চাওয়া পাওয়া by

প্রায় তেরো ঘণ্টা একটানা আকাশে উড়ে আসার পর ইমিগ্রেশনের দীর্ঘ অলস সারি, তারপর লাগেজের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা—এসব অব্যবস্থাপনা দেখে আমার মেজাজ খিঁচড়ে থাকলেও আমি কিছুই গায়ে না মাখার চেষ্টা করি। অনেক বছর পর দেশে ফিরে যার সঙ্গে দেখা হবে তার চেহারার স্নিগ্ধ বিষণ্নতার একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখে আমি একটা তাপ অপরিবাহী বর্ম রচনা করে রাখি নিজের চারপাশে। এয়ারপোর্টে আমাদেরকে নিতে এসেছে পারুলের ছোট ভাই, ওকে পেয়ে সে তার স্বামী, প্লেন কোম্পানির চরম অব্যবস্থা, ঢাকা এয়ারপোর্টে যাত্রী পরিষেবার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে এক গাদা অভিযোগ শুরু করলে ও বোনের অলক্ষ্যে আমার দিকে চোখ টিপে তার কথায় সায় দেয়। আমি ভাইবোনের কথায় যোগ দেই না, এমনকি ঢাকার বিশৃঙ্খল ট্রাফিক, গাড়ির জানালার বাইরে নাছোড় ভিক্ষুকের অসহিষ্ণু টোকা—কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। আমার মাথার মধ্যে কেবল পুরোনো পরিচিত গানের কলির মতো কিংবা বহু আগে দেখা কোনো সিনেমার দৃশ্যের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল নিশাদের মুখ। অনেক বছর আগে ওকে পেছনে ফেলে রেখে যখন বিদেশে চলে যাই,
তখন প্রথম দিকে নিশাদ ছিল হারিয়ে যাওয়া কোনো গোপন সম্পদের মতো, যার কথা আচমকা মনে পড়লে বুকের ভেতর একধরনের কষ্ট জেগে ওঠে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তারপর দিন, মাস, বছর ঘুরে যেতে মেয়েটি হানা দিতে শুরু করে সংগোপনে। নিউইয়র্ক সিটির সাবওয়ের দীর্ঘ একঘেয়ে সুড়ঙ্গপথে সেসব দিনের স্মৃতিগুলো হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়ত। নিশাদ আমার দূর সম্পর্কের চাচাতো বোন, একই বাড়ির দুপ্রান্তে থাকতে থাকতে চোখের সামনে মেয়েটা কখন যে ফুটে উঠল পথের পাশের অতিপরিচিত নাম না জানা বুনোফুলের মতো, কখন যে স্কুলের বর্ণহীন ইউনিফর্ম ছেড়ে স্বরূপে উদ্ভাসিত হলো টের পাইনি। ছুটিছাটায় বাড়িতে গেলে ওকে দেখতাম আর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কখনো মনে হতো, এই সকালবেলাতেও চোখে কাজল? পরে বুঝতে পেরেছি, ওর চোখগুলোই এ রকম—মনে হয় সব সময় কাজল পরে আছে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বাড়িতে আমার বেশ কদর। তাই ওকে দেখলেই খুব কায়দা করে পড়াশোনার কথা জিজ্ঞেস করতাম, কী কী সাবজেক্ট পড়ানো হয় কলেজে—এসব মামুলি কথার ফাঁকে আর কতক্ষণ আটকে রাখা যায়?
ওকে নতুনভাবে আবিষ্কার করার পর সুযোগ পেলেই বাড়িতে চলে যেতাম, হয়তো একটু ঘন ঘনই। অবশ্য সদরে গিয়ে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে রোজ আড্ডা দেওয়াও ছিল একটা কারণ। এক সকালে রাস্তায় গিয়ে দেখি নিশাদ দাঁড়িয়ে আছে রিকশার অপেক্ষায়, ওকে দেখে বুকের ভেতর এক অজানা পাখি চিড়িক করে ডেকে ওঠে। দূর থেকে একটা খালি রিকশা আসতে দেখে বলি, চল, তোরে কলেজে পৌঁছায়ে দিয়ে যাই। জানি না, মনে মনে ও এটাই চাইছিল কি না, তবে কোনো আপত্তি না করে উঠে বসে। এ রকম বেশ কয়েকবার ঘটেছে, কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো কাকতালীয়ভাবে। তেমনি একদিন রিকশায় বসে ওর শরীর আর সুগন্ধির মিলিত ঘ্রাণের বিহ্বল অবস্থায় কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে বলি, তুই এত সুন্দর হয়ে গেলি কখন, বল তো? ও এক ঝলক আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকায়, তারপর বিষণ্ন কণ্ঠে বলে, আপনি এত কিছু দেখতে পান কীভাবে? আপনার দেখার সময় আছে নাকি? বাড়িতে এলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, আর ঢাকায় গেলে ইউনিভার্সিটির সুন্দরী বান্ধবীদের দেখতে ব্যস্ত। আমি ওর এ রকম জবাবে কী বলব ভেবে পাই না। সামনে এলজিইডির নতুন পিচ করা সোজা রাস্তা দুই পাশের আকাশমণি গাছের সারির মাঝে মরা শিংমাছের মতো সটান পড়ে থাকে।
সেই ক্ষণিক দুর্লভ নৈঃশব্দ্যের মাঝে আমি স্বভাবসুলভ চপলতা হারাই, পড়তে পারি ওর আচমকা অনুযোগের ভাষা। ধীরে সুস্থে বলি, না রে, যেমন ভাবিস তেমন নয়, রাজধানীর মেয়েরা একটু খলবলানি টাইপের হয়, তোমাদের মতো নয়। আচমকা তুই থেকে তুমিতে উঠে এলাম বলে ও বোধ হয় একটু অবাক হয়ে ওর কাজল পরা মনে হওয়া চোখে আমার দিকে তাকায়, আমি ওর ফিরে তাকানোটা অনুভব করি, যেন সেই দৃষ্টি আমার ভেতর দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। ও বলে, আমাদের মতো নয় মানে কী? আমি সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে একটু হালকা চালে বলি, একটা জিনিস খেয়াল করলাম, তোমার কসমেটিকসের মধ্যে কাজলের খরচটা লাগে না, তাই না? ও বোধ হয় একটু লজ্জা পায়, বলে, যত কাঠখোট্টা মনে হয়, তত নয় দেখি। তারপর বলে, খুব তো মাখো মাখো কথা বলছেন এখন, ঢাকায় গেলে এসব খেয়াল থাকে? আমি এলায়িত লতার মতো পড়ে থাকা ওর হাতের ওপর হাত রেখে বলি, আগে না থাকলেও এখন থাকে, সে জন্যই তো ঘন ঘন বাড়ি চলে আসি। আমার হাতের স্পর্শে তির তির করে কেঁপে ওঠে ও, কিন্তু হাত সরিয়ে নেয় না। তারপর সারা পথ আর কোনো কথা হয় না আমাদের। রাস্তার স্বাভাবিক শব্দ থেমে গেলে আমি খুব কাছ থেকে ওর হালকা শ্বাসের শব্দ পাই। আমার ঘন ঘন বাড়ি আসা আমার রিটায়ার্ড শিক্ষক বাবা পছন্দ না করলেও মায়ের ছিল প্রচ্ছন্ন সমর্থন।
নিশাদকে মা যে পছন্দ করতেন সেটা বুঝতে পারতাম। খুব শান্ত স্নিগ্ধশ্রী বিষণ্ন চেহারায় কাজলটানা চোখের মেয়েটিকে মায়েদের পছন্দ হওয়ারই কথা। হয়তো মনের ভেতর ওকে ঘরের বউ হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছিলেন তিনি। আমি ঘরে থাকলে নিশাদকে কোনো অছিলায় ডাকিয়ে আনাতেন। তারপর ও এলে বলতেন, নিশু, তোর বড় চাচার পাঞ্জাবির বোতামগুলা লাগাইয়া দে তো মা, এখন একদম চক্ষে দেখি না। চশমা দিয়াও পারি না। নিশাদ আমার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কোনো কথা না বলে ভালো মানুষের মতো সুতোর মাথাটা ভিজিয়ে সরু করার জন্য মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে বের করে সুইয়ে পরিয়ে নেয়। মা একসময় কী একটা কাজের অজুহাতে বের হয়ে গেলে নিশাদ দাঁত দিয়ে সুতা কাটতে কাটতে বলে, আজ আড্ডা মারতে গেলেন না? আমি বলি, আজ তো তোমার কলেজ ছুটি, রিকশায় একা একা যেতে হবে বলে গেলাম না। ও দরজার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে নিচু গলায় বলে, খুব সাহস বাড়ছে আপনার। রোজ রোজ একসঙ্গে রিকশায় গেলে মানুষ নানান কথা ছড়াবে। আমাকেও গলা নামাতে হয়, কেউ যাতে কিছু না বলে, তার ব্যবস্থা হবে আমি পাস করে বের হবার পর। ও ‘ইশশশ’ বলে মাথা নিচু করে ফেলে। ওর মুখের রক্তিম আভা যেন সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ে বিকেলের কনে দেখা আলোর মতো। আমি বুঝতে পারি, ওর হাত বিবশ হয়ে গেছে। মুখের লালিমা ধীরে ধীরে মুছে গেলেও হাত আর গতি ফিরে পায় না। আমি ওকে নতমুখী অবস্থা থেকে বের করার জন্য বলি, ঢাকায় ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হলে ভালো রেজাল্ট করতে হবে, এখন খুব কম্পিটিশন। ও মুখ তুলে চায়, কোনো কথা বলে না, শুধু ভীত চোখে একবার দরজার দিকে তাকায়। আমি এবার গলা নামাই, তুমি ঢাকায় ভর্তি হতে পারলে রোজ একসঙ্গে রিকশায় ঘুরলেও কেউ কিছু দেখবে না, বলবেও না। ধরো, তুমি রোকেয়া বা শামসুন্নাহার হলে থাকবে, আমি বুয়েটের হল থেকে চলে আসব রোজ বিকেলে। এ সময় ওর কাজল টানা চোখ দুটো হঠাৎ খুব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, বলে, তারপর? আমি গলাটা আর একটু নামাই, আমরা ফুলার রোড ধরে হাঁটব, তুমি তখন গুনগুন করে গাইবে, তুমি রোজ বিকেলে আমার বাগানে ফুল নিতে আসতে, জানি না তুমি ফুল না আমাকেই বেশি ভালোবাসতে...। আমি লক্ষ করি, ওর চোখ দুটো আবার নিভে যায়, চেহারায় ফিরে আসে বিষণ্ন বিকেলের ম্লান আভা। ও হাতের কাজ থেকে চোখ না তুলে বলে, বেশি বেশি স্বপ্ন দেখা ঠিক না। একসময় হঠাৎ উঠে পড়ে বলে, যাই, আমার কাজ শেষ।
বাড়িতে তো একা হওয়ার সুযোগ ছিল না খুব, তাই আমাদের বহু বিকেল, দুপুর কেটে গেছে ইঙ্গিতের ভাষায়, দৃষ্টির বিনিময়ে আর অপ্রকাশ্য অনুভূতির ইশারায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকার কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে নিশাদকে স্থানীয় কলেজেই পড়তে হয়। আমারও ইউনিভার্সিটির শেষ বছরগুলোতে পড়াশোনার চাপ বেড়ে গেলে বাড়িতে যাওয়া হতো না তেমন। তখন ক্ষীণ হয়ে আসে আমাদের যোগাযোগ। ওর নিজস্ব মোবাইল ফোন হওয়ার পর আমরা কথা বলতাম, তবে উভয়ের সুবিধাজনক সময় মিলত না বলে খুব বেশি কথা হতো না। এর মধ্যে আমার এক প্রফেসরের বাসায় আসা যাওয়ার সুবাদে পরিচয় হয় তাঁর মেয়ে পারুলের সঙ্গে। রেজাল্ট ইত্যাদি মিলিয়ে আমাকে হয়তো স্যারের অপছন্দ ছিল না, নিজের অজান্তেই পারুলের সঙ্গে কখন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ি টের পাই না। সেই ঘনিষ্ঠতা থেকে আমার পাস করে বের হওয়ার পরপরই আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে একটা স্কলারশিপের সুবাদে পারুলের সঙ্গে বিয়েটাও ঘটে যায়। ঘটনা বিচারে এসব প্রক্রিয়ায় কয়েক বছর লাগলেও সবকিছু ঘটে যায় দীর্ঘ স্বপ্নের মতো। মেয়েদের বহু কিছু বোঝার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে, নিশাদ সেই সহজাত ক্ষমতাবলে বুঝে নিয়েছিল সব, তাই ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেয় ওর আপন বিষণ্নতার চাদরে। একবার আমি বাড়ি গেলে ওর মুখোমুখি হওয়ার পর কেবল একটা কথা বলেছিল, বলছিলাম না, বেশি স্বপ্ন দেখা ঠিক না? আমি কোনো জবাব দেওয়ার আগেই দ্রুত চলে গিয়েছিল ও, অবশ্য চলে না গেলে আমিও কোনো জবাব দিতে পারতাম না।
আমার এ রকম আচমকা পাল্টি খাওয়ার শোক সইতে না পেরেই বছর খানেকের মধ্যে মারা যান মা, সেই শোকেই হয়তো বাবা যান তার পরের বছর। তাই দেশে ফেরার কোনো তাগিদ অনুভব করি না আগের মতো। নিউইয়র্ক থেকে মাঝে মাঝে গ্রামে থাকা বড় ভাই বা ভাবির সঙ্গে ফোনে কথা হয়। একদিন ভাবিকে জিজ্ঞেস করি, নিশাদের খবর কী? ভাবি বলেন, ভালো না, জামাইটা বদের হাড্ডি, কাজকাম তেমন কিছু করে না, খালি ধান্দায় ঘোরে, আর বউটারে খুব জ্বালায়। কয়েক মাস পর তেমনি এক ফোনে জানতে পারি, নিশাদ বাবার বাড়ি চলে এসেছে, আর ফিরে যাবে না। ভাবি বলেন, ইশ্, তুমি ওরে বিয়া করলে ওর জীবনটা এই রকম নষ্ট হইত না। এই কথার ভেতর দিয়ে সাত-আট হাজার মাইল দূর থেকেও আমি নিশাদের দীর্ঘশ্বাস শুনি। এটা শোনার পর দেশে যাওয়ার জন্য আমার ভেতরটা উতল হাওয়াময় দিনে বাতাসের দীর্ঘশ্বাসের মতো হু হু করতে থাকে, কিন্তু ছেলেমেয়েদের স্কুল, আমার চাকরির ব্যস্ততা—সব মিলিয়ে শিগগিরই দেশে আসা হয়নি। সেই আসা হলো এবার। ঢাকায় কয়েক দিন জেটল্যাগের ধকল কাটিয়ে আমি বাড়িতে যাওয়ার উদ্যোগ নেই। পারুল যাবে না জানিয়ে দিয়ে বলে, বাড়িতে তো তেমন কেউ নেই, এত উতলা হয়ে যার জন্য যাচ্ছ, তাকে দেখেও এখন আর ভালো লাগবে না, যেমন আমাকে দেখে লাগে না। নিশাদকে আবার দেখার জন্য আমার নিজেকে প্রায় স্বপ্নোত্থিত মানুষের মতো মনে হয়, তাই অহেতুক ঝামেলা এড়াতে পারুলের কথার কোনো জবাব দেই না আমি। দেশের রাস্তাঘাটের হাজার হুজ্জত গায়ে না মেখে আমি যখন বাড়িতে পৌঁছি তখন সাঁঝবেলা। বাড়ির অন্য শরিকদের সবাই দেখা করতে আসে আমার সঙ্গে, নিশাদের ভাই—ভাবিও আসে, কিন্তু নিশাদ আসে না। একসময় সব দ্বিধা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করি, নিশাদের খবর কী? ওর ভাই বলে, আর কী, নিজে থেকে আইসা পড়সে। স্কুলের মাস্টারিটা ছিল বইলা সাহস করতে পারসে। আমার অবস্থাও তো ভালো না। একধরনের অপরাধবোধ থেকেই আমি কিছু বলার মতো কথা খুঁজে পাই না।
সে রাতে আমার ভালো ঘুম হয় না, নতুন জায়গা বলে, নাকি নিশাদের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না বলে, জানি না। পরদিন সকালে নাশতা করার পরই ওদের ঘরে যাই, ও তখন স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আমি ওকে দেখে কিছুক্ষণ অবাক তাকিয়ে থাকি। আমার সামনে যেন একটা অস্পষ্ট আরশি ঝোলানো, যাতে সবকিছু বিবর্ণ মলিন দেখায়। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় বহু বছর আগে নীলনয়না এক আফগান কিশোরীর ছবি ছাপা হয়েছিল। অনেক বছর পর সেই নীলনয়নাকে খুঁজে বের করে ছবিটির ফটোগ্রাফার। মেয়েটির আগের ছবির তুলনায় পরের বয়স্কা ছবিটা দেখে যে রকম লেগেছিল, ওকে দেখেও আমার মাথায় আচমকা সেই উপমাটা চলে আসে। সেই কাজলটানা চোখের কাজল এখন আর আগের মতো নেই, চুলে সামান্য পাক ধরেছে, মুখের শান্তশ্রী কমনীয়তা উধাও। আমি ওর দিকে পলকহীন চেয়ে থাকি। আমার দৃষ্টির সামনে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, কয় দিন থাকবেন? বিকেলে এসে আপনার সঙ্গে কথা বলব, এখন স্কুলের সময় হয়ে গেছে। ওর এই শীতল জবাবে আমার ভেতর অকারণ অভিমান জাগলেও আমি শুধু বলি, তুমি ভালো আছ? ও খুব ম্লান হেসে বলে, হ্যাঁ, খারাপ কেন থাকব? বুঝতে পারি, এই কথার ভেতর অনেক অভিমানের বাষ্প জমে আছে। একটা প্রবল অপরাধবোধে বিদ্ধ হয়ে ফিরে আসি আমি। বিকেলে ও নিজেই দেখা করতে আসে। একথা-সেকথার পর ওর ভাঙা সংসারের কাহিনি বলে কোনো রাখঢাক ছাড়াই। স্বামীর ঘর ছেড়ে আসার পর একাকী জীবনসংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে কখনো ওর চোখের ভরাকাটালের জোয়ার বহু কষ্টে রোধ করে ও। আমি কেবল ওর ভেতর বহু বছর আগে ছেড়ে যাওয়া নিশাদকে খুঁজছিলাম, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে হঠাৎ দেখা দেওয়া চাঁদের মতো মাঝে মাঝে একঝলক দেখা দিয়ে আবার লুকিয়ে পড়ছিল সে। ওকে একান্তে পাওয়ার কোনো সুযোগ মিলছিল না বলে, আমি যেসব কথা ভেবে এসেছিলাম, সেসবের কিছুই বলা হয় না। আমি আরও কয়েক দিন অলসভাবে বাড়িতে কাটিয়ে দেই কেবল নিশাদের জন্য। একদিন কথার ফাঁকে মৃদুস্বরে আমাকে বলে, সন্ধ্যায় পুকুর ঘাটে থাকবেন একটু? কথা বলব। আমার ভেতর বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো কিছু একটা বয়ে যায়। প্রতীক্ষার প্রতিটা প্রহর মনে হয় দুর্ভার। কী কথা বলতে একাকী দেখা করতে চায় নিশাদ? আমাদের সেই সব দিনের স্মৃতি?
সন্ধ্যার আগেই আমি পুকুরের ঘাটে বাঁধানো বেঞ্চে গিয়ে বসে থাকি, আমার বুকের ভেতর এই বয়সেও তারুণ্যের মতো গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে থাকে। সন্ধ্যার ঠিক কিছু আগে ও আসে, তখন আশপাশে কেউ নেই, পাশের কোনো গাছ থেকে ঝিঁঝি পোকার করাত সন্ধ্যার নৈঃশব্দ্যকে নির্মমভাবে চিরে ফেলছিল। ঘোমটাটা দিয়ে অর্ধেক মাথা ঢাকা, হালকা বৈকালিক সাজ থাকতেও পারে, কাজলটানা চোখ এখন কিছুটা দৃশ্যমান। কাছে এসে দাঁড়ালে ওর শরীরের হালকা অপরিচিত সুবাস পাই। বসতে বললেও বসে না ও। আমি অপরাধীর মতো বলি, তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া হয়নি কখনো, অথচ উচিত ছিল। ও বলে, মাফ চাওয়ার কী আছে, আমি জানতাম, তাই তো স্বপ্ন দেখাতে নিষেধ করতাম। আমি আরও কী যেন বলতে চাইলে ও সুযোগ না দিয়ে বলে, এখানে বেশি সময় থাকা ভালো দেখাবে না, এখন সবকিছুতে মনে রাখতে হয়, আমি সিঙ্গেল। শোনেন, যে কথা বলতে ডেকেছি আপনাকে, সেটাই বলি। তারপর কিছু সময় নেয়, যেন ফিরে যেতে চাইছে আমাদের আগের দিনগুলোতে। আমার বুকের ভেতরের আলোড়ন প্রায় সশব্দ হয়ে ওঠে। একসময় খুব নিরুপায় কুণ্ঠা নিয়ে বলে, যাওয়ার আগে আমাকে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে যেতে পারবেন?
সন্ধ্যার সেই আলোয় ওর চোখের কাজল লেপ্টে যাচ্ছিল ঘনায়মান অন্ধকারে, আমাদের মাথার ওপরের গাছে নিশীথাশ্রয়ে আসা কয়েকটা পাখি ডানা ছটফটিয়ে ডাল বদল করে, আর আমি সেই অন্ধকারের ভেতর হাতড়াতে থাকি, ওকে আমার কী বলা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.