শূন্য হৃদয়ে হাহাকার by শামীমুল হক

প্রাণ দিয়ে অভিজিৎ রায় বুঝিয়ে গেলেন বাকস্বাধীনতা শুধু কথার কথা। কেউ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারে না। টুঁটি চেপে ধরা হয়। অভিজিৎ ব্লগে লিখে তার মতামত প্রকাশ করতেন। বই লিখে তা সবাইকে জানান দিতেন। এটাই ছিল তার অপরাধ। তিনি কোন দল বা গোষ্ঠীর ছিলেন না। তিনি কাউকে পরোয়াও করতেন না। করতেন না বলেই একাধিকবার হুমকি আসার পরও তিনি ভীতু কাপুরুষের মতো পালিয়ে থাকেন নি। নিজেকে গুটিয়ে নেননি। বরং তিনি বাস্তব চিত্র লিখে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সঙ্গে সবাইকে এটাও জানিয়ে দিয়েছেন কোন কিছুতেই তাকে দমানো যাবে না। সত্যিই তাকে দমানো যায়নি। যখন যা বলার তীর্যক ভাষায় জবাব দিয়েছেন। কে খুশি হলো কিংবা কে অখুশি তাতে তার কিছু যায় আসেনি। শুধু তাই নয়, তিনি দেশের জন্য, মানুষের জন্য ভাবতেন নিরন্তর। তার প্রমাণ পাওয়া যায় মৃত্যুর আগে তার দেহ দান করে যাওয়ার ঘটনায়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা তার দেহ নিয়ে গবেষণা করবেন। আর এ গবেষণায় একেকজন শিক্ষার্থী হয়ে উঠবেন ডাক্তার। যারা দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দেবেন। রোগীকে পরম মমতায় আগলে ধরবেন। কে জানত যে মেডিক্যাল কলেজে তিনি দেহ দান করেছেন সেই মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তাররাই তাকে মৃত বলে ঘোষণা দেবেন। যে আততায়ীরা তাকে কুপিয়েছে তারা মানুষ নয়, মানুষ নামের অমানুষ। এ হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। প্রতিবাদ জানাই। একই সঙ্গে সবার মতো আমারও প্রশ্ন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এমন নিরাপত্তায় ঘেরা জায়গায় কিভাবে হত্যাকারীরা অভিজিৎকে কুপিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেল? ঘটনার সময় তার স্ত্রী বন্যা বাঁচাতে গিয়েছিলেন। দুর্বৃত্তরা তাকেও রেহাই দেয়নি। কুপিয়েছে। বন্যাও আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন। শুধু অভিজিৎ কেন? এ পর্যন্ত এই ক্যাম্পাসেই ড. হুমায়ুন আজাদসহ অনেককে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। কিন্তু কোন হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন হয়নি আজও। অভিজিৎ খুন নিয়ে ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে। উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইইউ। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ চাইলে তদন্তে সহায়তা দিতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র। যত উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাই বিশ্বজুড়ে হউক না কেন, অভিজিৎ কি আর ফিরে আসবে? অভিজিতের কন্যা কি তার পিতাকে ফিরে পাবে? বৃদ্ধ পিতা অজয় রায় কি তার সন্তান হারানোর ব্যথা ভুলতে পারবেন? না, না, না। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন। হত্যাকাণ্ডের সময় খুব কাছেই পুলিশ দাঁড়িয়েছিল। ঘটনা ঘটার পর পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এখন তদন্তের ভার পড়েছে ডিবির হাতে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অভিজিতের পিতাও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ঘটনার পর চারদিন অতিবাহিত হচ্ছে। পুলিশ এখনও কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। পারেনি কোন ক্লু উদ্ধার করতে। শুধু জঙ্গি গোষ্ঠী  আনসারুল্লাহ’র উপর দায় চাপিয়ে যেন তাদের দায় শেষ করতে চাইছেন। এভাবে পুলিশ কতদিন  অন্যের উপর দায় চাপিয়ে পার পাবে।
শামীমুল হক
তাদেরও যে দায় আছে এটা কে তাদের বলে দেবে? কোন কোন ক্ষেত্রেতো পুলিশ অতিরিক্ত দায় কাঁধে তুলে নেয়। লক্ষ্মীপুরের ঘটনাই ধরা যাক। সেখানে যুবদল নেতাকে না পেয়ে তার বৃদ্ধ মাকে ৫দিন থানায় আটকে রাখে পুলিশ। এটা কোন ধরনের মানবতা। এখানে মানবাধিকার কি লঙ্ঘিত হচ্ছে না? হবিগঞ্জের শহরতলির এক গ্রামের এক ছাত্রদল নেতার বাড়িতে রাত ১২টার পর গিয়ে পুলিশ হাজির। কিন্তু পুলিশ তাকে বাড়িতে না পেয়ে তার মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যায়। ছাত্রদল নেতার ভাবীকে তীর্যক ভাষায় বকাঝকা করে। শুধু তা নয়, ছাত্রদল নেতার ভাবীর  মোবাইল ফোনও নিয়ে যায়। সারা দেশ যেন এখন পুলিশি রাষ্ট্র হয়ে গেছে। পুলিশ আতঙ্ক সর্বত্র। সাধারণ মানুষও রাস্তায় চলতে গেলে পুলিশ আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে থাকেন। কখন আবার তাকে ধরে নিয়ে যায়। কখন আবার ঝামেলায় পড়তে হয়। পুলিশ জনগণের সেবক এটা এখন শুধু স্লোগানে সীমাবদ্ধ। এভাবে চলতে থাকলে একদিন পুলিশ নামক এ পেশাকে মানুষ মন থেকে শ্রদ্ধা করবে না। বিষয়টি নিয়ে এখনই না ভাবলে ভবিষ্যৎ খুবই ভয়ঙ্কর হবে। পুলিশ হয়ে ওঠবে জনগণের প্রতিপক্ষ। এর আগেই পুলিশে শুদ্ধি অভিযান চালানো দরকার। জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব তারা কিভাবে পালন করছে প্রত্যক্ষদর্শী যারা তারা ভালভাবেই টের পাচ্ছেন। এ থেকে জাতিকে দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। অন্যথায় অভিজিৎরা প্রকাশ্যে খুন হবে, আর পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখবে। এটাই হবে নিয়ম। এটাই হবে নিয়তি। তাহলে প্রশ্ন, পুলিশে কি ভাল মানুষ নেই। অবশ্যই আছে, তা হাতেগোনা। এসব ভাল মনের পুলিশরা কোণঠাসা হয়ে আছে। তারা কোন রকমে দিন গুজরান করছে। সাধারণ মানুষ জানে, প্রকাশ্যে ঘুষ খাওয়া একমাত্র পুলিশ বিভাগেই চলছে। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে ঘুষ নেয়া দেয়ায় রাখঢাক থাকলেও পুলিশ বিভাগে তা চলে ওপেন। যারা একবার পুলিশের খপ্পরে পড়েছেন তারাই এ ব্যাপারে ভাল জানেন। যাকগে সেসব কথা, অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডে পুলিশ অবশ্যই তদন্ত করবে মন প্রাণ দিয়ে। সত্যিকার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। অপরাধীরা শাস্তি পেলে অভিজিতের পরিবার একটু হলেও সান্ত্বনা পাবে। যতদিন না এর বিচার হবে ততদিন অভিজিতের স্বজনদের শূন্য হৃদয় হাহাকার করবে।

No comments

Powered by Blogger.