‘ফেনসিডিল রাখতো সার্কিট হাউজে, বহন করা হতো জেলা প্রশাসনের গাড়িতে’ by ওয়েছ খছরু

ফেনসিডিল রাখা হতো সার্কিট হাউজে। জেলা প্রশাসনের জিপে আনা-নেয়া হতো। এভাবেই মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সিলেটের জেলা প্রশাসনের গাড়িচালক রুমন মিয়া। প্রশাসনের গাড়ি হওয়ায় র‌্যাব কিংবা পুলিশের ঝক্কি-ঝামেলা ছিল না। আর সার্কিট হাউজে মাদক রাখায় ছিল না কোন অভিযানের ভয়ও। এই সুযোগে সিলেটে মাদক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিল রুমন মিয়া। ধীরে ধীরে রুমন হয়ে ওঠে সিলেটের একজন শীর্ষ মাদক বিক্রেতা। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে র‌্যাব তৈরি করে ফাঁদ। অনুসন্ধান চালানো  হয় রুমনের কর্মকাণ্ড নিয়ে। এতে প্রশাসনের কারও হাত আছে কি না তার খোঁজখবর  নেয়া শুরু করে র‌্যাব। এসব বিষয়ে খেলাসা হওয়ার পর চালায় অভিযান। গ্রেপ্তার করা হয় রুমনকে। তার কাছে  থেকে উদ্ধার করা হয় ১৯৩ বোতল ফেনসিডিলসহ ২৭৫ বোতল মাদক। ঘটনাটি সিলেটের। নববর্ষের দিন রাত ৯টায় র‌্যাব কর্মকর্তারা জেলা প্রশাসনের একটি গাড়িসহ চালক রুমনকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর রাত সাড়ে ১০টায় তাকে সাংবাদিকদের মুখোমুখি করেন। গতকাল র‌্যাব-৯ এর পক্ষ থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে রুমনকে মাদক ব্যবসায়ী  উল্লেখ করা হয়। তবে রাত সাড়ে ১০টায় র‌্যাব কার্যালয়ে গ্রেপ্তারকৃত রুমন জানায় সবকিছু। তার মুখ থেকেই জানা গেছে সে জেলা প্রশাসনের গাড়িচালক। তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার হরিতলা গ্রামে। পিতা মো. ইব্রাহিম মিয়া। বর্তমান ঠিকানা সিলেটের জেলা প্রশাসকের স্টাফ কোয়ার্টার্স। র‌্যাব-৯ এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, পহেলা বৈশাখের নিরাপত্তা জোরদার করতে সন্ধ্যার পর থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় টহল জোরদার করা হয়। এ সময় তাদের কাছে খবর আসে সরকারি গাড়িতে করেই আসছে মাদকের চালান। ওই খবরের ভিত্তিতে তারা নগরীর বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসায়। শুরু করে তল্লাশি। নগরীর শিবগঞ্জ এলাকার উত্তর বাজারের আধিত্যপাড়াস্থ শাকিল কমিউনিটি সেন্টারের সামনে র‌্যাব একটি চেকপোস্ট বসায়। জেলা প্রশাসনের ডিসি পুলের পাজেরো জিপ (নং সিলেট-ঘ-১১-০২৫৭) নিয়ে যায় চালক রুমন। র‌্যাব সদস্যরা এ সময় গাড়ি গতিরোধ করে তল্লাশি করেন। একপর্যায় গাড়ির পেছনে রাখা ১৯৩ বোতল ফেনসিডিল ও ১৮২ বোতল জেনোসিডিল উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে জেলা প্রশাসনের কর্মচারী রুমন মিয়াকে। তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৯ এর ইসলামপুরস্থ কার্যালয়ে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ১০টায় র‌্যাব সদস্যরা তাকে নিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন। এ সময় রুমন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে। রুমন জানায়, সীমান্ত থেকে সড়ক পথে তার কাছে ফেনসিডিল ও জেনোসিডিলের চালান আসে। সেগুলো সিলেট নগরীতেই রিসিভ করা হয়। এরপর সে এগুলো সিলেট সার্কিট হাউজে নিয়ে রাখে। সার্কিট হাউজের পেছনের দিকে ঘাসের ঝোপ রয়েছে। নিরিবিলি এলাকা হওয়ায় ওই জায়গায় কেউ যায় না। রুমন আরও জানায়, গত বছর ধরে সে এভাবে ব্যবসা করছে। জেলা প্রশাসনের ডিসি পুলের যে গাড়ি সে চালাতো সেটি মাদক পাচারে ব্যবহার করেছে। পহেলা বৈশাখে সে ওই গাড়িতে ২৭৫ বোতল ফেনসিডিল ও জেনোসিডিল তুলে। এরপর রুমন ওই গাড়ি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন কাজে যাতায়াত করেছে। রাতে সিলেটের জেলা প্রশাসকের স্ত্রীকেও সে ওই গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয়। রুমন জানায়, পাজেরোটি মেরামতের কথা বলে সে প্রায়ই শিবগঞ্জের একটি গ্যারেজে আসতো। এতে করে প্রশাসনের কেউ কোন বাধা দিতেন না। নববর্ষের রাতেও সে গাড়িটি গ্যারেজে নিয়ে যাচ্ছে বলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জানিয়েছিল। গ্রেপ্তারের পর র‌্যাবের কাছেও রুমন তার মাদক ব্যবসার নেটওয়ার্ক সম্পর্কে বলেছে। নগরীর উপশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় সে মাদক বিক্রি করতো। প্রশাসনের গাড়ি করে মাদক আনার কারণে কখনোই পুলিশ তার গাড়িতে তল্লাশি চালায়নি। রুমনকে এক নামেই চিনতেন সিলেটের উপশহর ও আশপাশ এলাকায় ফেনসিডিল সেবকরা। ওখানে একটি গাড়ির গ্যারেজকে কেন্দ্র করে মাদকের হাট বসেছিল। ওই গ্যারেজে পুলিশের কয়েকজন কনস্টেবল ও সহকারী সাব ইন্সপেক্টরের চোখে ধরা পড়লেও তারা বিভিন্ন সময় এড়িয়ে গেছেন। এদিকে, র‌্যাব-৯ এর অধিনায়কের পক্ষে এএসপি সহকারী পরিচালক মিডিয়া পংকজ কুমার দে গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানান, রুমনকে ও উদ্ধার করা মাদক সিলেটের হজরত শাহপরান (রহ.) থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ব্যাপারে থানায় মামলা হয়েছে। এদিকে, রুমন গ্রেপ্তারের বিষয়টি সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামের কাছে পৌঁছালে রাতেই তিনি রুমনকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, ‘ওর চাকরি থাকবে না। সে ডিসি পুলের গাড়িতে ফেনসিডিল বহন করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। পাশাপাশি আর কেউ এসব ঘটনায় জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আগেও আটক হয়েছিল রুমন: ফেনসিডিল ও জেনোসিডিলের চালান নিয়ে আটকের আগেও তিনবার আটক হয়েছিল রুমন মিয়া। এমন তথ্য জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মচারী। জেলা প্রশাসনের গাড়িচালকের চাকরি পাওয়ার আগে তার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের কর্মচারীদের সঙ্গে শখ্য ছিল। প্রায় আড়াই বছর আগেও সে মদ নিয়ে আটক হয়েছিল। পরে আরও দুবার সে আটক হয়। ওই সময় তাকে পুলিশ আটক করলেও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের তদবিরে রক্ষা পায়। রুমন গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তার বেপরোয়া জীবনের নানা কাহিনী খোদ প্রশাসনের কর্মচারীদের মুখে মুখে। রুমন নিজেও প্রায় সময় ‘ড্রাগ এডিক্টেড’ থাকতো বলে জানিয়েছেন অনেকেই।

No comments

Powered by Blogger.