শিক্ষক প্রশিক্ষণে কেন এই অরাজকতা? by আমিরুল আলম খান

১৯৯৪ সালে ন্যাশনাল একাডেমি ফর এডুকেশনাল ম্যানেজমেন্টে (নায়েম) বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের জন্য ডাক পড়ে আমাদের। দুই মাসের (এখন চার মাসের) প্রশিক্ষণ। আমাদের আগে ২৭টি ব্যাচের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুরসিক মহাপরিচালক আমাদের বলে দিলেন, ‘তোমরা যারা এত দিন নিজেদের কুয়োর ব্যাঙের মতো মহাপণ্ডিত ভাবো, এ প্রশিক্ষণ তোমাদের সে ধারণা বদলে দেবে। স্পেশালিস্টের পরিবর্তে জেনারেলিস্ট (সবজান্তা) হবে তোমরা। এখানে অনুসরণ করা হবে বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ একাডেমির মডিউল।’ প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে। নায়েমে নিজস্ব লোকবল কম। তাঁদের কেউ শিক্ষাবিজ্ঞানে পারদর্শী নন। প্রতিদিন থাকতেন অতিথি বক্তা; সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা তাঁরা, জ্ঞানে-ভারে সেরা। তাঁরা বক্তৃতা করতেন, বিদেশভ্রমণের গল্প বলতেন, আমরা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হতাম। রাশি রাশি হ্যান্ডনোট পেতাম। সেগুলো নিয়ে সত্যিই আমরা পেরেশান। প্রতিদিনই শরীরচর্চা, ক্লাস, খেলাধুলা, পরীক্ষা, লাইব্রেরির কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট। এক্সকার্শন, রিপোর্ট লেখা, সেমিনার, বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মিলিয়ে এক হুলুস্থুল কাণ্ড। ট্রেনিং শেষে আমাদের ধরিয়ে দেওয়া হলো এক বান্ডেল বইও, কিন্তু শিক্ষাবিজ্ঞানের একটিও নয়। বাংলা একাডেমি উচ্চারণ অভিধান আর চাকরিবিধি ছাড়া আর কোনোটাই কোনো শিক্ষকের কাজে লাগে না। আমরা সত্যিই একেবারে বদলে গেলাম, ‘গোবেচারা মাস্টার’ থেকে ‘স্যুটেড-বুটেড অফিসার’! হয়তো সব কাজের কাজি ‘জাঁদরেল আমলা’ বানানোর কোশেশ ছিল। কিন্তু আমার মনে হলো, আমাদের অধঃপতন ঘটল ‘মাস্টার থেকে কেরানিতে’!
শিক্ষকদের ‘অফিসার’ বলে সম্বোধন করতে প্রথম শুনি যশোর শিক্ষা বোর্ডের এক সাবেক চেয়ারম্যানের মুখে, ১৯৮০–এর দশকে, শিক্ষকদের এক সমাবেশে। কানে বেজেছিল। তার প্রায় এক দশক পর নায়েমে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে এসে ‘মাস্টার থেকে অফিসার’ হওয়ার কসরত করতে!
নায়েমে কেন পিএটিসির মডিউল অনুসরণ করা হবে, এ প্রশ্নের জবাব পাইনি। শিক্ষা বিভাগে যাঁরা শিক্ষকতা করেন, তার খুব সামান্য অংশই প্রশাসনিক দায়িত্ব পান। চাকরিজীবনের বেশির ভাগ তাঁদের কাটে শিক্ষকতায়। সুতরাং ভালো শিক্ষক তৈরির একাডেমি হবে নায়েম, এটাই বোধ হয় অধিকতর প্রত্যাশিত ছিল। নায়েম নামকরণের আগ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে তা-ই হতো। এখন যে মডিউল অনুসৃত হয়, তাতে পেডাগজি নেই। তাই প্রাচীর পেরোলেই যে দেশসেরা ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ বা স্বল্পদূরত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, সেখানকার কোনো অভিজ্ঞ পেডাগগের সান্নিধ্য পাইনি আমরা।
বাংলাদেশে ভালো শিক্ষক তৈরির তেমন প্রতিষ্ঠান প্রায় নেই। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের জন্য ৬৬টি প্রাইমারি টিচার্স ইনস্টিটিউট (পিটিআই), ন্যাশনাল একাডেমি ফর প্রাইমারি এডুকেশন এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য ১৪টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে। কলেজশিক্ষকদের জন্য নায়েম আর পাঁচটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এইচএসটিটিআই) আছে। অধিকাংশ বেসরকারি ট্রেনিং কলেজের বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ।
কলেজ শিক্ষকদের ৮৯তম ব্যাচের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সমাপনী অনুষ্ঠান।
শিক্ষকেরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে এই শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় আরও ভালো করবে
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ব্যাচেলর অব এডুকেশন বা সমতুল্য ডিগ্রি থাকা বা পেডাগজি জানা আবশ্যকীয় শর্ত নয় বাংলাদেশে; শিক্ষায় অনার্স বা মাস্টার্স তো হনুজ দূর অস্ত! স্বাধীনতার এত বছর পরও জ্ঞান আহরণ (লার্নিং) ও জ্ঞান বিতরণ (টিচিং) যে সম্পূর্ণ আলাদা প্রক্রিয়া, তা যেন আমরা বিবেচনায় নিতে প্রস্তুত নই। সে কারণে নায়েমে পদায়নে পেডাগগ নয়, খোঁজা হয় প্রশাসক, শিক্ষাবিজ্ঞান ও শিক্ষাদানপদ্ধতির সঙ্গে যাদের পরিচয় নেই। তারা তাদের ‘জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার’ উজাড় করে দেন ‘জ্ঞানশূন্য-শিক্ষার্থী-পাত্রে’, শিক্ষাবিজ্ঞান যাকে বলে ‘জগ-মগ তত্ত্ব’। সেখানে কেবল সক্রিয় থাকেন ‘অসীম জ্ঞানের অধিকারী শিক্ষক’। আর ‘জ্ঞানশূন্য-শিক্ষার্থী’ থাকে নীরব, নিষ্ক্রিয়। ফলে অংশগ্রহণমূলক, সৃষ্টিশীল, আনন্দদায়ক হওয়ার পরিবর্তে শিক্ষা হয় একঘেয়ে, নিরানন্দ, ক্লান্তিকর এক দুঃস্বপ্ন।
একজন সাধারণ শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষাবিজ্ঞানে পারদর্শী (পেডাগগ) শিক্ষকের বহু পার্থক্য। সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, সাধারণ শিক্ষক স্বীকারই করেন না যে শিক্ষার্থী শিক্ষকের বাইরে অন্য অনেক সূত্র থেকেই প্রতিনিয়ত শেখে এবং সে অসীম সৃষ্টিশীলতার অধিকারী। প্রথমেই শিক্ষার্থীর সেই স্বীকৃতি দেন একজন পেডাগগ। ফলে শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে তৈরি হয় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়ায় যা আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত। শুধু বক্তৃতা পদ্ধতির পরিবর্তে তিনি আরও নানা আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন, ব্যবহার করেন শিক্ষা উপকরণ, প্রযুক্তি, সাধারণ শিক্ষকের যা অজানা। তাই একজন পেডাগগ যেখানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে সক্রিয় করে তোলেন, সাধারণ শিক্ষকের পক্ষে তা সম্ভব হয় না।
ক্লাসরুমে নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী পরীক্ষার ফুলসেরাত পার হতে ছোটে প্রাইভেট টিউটরের কাছে অথবা কোচিং সেন্টারে। সেখানে তারা নোট গেলে, মুখস্থ করে বিদ্যা! যদিও ‘মুখস্থকে না বলার’ ঢোল পেটানো হয় উচ্চ নাদে।
অথচ এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। যে ব্রিটিশ শাসকদের আমরা ‘কেরানি বানানোর শিক্ষা’ চালু করার জন্য তুলাধোনা করি অহর্নিশ, অধিকৃত ভারতে তাঁরাই শিক্ষক প্রশিক্ষণের একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। উডের ডেচপাস (১৮৫৪), হান্টার শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে (১৮৮২) শিক্ষক প্রশিক্ষণের যেসব সুপারিশ করা হয়, তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাইমারি শিক্ষকদের জন্য নরমাল স্কুল আর মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য টিচার্স ট্রেনিং কলেজ।
বাংলাদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের পথিকৃৎ ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক প্রশিক্ষণ অনুষদই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অনুষদ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চারটি নরমাল স্কুল ও একটি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ (ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ) পূর্ব বাংলা ও আসাম অঞ্চলের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পালন করত। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৬টি পিটিআই, ১৪টি সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, পাঁচটি এইচএসটিটিআই ও নায়েম শিক্ষকদের ট্রেনিং দেয়। অনেক বেসরকারি ট্রেনিং কলেজ থাকলেও তাদের নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
এইচএসটিটিআইগুলোয় পেডাগগ নেই, যদিও আইনে আছে। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে আগে শুধু পেডাগগ নিয়োগ দেওয়া হতো, নয়তো নিয়োগের পর তাদের দেশে-বিদেশে ট্রেনিং দিয়ে পেডাগগ বানানো হতো। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে ডাইরেক্টর (ট্রেনিং) পদে সাধারণত নিয়োগ পেতেন ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অভিজ্ঞ পেডাগগ অধ্যক্ষ, নয়তো নিয়ার–এর পরিচালক। ফেরদাউস খান, ওসমান গনি, আবদুল্লাহ আল-মুতী শরফুদ্দীন, গিয়াস উদ্দিন আহমেদ, গোলাম রসুল মিয়া প্রমুখ এই পদে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। ২০০৫ সালে ডাইরেক্টর (ট্রেনিং) পদে প্রথম একজন নন-পেডাগগ নিয়োগ পান। তার পর থেকে নন-পেডাগগ দিয়ে সরকারি ট্রেনিং কলেজগুলোও ভরে ফেলা হয়েছে। শীর্ষ পদগুলো তো বটেই, অধস্তন পদেও এখন তাঁদের রমরমা। কেরানিগিরি আর বেতন নেওয়া ছাড়া নাকি আর কোনো কাজ নেই তাঁদের। ফলে শিক্ষক প্রশিক্ষণে নিদারুণ অবনতি ঘটেছে। পেডাগগদের পদোন্নতি আটকে গেছে বছরের পর বছর। অনেককে অবসরে যেতে হচ্ছে পদোন্নতিবঞ্চিত অবস্থায়। কার লাভ হয়েছে জানি না, কিন্তু অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে দেশের। ভালো শিক্ষক তৈরির প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে গেছে। উত্তম শিক্ষক ব্যতিরেকে বিশ্বায়নের এই যুগে আমরা বৈশ্বিক মানসম্পন্ন জ্ঞানী, দক্ষ জনসম্পদ গড়ে তুলব কী করে?
বাংলাদেশ এখন এক বিপুলসংখ্যক তরুণে (চার কোটি ৭৬ লাখ, মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ) ভরপুর। তাঁদের বয়স ১০ থেকে ২৪ বছর। তাঁদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর এবং সুস্বাস্থ্য, সঠিক কাজের দিশা আর সুশাসন নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর উন্নত একটি দেশ। সুতরাং এখনই নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত শিক্ষা; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে তাঁদের। শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান চরম অরাজকতা দূর না করে যা সম্ভব নয় কোনোক্রমেই।
ভালো শিক্ষক পেতে তাই শিক্ষক প্রশিক্ষণে পেডাগজিসমৃদ্ধ নতুন মডিউল তৈরি এবং সব টিটিসি, এইচএসটিটিআই ও নায়েমে পেডাগগ নিয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সঙ্গে পরিচালক (প্রশিক্ষণ) পদেও।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
amirulkhan7@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.