কূটনীতির কাছে হেরে গেল রাজনীতি by ওয়াসবির হোসেন

তরুণ গগৈ: চুক্তির পক্ষে যাঁর অবস্থান
শেষমেশ কূটনীতি ও দ্বিপক্ষীয় দাবি রাজনীতি ও আবেগের ওপরে স্থান পেল। বলা যায়, রাজনীতি হেরে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতীয় মন্ত্রিসভা গত মঙ্গলবার স্থলসীমান্ত বিলে (সংবিধানের ১১৯তম সংশোধনী) অনুমোদন দিয়েছে, যার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত স্থলসীমান্ত চুক্তি কার্যকর হবে। পার্লামেন্টে বিলটি পাস হয়ে গেলে দুই দেশের মধ্যে ভূমি বিনিময় সম্ভব করে তুলবে।
মনমোহন সিংয়ের কংগ্রেস সরকার ২০১১ সালে অতিরিক্ত প্রটোকল স্বাক্ষর করলে বিজেপি তখন এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর যখন বুঝলেন, বাংলাদেশসহ ভারতের অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নয়ন করা দরকার, তখন তিনি খুব দ্রুতই নিজেকে ও দলকে শুধরে নিলেন। মোদি নিজের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেন। তাঁর মন্ত্রিসভা যখন মঙ্গলবার এ বিলে অনুমোদন দিল, তখনই বোঝা গেল, তিনি আসলে কাজের মানুষ। শুধু কথার খই ফোটান না তিনি।
বৈপরীত্য হচ্ছে, কংগ্রেস নয়, বিজেপিরই একটি অংশ এই স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। আসামের রাজ্য বিজেপি এর বিরোধিতা করেছে, কারণ সেখানকার স্থানীয় পার্টি নেতারা ‘সূচ্যগ্র মেদিনীও দেব না’—এমন ধনুর্ভঙ্গ পণ করে বসেছিলেন। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই, কারণ আগামী বছর আসাম রাজ্যসভার নির্বাচন। সেই নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে ভূমি দিয়ে দেওয়া হলে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে, তারা ভূখণ্ড বেচে দিয়েছে। ফলে তারা এর বিরোধিতা করেছে। তদুপরি, আসামের জাতীয়তাবাদী দল যেমন অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ), আঞ্চলিক গণপরিষদ (এজিপি) বাংলাদেশের কাছে ভূমি হস্তান্তরের তীব্র বিরোধিতা করছে। তারা ইতিমধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টির হুমকিও দিয়েছে। এটা মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশ থেকে আসামসহ ভারতের অন্যান্য অংশে অনুপ্রবেশ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ক্ষেত্রে সত্যিই বড় রাজনৈতিক ও নির্বাচনী বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
আগামী বছরের রাজ্য নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা করে আসাম রাজ্য বিজেপির নেতারা আসামকে এ চুক্তি থেকে বাদ দেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন। তাঁদের এই আরজি প্রায় পাসও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কংগ্রেস ও বাংলাদেশ এর বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি তোলে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদি রাজনীতি ও আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁর মন্ত্রিসভায় এই বিল পাস করান। গতকাল বুধবার রাজ্যসভায় সর্বসম্মতিক্রমে বিলটি পাস হওয়ার পর আজ লোকসভায় পেশ করার কথা।
এখন সবাই এটা দেখছে যে পররাষ্ট্রনীতিতে মোদি বেশ সক্রিয়। আর আগামী জুনে বাংলাদেশ সফরের আগে তাঁর পক্ষে এই চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসা সম্ভব নয়। সর্বোপরি, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভালো হচ্ছে গত বছর থেকে এমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আর নয়াদিল্লি তার পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। নয়াদিল্লি পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে ঢাকার সঙ্গে তিস্তা চুক্তিতে তেমন একটা অগ্রসর হতে পারেনি। ফলে মোদি আগামী জুন মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় সেখানে খালি হাতে যেতে চান না। অন্তত বাংলাদেশকে দেওয়া যায়—এমন সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব নিয়ে তিনি সেখানে যেতে চান।
আসামের প্রবীণ মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা তরুণ গগৈ বলেছেন, ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হলে সীমানা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। ফলে তখন সীমানা সিলগালা করে দেওয়া যাবে, অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবে। তিনি আরও বলেছেন, স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিতর্কের চির অবসান ঘটবে। বাংলাদেশ-আসাম সীমান্তে মোট ৯৮২ একর ভূমি নিয়ে বিতর্ক আছে। আসাম রাজ্য সরকার বলেছে, এই চুক্তির বাস্তবায়ন হলে আসাম ৭১৪ একর ভূমি পাবে, আর এর বিনিময়ে তাকে ২৬৮ একর জমি বাংলাদেশকে দিতে হবে। এই সত্যেই এখন বিজেপিকে সান্ত্বনা খুঁজতে হবে, তরুণ গগৈ ঠিক এ কথাটাই ঢাকঢোল পিটিয়ে বলছেন।
স্থানীয় রাজনীতি ও আবেগের ব্যাপারটি সত্ত্বেও কারও পক্ষে নয়াদিল্লির দৃষ্টিভঙ্গির বৃহৎ পরিসরকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছেন, ফলে তিনি নিশ্চিতভাবে অনেক কিছুই করতে পারেন। এমনকি আসামের মতো স্থানীয় পার্টি ইউনিটের ভীতিকেও তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেন, ঠিক এ ক্ষেত্রে তিনি যেমন করেছেন। বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঝুলে থাকা খুঁতখুঁতে সমস্যাগুলো তিনি অবশ্যই সমাধান করতে চান। কারণ, এরপর তাঁকে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে ঝুলে থাকা অনেক কুটিল সমস্যার সমাধান করতে হবে। সেই জটিল কাজ হাতে নেওয়ার আগে তিনি এগুলোর সুরাহা করতে চান। ফলে তাঁকে এই বিল পাস করাতেই হবে।
বিজেপি আশা করে, আজ হোক বা কাল হোক, সবাই এটা মেনে নেবে যে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকা সমস্যার চির সমাধান দেবে। এরপর দেশ দুটি বাণিজ্য, সংযোগ, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ কৌশল প্রণয়ন এবং পানি সমস্যার মতো বিষয়গুলোতে মতৈক্যে আসতে পারবে। হ্যাঁ, এখন সবার দৃষ্টি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের দিকে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ওয়াসবির হোসেন: রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও আসামের গুয়াহাটির সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পিস স্টাডির নির্বাহী পরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.