপাড়া এলাকার বাসা থেকে বের হলে রাস্তায় তার ওপর হামলা করে ৪ দুর্বৃত্ত। তারা রিপনকে কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রিপন পূবালী ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.