গণতন্ত্র না ‘রক্ষা’ পেল, না ‘উদ্ধার’ হলো by এ কে এম জাকারিয়া

গণতন্ত্র ‘রক্ষা’ বা ‘উদ্ধারের’ লড়াই বাংলাদেশের জন্য মনে হয় এমন এক লড়াই, যা কখনো শেষ হওয়ার নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করতে হয়েছিল গণতন্ত্র ‘রক্ষার’ জন্য। একতরফা সেই নির্বাচন গণতন্ত্রকে কতটুকু রক্ষা করতে পেরেছে, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে পারে। তবে ওই নির্বাচন গণতন্ত্রকে যে অসুস্থ করেছে, তা অস্বীকার কারার উপায় নেই। সেই নির্বাচনের বছর খানেকের মাথায়ই দরকার হয়ে পড়ল গণতন্ত্র ‘উদ্ধার’ আন্দোলনের। বিএনপি ও ২০-দলীয় জোটের এই গণতন্ত্র ‘উদ্ধারের’ আন্দোলনে নাশকতা ও বর্বরতার চূড়ান্তই ঘটল। তিন মাস পর এর ফলাফলকে এখন শূন্য বলেই মানতে হচ্ছে। মানে, গণতন্ত্র ‘উদ্ধারের’ আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের গণতন্ত্র ‘রক্ষার’ কী হলো? ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন যদি গণতন্ত্রকে অসুস্থ করে থাকে, তবে বিরোধীদের ওপর আওয়ামী লীগ ও তাদের সরকারের দমন-নিপীড়ন তো গণতন্ত্রকে মুমূর্ষু দশায় নিয়ে গেল!
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, এর এক বছরের মাথায় বিএনপির নেতৃত্বে নজিরবিহীন লাগাতার আন্দোলন, আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নাশকতা ও বর্বরতা চালানো এবং সেই আন্দোলনের ব্যর্থতার পর এখন নানা হিসাব-নিকাশ চলছে। বিএনপির ব্যর্থতাকে আওয়ামী লীগের বিজয় হিসেবে দেখে এমন লোকের অভাব নেই। কিন্তু যে গণতন্ত্রের জন্য এত কিছু, সেই গণতন্ত্রের আদৌ কোনো বিজয় হলো কি?
বাংলাদেশের মতো দেশে গণতন্ত্র উদ্ধারের আন্দোলনের সূচনা ঘটে সাধারণত রাজপথে, আন্দোলনকারীদের প্রাণ দেওয়ার নজিরই বেশি, এসব ‘আত্মত্যাগ’ কখনো কখনো আন্দোলনকে জোরালো করে।
এবার বিএনপির আন্দোলনের কৌশল ছিল বলা যায় উল্টো। সরকারের দমন-নিপীড়নের মুখে তারা যেকোনোভাবে রাস্তায় নামার চেয়ে পালিয়ে থেকে নাশকতা চালানোর কৌশল নেয়। পেট্রলবোমা হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র এবং এর শিকারে পরিণত হয় সাধারণ জনগণ। মাস তিনেকের আন্দোলনে পেট্রলবোমায় পুড়েই মারা গেছে ৭৫ জন। পুড়ে গিয়েও বেঁচে আছে এবং বাকি জীবন এর যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ২০০। আন্দোলনের নামে এই মাত্রার বর্বরতা বাংলাদেশে আগে কখনো ঘটেনি। সাধারণ নাগরিকদের শিকারে পরিণত করা বা তাদের ওপর বর্বরতা চালানোর কৌশল সাধারণত বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও জঙ্গি সংগঠনই নিয়ে থাকে। বিএনপির আন্দোলনে এবার তার নজির দেখা গেল।
বিএনপির এই গণতন্ত্র ‘উদ্ধারের’ আন্দোলনকে তাই কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বলা যাচ্ছে না। আর এ ধরনের আন্দোলন করে কখনো গণতন্ত্র উদ্ধার করাও সম্ভব নয়। বিএনপির এবারের আন্দোলনের এই ভয়ংকর কৌশল শুধু তাদের আন্দোলনকেই ব্যর্থ করেনি, বরং ভবিষ্যতে গণতন্ত্র উদ্ধারের যেকোনো আন্দোলন বা গণ-আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরিতেও নেতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
তবে বিএনপির এবারের গণতন্ত্র ‘উদ্ধার’ আন্দোলনের ক্ষেত্র তৈরি করেছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। এ ধরনের নজিরবিহীন নির্বাচনের মুখোমুখি দেশবাসী আগে কখনো হয়নি। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগ বা তাদের জোট এই নির্বাচন করেছে গণতন্ত্র রক্ষার নামে।
এ ধরনের একতরফা নির্বাচন দেশে একটি বিকৃত ও অসুস্থ গণতন্ত্রের পরিস্থিতি তৈরি করে। আমরা দেখলাম, এমন একটি ‘নিয়ম রক্ষার’ নির্বাচনের পর রাজনৈতিক সমঝোতার পথ না ধরে সরকার আস্তে আস্তে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠার কৌশল বা নীতি নেয়। গণতান্ত্রিক আচরণের সামান্য ছিটেফোঁটা দেখাতেও সরকার সম্ভবত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে মোকাবিলায় রাজনৈতিক পথ ধরার চেয়ে দমন-নিপীড়ন এবং এসব কাজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু করে। আইনের শাসন বা মানবাধিকার—গণতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব বিষয় যেন দেশে স্থগিত হয়ে যায়। বিএনপির এই মাস তিনেকের আন্দোলনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছে ৩৩ জন। নিখোঁজ বা গুমের হিসাবটি আসলে কত, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া একতরফা নির্বাচন, বিরোধী দলের প্রায় সব বড় নেতাকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা, সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়া, বিএনপির প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ করা, বিএনপির চেয়ারপারসনকে তাঁর কার্যালয়ে আটকে রাখা (পুরো তিন মাস না হলেও অন্তত প্রথম কিছুদিন), বিরোধী নেতা-কর্মীদের বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়া বা বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দলের প্রধান মুখপাত্রের মতো নেতা সালাহ উদ্দিন আহমদের গায়েব হয়ে যাওয়া—সুস্থ গণতন্ত্রে কখনো এসব ঘটনা ঘটতে পারে না। যেসব দেশে এমন ঘটনা ঘটে, সেগুলো গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পায় না। আর গুম বা বিরোধী রাজনীতিকদের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা তো সেই ষাট, সত্তর ও আশির দশকে ‘ডার্টি ওয়ারের’ সময় আর্জেন্টিনায় বা ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ঘটেছে স্বৈরশাসকদের শাসনে। সংখ্যা বা মাত্রার দিক দিয়ে সেই পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের গুম বা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি হয়তো তুলনা করা কঠিন। তবে এটাও ঠিক যে এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনা বা মানবাধিকার লঙ্ঘন সংখ্যার হিসাবে বিবেচনার বিষয় নয়। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের কেউ কেউ নিখোঁজ, গায়েব বা গুম হয়ে গেছেন এবং তাঁদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না—এই তথ্যটি বাংলাদেশ ও এর গণতন্ত্র সম্পর্কে কী ধারণা তুলে ধরে বিশ্ববাসীর সামনে?
‘বন্দুকযুদ্ধে’ বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মারা যাওয়া অথবা গুম বা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার যে ধারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা গেল, সেটা গণতন্ত্রের পেছনযাত্রারই ইঙ্গিত দেয়। আর্জেন্টিনা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের গুম ও অপহরণের ঘটনাগুলোর যখন তদন্ত হচ্ছে, বিচার হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনীতির সূচনাকে আমরা কীভাবে দেখব? গণতন্ত্র রক্ষার নামে আওয়ামী লীগ সরকার যা করল বা করে যাচ্ছে, সেটা গণতন্ত্রের জন্য একটি চরম মন্দ নজির হয়েই থাকবে। ভবিষ্যতে যদি অন্য কোনো সরকার গণতন্ত্র রক্ষায় একই পথ ধরে, তবে গণতন্ত্রের বর্তমান মুমূর্ষু দশা থেকে এর দমটি বের হয়ে যাওয়ার কাজটিই সারা হবে।
এটা পরিষ্কার যে গণতন্ত্র ‘উদ্ধার’ বা ‘রক্ষার’ কাজে দুই পক্ষই ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপির ব্যর্থতা মানে তাই আওয়ামী লীগের বিজয় নয়। গত তিন মাসে চূড়ান্তভাবে যা পরাজিত হলো, তা হচ্ছে গণতন্ত্র। আন্দোলন এবং এই সময়ের ক্ষয়ক্ষতির নানা তথ্য-উপাত্ত ও হিসাব–নিকাশ বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রাণহানির হিসাব আছে, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাবও আছে। অর্থনীতির ক্ষতি হয়তো দেশটি কোনোভাবে বা কখনো না কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবে, কিন্তু আগুনে পুড়ে, বন্দুকযুদ্ধে বা সহিংসতায় প্রাণ গেল যে ১৩১ জনের, বা যাঁরা নিখোঁজ হিসেবেই থেকে যাবেন, সেই ক্ষতি পূরণ হবে কীভাবে? গণতন্ত্রের জন্য দুনিয়ায় যুগে যুগে অনেক আত্মত্যাগ হয়েছে, অনেক প্রাণ গেছে, বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে ঘটেছে। কিন্তু গণতন্ত্রকে উদ্ধার ও রক্ষা করার যে রাজনীতিতে গণতন্ত্র পরাজিত হলো, এর দশা আরও মুমূর্ষু হলো, সেখানে এতগুলো মৃত্যুকে কীভাবে জায়েজ করা যাবে?
বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া, অফিস থেকে তাঁর বাড়ি ফিরে যাওয়া, তিন সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে দলটির ইতিবাচক অবস্থানকে অনেকেই স্বস্তি হিসেবে দেখছেন। গত তিন মাসে যা ঘটেছে, সে তুলনায় এটা স্বস্তিই বটে! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ছাড়া বিএনপি বা ২০-দলীয় জোট কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ কর্মসূচি এখনো উঠিয়ে নেয়নি। এই স্বস্তি আসলে কত দিনের? দুই পক্ষের একধরনের ‘নমনীয়’ অবস্থান বা ‘সমঝোতার’ পরিণতি কী? আগুনে পুড়ে যারা মারা গেল বা সারা জীবন পোড়ার কষ্ট বয়ে বেড়াবে, তারা কি বিচার পাবে? এসব ঘটনায় যে মামলাগুলো হয়েছে, তার একটিরও কি বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত শেষে বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত হবে? বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাগুলোর কী তদন্ত হবে? সালাহ উদ্দিন আহমদ কি ফিরে আসবেন বা তাঁর খোঁজ পাওয়া যাবে? সরকার কি এর জন্য জবাবদিহি করবে?
গণতন্ত্রের আশা যদি আমরা এখনো ধরে রাখতে চাই, গণতন্ত্রকেই যদি চূড়ান্ত মানি, তবে এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.