মোহাম্মদপুরের এসি রাজিব ক্লোজের নেপথ্যে by নুরুজ্জামান লাবু

বয়সে কিশোরী। আইন অনুযায়ী এখনও সাবালিকা নয়। এমন এক কিশোরীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। নিজের সরকারি ও ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দিয়ে অসংখ্যবার কথা বলেছেন তার সঙ্গে। গত ১লা ফেব্রুয়ারি সেই কিশোরীকে ভাগিয়ে আনেন তিনি। রাখেন নিজের হেফাজতে।
পরিবারের সদস্যরা নিখোঁজ মেয়ের সন্ধানে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। র‌্যাবের কাছে অভিযোগ করেন অপহরণের। কিন্তু র‌্যাব-পুলিশ কেউ তাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেনি। শেষে পরিবারের সদস্যরা নিজেদের উদ্যোগেই জানতে পারেন মেয়ের সঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তার পরকীয়া চলছিল। সেই পুলিশ কর্মকর্তাই তাদের মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছেন। দুই বছর ধরে তাদের সম্পর্ক চলে আসছিল। আলোচিত এই পুলিশ কর্মকর্তার নাম শেখ রাজীবুল হাসান। তিনি ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২রা এপ্রিল তাকে ক্লোজ করে ডিসি তেজগাঁওয়ের কার্যালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপকমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, কমিশনারের নির্দেশে এসি রাজীবকে ক্লোজ করা হয়েছে। ব্যক্তিগত বিষয়ের জের ধরে তাকে ক্লোজ করা হয়েছে। কিন্তু এবিষয়ে কেউ লিখিত কোনও অভিযোগ করেনি।
পুলিশ ও পরিবারের সদস্যরা জানান, গত ১লা ফেব্রুয়ারি বিকাল ৩টার দিকে ১৭ বছর বয়সী সুমাইয়া নিখোঁজ হয়। ওই দিনই বড় ভাই আবদুল বাছেদ বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং-৫৬) করেন। একদিন পর র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক বরাবর তার বোনকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে একটি অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগ নম্বর ৪২। ওই অভিযোগে বলা হয়, ১লা ফেব্রুয়ারি তার ছোট বোনকে কাফরুলের বাসা থেকে বিকাল ৩টার দিকে নিচে যায়। এ সময় কে বা কারা একটি সিএনজিযোগে তুলে নিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা তাকে বাসায় দেখতে না পেয়ে বাসার সামনের রাস্তায় গিয়ে স্থানীয়দের মাধ্যমে অপহরণের বিষয়টি জানতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মেয়েকে হারিয়ে দিশাহারা পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে বাসায় মেয়ের একটি ব্যবহৃত মোবাইল সেট খুঁজে পায়। ওই মোবাইলে তারা মোহাম্মদুরের এসি রাজিবের নম্বরসহ ছবি ও একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার নম্বরও পায়। এতে তারা এসি রাজীবের সঙ্গে সম্পর্ক সন্দেহ করে। পরে তারা একাধিকবার রাজীবের সঙ্গে যোগযোগ করলেও এসি রাজীব বিষয়টি অস্বীকার করে। একপর্যায়ে স্বজনরা নিজেদের উদ্যোগে মোবাইলের কল রেকর্ড উদ্ধার করে। সেখানে দেখা যায়, নিখোঁজ হওয়ার আগের ১৫ দিনে এসি রাজীবের সরকারি নম্বর দিয়ে মেয়েটির সঙ্গে ৫২ বার কথা হয়েছে। এমনকি নিখোঁজের পরেও এসি রাজীবের সরকারি নম্বর দিয়ে দু’বার ওই কিশোরীর সঙ্গে কথোপকথনের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া অপর একটি মোবাইল নম্বরে নিখোঁজ হওয়ার আগের ১৫ দিনে ৪৪৭ বার কথা হয়েছে। স্বজনরা ধারণা করছেন, এই নম্বরটি এসি রাজীবের ব্যক্তিগত নম্বর। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মোহাম্মদপুর থানার টিএন্ডটি নম্বরেও একাধিকবার কথোপকথনের রেকর্ডও রয়েছে।
স্বজন সূত্র জানায়, দুই বছর আগে এক তরুণীর মাধ্যমে এসি রাজীবের সঙ্গে এই কিশোরীর পরিচয়। এরপর দিনরাতের বিভিন্ন সময়ে তাদের মধ্যে কথা হতো। এই সময়ে তারা ফার্মগেটের একটি হোটেলে অসংখ্যবার মিলিত হন। একপর্যায়ে কিশোরী রাজীবকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু রাজীব তালবাহানা করতে থাকে। বিয়ে না করলে কিশোরী ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নালিশ ও আত্মহত্যা করবে বলে হুমকিও দেয়। এদিকে পরিবারের সদস্যরা কিশোরীকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। হঠাৎ করেই গত ১লা ফেব্রুয়ারি কিশোরী সুমাইয়া নিখোঁজ হয়ে যায়। ওই কিশোরীর এক বান্ধবী জানায়, এসি রাজীব ও মেয়েটির সঙ্গে কনফারেন্সের মাধ্যমে একাধিকবার কথা হয়েছে। মেয়েটি তাকে রাজীবের সঙ্গে ‘গভীর সম্পর্কের’ কথা জানিয়েছে।
পরিবারের ওপর চাপ: আলোচিত এই ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর কিশোরীর পরিবারকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করারও অভিযোগ উঠেছে। একদিকে পুলিশ কর্মকর্তার চাপ ও আরেকদিকে সামাজিক সম্মান হারানোর ভয়ে পরিবারটি আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। ঘটনাটি নিয়ে তারা র‌্যাব-পুলিশের দ্বারস্থ হতেও ভয় পাচ্ছে। তবে ঘটনার পরপরই বিষয়টি তাদের এক স্বজনের মাধ্যমে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াকে অবহিত করা হয়। ডিএমপি কমিশনার তার স্টাফ অফিসারকে দিয়ে বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখার মৌখিক নির্দেশনা দেন। নিখোঁজ তরুণীর মোবাইরের কল রেকর্ডসে এসি রাজীবের সরকারি নম্বর দিয়ে অসংখ্যবার কথপোকথনের প্রমাণ পেয়ে ২রা এপ্রিল তাকে মোহাম্মদপুর জোন থেকে ক্লোজ করে ডিসি তেজগাঁওয়ের অফিসে সংযুক্ত করা হয়। স্বজনরা জানিয়েছেন, তারা প্রথমে যখন থানায় জিডি করেন তখন পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ যার বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ, তিনি পুলিশের বড় কর্মকর্তা হওয়ায় পুলিশ ওই অভিযোগ আমলে নেয়নি। সাধারণ ডায়েরিটি রেকর্ড করেই পুলিশ তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। তার বোনকে খুঁজে বের করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়েও অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কয়েকদফা দেখা করেছেন। তবে ওই পুলিশ কর্মকর্তা পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। কিশোরীর ভাই আবদুল বাছেদ কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের জানান, ‘তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা, তার বিরুদ্ধে থানায় বা কোথাও অভিযোগ করে কোন সহযোগিতা পাইনি।’
ফিরে আসা নিয়েও রহস্য: সূত্র জানায়, নিখোঁজ হওয়া কিশোরীর কল রেকর্ডস খতিয়ে দেখা গেছে গত ৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি লালামাটিয়া এলাকায় অবস্থান করছেন। তবে তার পরিবারের সদস্যরা আরো দু’দিন আগেই কিশোরী বাসায় ফিরেছে বলে জানান। বর্তমানে অবস্থান করছেন তার বড়বোনের বাসায়। গত সোমবার ওই কিশোরীকে কাফরুল থানায়ও নেয়া হয়। কাফরুল থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম তার কাছ থেকে একটি লিখিত নেন। নিখোঁজ ও অপহরণের অভিযোগ ওঠা কিশোরী ফিরে আসার পর তাকে আদালতে সোপর্দ না করার কারণ জানতে চাইলে কাফরুল থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, কিশোরী স্বেচ্ছায় গিয়েছে এবং স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছে বলে লিখিত দিয়েছে। একারণে তাকে আদালতে তোলা হয়নি। স্থানীয় সূত্র জানায়, কিশোরীর পরিবারটি এলাকার সহজ-সরল পরিবার বলে পরিচিত। একারণে পুলিশ কর্মকর্তার চাপে তার তটস্থ হয়ে রয়েছে। ভয়ে তারা পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও করছেন না। কিশোরীকেও সেভাবেই বোঝানো হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.