বৈশাখী মেলার গল্প; অকুস্থল রবীন্দ্র সরোবর

প্লাস্টিকের বাঁশি মুখে নিয়ে ছোট বড় সবার প্যাঁ পোঁ
হাতের ছাপ দিচ্ছে এক শিশু। ছবি: মানসুরা হোসাইন
সবার মনোযোগের চেষ্টা করছেন এক বিক্রেতা
শামীমের ব্যবসা আজ ভালোই ছিল। ছবি: মানসুরা হোসাইন
আবদুল বারেক আর হেলেনা। বিয়ে করেছেন চার বছর হলো। বারেক রিকশা চালান। হেলেনা গৃহিণী। ঘরসংসার গুছিয়ে রাখেন। আজ হেলেনা লাল টুকটুকে একটি সুতি শাড়ি পরেছেন। কানে দুল, ঠোঁটে লিপস্টিক।
দুজনে পাশাপাশি বসা। অনেক লোকের ভিড়েও আলতোভাবে স্বামীর ঊরুর ওপর একটি হাত দিয়ে বসে আছেন হেলেনা। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে আজ মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় এই দম্পতির সঙ্গে।
আবদুল বারেক হাসি হাসি মুখ করে বললেন, ‘আজকে পহেলা বৈশাখ। এই দিনে কী হয় জানি না। আমরা বেড়াইতে আসছি।’
হেলেনা বললেন, ‘সকালে শিশু পার্কে গেলাম। দোল খাইলাম।’ সারা দিনে আরও কী কী খেলেন, কী কী করলেন তার ফিরিস্তিও দিলেন হাসিমুখে।
রবীন্দ্র সরোবরে গতকাল সোমবার রাত থেকে আজ দুপুর পর্যন্ত বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এটিএন বাংলা, কোকাকোলাসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কনসার্টের আয়োজন করে। চুড়িমালা, মুড়িমুড়কি, ডুগডুগি, কাঁচা আম, পান সুপারি, হাওয়াই মিঠাইসহ হরেক পণ্য নিয়ে চলে বৈশাখী মেলার আয়োজন। এবার বেশির ভাগ তরুণের মাথায় ছিল গামছা। ভাবখানা এমন ছিল যে, ফ্যাশনও হলো আবার রোদ থেকেও বাঁচা গেল। আর তরুণীদের মাথায় ছিল ফুলের মালা।
বারেক ও হেলেনার মতো অনেকেই আজ নববর্ষ উদ্‌যাপনের জন্য সারা দিন নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, খেয়েছেন, বাঁশি-বেলুন কিনেছেন। চটপটি, ফুচকাও বাদ যায়নি। দুপুরের প্রচণ্ড গরমে একটু শান্তির পরশ পাওয়ার জন্য অনেকে ছুটে গেছেন তালপাখা, কাপড়ের হাতপাখা কিনতে।
নববর্ষ বা পয়লা বৈশাখ, যে নামেই ডাকা হোক বা যে উৎসবই হোক, দিনটিতে ব্যবসা হবে, এটুকুই জানেন অনেকে। বেতের তৈরি কুলা-ডালার ব্যবসাটিকে ‘সিজনাল’ ব্যবসা হিসেবে আখ্যা দিলেন মো. ইলিয়াস হোসেন। শুধু আজকের দিনের জন্যই এ ব্যবসা। অন্য সময় চলে অন্য ব্যবসা। নরসিংদী, বরিশালসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে এসব জিনিস সংগ্রহ করেছেন তিনি। তবে এবার তিনি হতাশ।
ইলিয়াস হোসেন জানালেন, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ২০ হাজার টাকারও জিনিস বিক্রি হয়নি। গত বছর এ সময় ৮০ হাজার টাকার বেশি বিক্রি করেন। ইলিয়াস বলেন, ‘এইবার লোকজন কম। লোকই নাই, কিনব কে? অন্যবার এইসময় এই জায়গায় খাড়াইতেই পারতেন না।’
চুড়িমালা বিক্রেতা নাছিমার কণ্ঠেও আক্ষেপ। তিনি বলেন, ‘বিক্রি নাই। সকাল থেইক্যা দুই হাজার টাকার মাল বেচছি।’
রবীন্দ্র সরোবরে শামীমের একচ্ছত্র আধিপত্য। সে এ এলাকাতেই প্রতিদিন থাকে। ধানমন্ডি এলাকায় বেশির ভাগ স্কুলের অভিভাবকদের কাছে সে পরিচিত। শামীমের হাত ও পা বাঁকা হয়ে ছোট হয়ে গেছে। তিন চাকার কাঠের তৈরি একটি জিনিস ঠেলে ঠেলে সে সামনে যায়, পেছনে যায়। শামীম জানে আজ পয়লা বৈশাখ। সকাল থেকে আয়রোজগারও খারাপ হয়নি। সকাল থেকে কত টাকা পেয়েছে জানতে চাইলে বলে, ‘গুইন্যা দেহি নাই।’
তবে বেশি ভিড় হলে শামীমের লাভের চেয়ে খানিকটা ক্ষতিই হয়। লোকজনের পায়ের সঙ্গে তার শরীর লেগে যায় বলে তাকে চুপচাপ একটি জায়গায় বসে থাকতে হয়।
সাভার থেকে বেদেনীদের একটি নারী দল রবীন্দ্র সরোবরে তাঁদের উপস্থিতির জানান দেন। সাজগোজ করা নারীর সামনে একজন বেদেনী বললেন, ‘ও বড়লোকের বেটি, কিছু দিয়া যাও।’ তবে সেই নারী সেদিকে তেমন একটা পাত্তা দিলেন না। একজন দিলেন না তো কী হয়েছে, তাই আবার আরেকজনের কাছে ছুট।
পরিবারের কয়েক মাস বয়সী সদস্যটিও রবীন্দ্র সরোবরে এসেছে লাল বা সাদা জামা পরে। মা-বাবা মুঠোফোনে সেলফি ও ছবি তুলতে ব্যস্ত। স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে এসেছেন একজন। ছবি তুলতে মেয়েটি রাজি হলেও ছেলেকে কিছুতেই রাজি করানো যাচ্ছিল না। ফলে সেই ভদ্রলোক রাগে লাল হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আজ বাসায় চলো, তারপর তোমার খবর আছে।’
বৈশাখী উত্তাপের পাশাপাশি রবীন্দ্র সরোবরের চারপাশে ধুলা উড়ছে। তার মধ্যে প্লাস্টিকের বাঁশির প্যাঁ পোঁ শব্দ। বউ, বাচ্চার মন রক্ষার জন্য যাঁরা এখানে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের গজগজ করতে দেখা গেল। অনেকে আবার শুধু পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে সব মেনেও নিচ্ছিলেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেক শিশু আইসক্রিমসহ অন্যান্য জিনিসের বায়না ধরে। বাবা কিনে দিতে রাজি হওয়ায় তাদের খুশি দেখে কে।
রবীন্দ্র সরোবরের আশপাশের রাস্তার মুখ বন্ধ। রবীন্দ্র সরোবর ছাড়িয়ে উৎসবের অনেক আয়োজন রাস্তায় চলছে। লাইফবয়ের পক্ষ থেকে ফুটপাতে বেসিন বসানো হয়েছে। সেখানে লাইফবয় হ্যান্ড ওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
বার্জার পেইন্ট সাদা কাপড় টানিয়ে দিয়েছে। তার সামনে বড় বড় ড্রামে রং গুলিয়ে রাখা। শিশুসহ একেকজন গিয়ে রঙে হাত চুবিয়ে সাদা কাপড়ে হাতের ছাপ দিচ্ছে। তার পাশেই একটি পোস্টারে লেখা আছে-হাতের ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে নির্দিষ্ট জায়গায় ট্যাগ করতে হবে। তারপর সর্বোচ্চ লাইক এবং শেয়ার অর্জনকারী ব্যক্তি পাবেন বিশেষ পুরস্কার। বিনা মূল্যে হাতে মেহেদি লাগানোসহ অন্যান্য আয়োজনও ছিল অনেক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে।
বাঙালির বৈশাখ উদ্‌যাপনে যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে তার জন্য র‍্যাব ও পুলিশের উপস্থিতিও ছিল রবীন্দ্র সরোবরে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এই সদস্যদের পোশাক ছাড়া সবার পোশাকেই ছিল বৈশাখী লাল-সাদার ছোঁয়া।
পুলিশের একজন কনস্টেবল সেলিনা বসে ছিলেন। ‘সবাই এত সাজগোজ করে মজা করছে, আর আপনারা তা করতে পারছেন না’ এইটুকু বলতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সেলিনা বলেন, ‘আমার দায়িত্ব পালন করতে খারাপ লাগছে না। আমার কাজই তো এইটা।’

No comments

Powered by Blogger.