বাংলা নববর্ষে প্রীতির রাখিবন্ধন by সনজিদা খাতুন

সনজিদা খাতুন
খ্রিস্টাব্দ নয়, হিজরি সন নয়, বাংলা অব্দের পহেলা বৈশাখ যখন বাঙালির আবিষ্কারের অঙ্গ হিসেবে উৎসব হয়ে উঠতে চাইছে তখন পাকিস্তানের বড় রমরমা সময়। ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের উদ্বোধন হয়েছিল ইংরেজি ১৯৬৩ সালে। বাংলা ১৩৭০- এর পহেলা বৈশাখে। ঘরে তৈরি দেশী খাবারের সঙ্গে নল দিয়ে ডাবের পানিতে চুমুক দেয়ার ব্যবস্থা ছিল সেদিন। এর আগেও নগরে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করা হয়েছে ঘরোয়া আসর করে। নাসির ভাইয়ের বাড়িতে, মাক্কীর বাড়িতে অপরূপ পুষ্পসজ্জার পরিবেশে গান গেয়ে আনন্দে প্রাণ ভরেছে। আব্বাসউদ্দীন সাহেবের বাড়িতেও পহেলা বৈশাখে গান-বাজনা হতো, মনে আছে। এরকমের আসরেই কি একবার ধীর আলী ভাইয়ের (বংশীবাদক) ছোট ভাই নবীন বেহালাবাদক মনসুর আলীকে সঙ্গীতরসিক সমাজের সামনে তুলে ধরেছিলেন আব্বাসউদ্দীন সাহেব?
যাই হোক, পহেলা বৈশাখে নতুন জীবনের আকাক্সক্ষা অনেক বাঙালিকেই এই আবাহনী অনুষ্ঠানে উদ্বুদ্ধ করেছে। কোথাও কোথাও আলোচনার ধারা পহেলা বৈশাখের বিষয়ে মুসলিম ঐতিহ্যের স্মরণের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ইরানের এবং আকবরের নওরোজের সঙ্গে যোগ সন্ধান করে পাকিস্তানের পহেলা বৈশাখকে ‘হালাল’ বলে তুলে ধরার প্রবণতা দেখা গেছে। তখন বড় অসহায় অবস্থা কিনা! বাঙালি-উৎসব হিসেবে দেখে শাসকরা যদি নাখোশ হন!
তবু শেষ পর্যন্ত বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দোৎসব হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেল পহেলা বৈশাখ। বাঙালির স্বাধীকার-বোধের নিুকণ্ঠ উচ্চারণ হিসেবে শুরু হলেও, সাধারণভাবে সমগ্র বাঙালি এতে সাড়া দিয়ে বিপুল আবেগ তরঙ্গে পহেলা বৈশাখকে দিল আন্দোলনের রূপ। পাকিস্তান আমলে বাঙালির নিরুদ্ধ আবেগ এমনি করে উৎসবমুখ খুঁজে পেয়েছিল। নগরের বাঙালি শহুরে মঞ্চে নাগরিক কাব্যগীতিকারদের গানে গানে মানুষকে নতুন দিনের কথা বললেও, চিরকালের বাঙালির বৈশাখী মেলা জমিয়ে তোলার চেষ্টাও করেছিল। নগরে-গ্রামে আদান-প্রদানের ভেতর দিয়ে শাশ্বত বাঙালি সত্তা পরস্পরের মধ্যে রাখিবন্ধনে বাঁধা পড়বে, এ ছিল উদ্দেশ্য। বটমূলের অনুষ্ঠানের সঙ্গে বৈশাখী মেলা জমিয়ে তোলার জন্য ছায়ানট শিল্পী ইমদাদ হোসেনের সহায়তা নিয়েছিল। কয়েকবার চেষ্টার পর একবার মানিকগঞ্জ থেকে পাটের সিঁকা, বৈঠকখানার মেঝেতে পেতে সাজাবার মতন পাট দিয়ে বোনা মাঝারি আকারের গোল আর লম্বাটে-গোল সুদৃশ্য অচ্ছাদন, খাবার টেবিলের ম্যাট ইত্যাদি নিয়ে এসে পসরা সাজিয়েছিল দু-একজন। কিন্তু বিক্রি যা হয়েছিল তাতে অত জিনিস নিয়ে যাওয়া-আসার খরচ পোষায়নি। আর তার চেয়ে বড় সমস্যা ছিল গ্রামের বৈশাখী মেলা, হালখাতা ইত্যাদি ফেলে শহরে আসার আকর্ষণ তখনকার গ্রামের মানুষের ছিল না। এখনকার মতন এমন কেনাকাটার অভ্যাসও ছিল না তখনকার শহরের মানুষের। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর অবস্থা বদলাল। গ্রামের মানুষ বাহিরমুখী হল যুদ্ধ অভিজ্ঞতার অভিঘাতে।
স্বাধীনতার পর এই বাঙালি-উৎসবটি ক্রমে বটমূল ছাড়িয়ে সারা ঢাকা শহরে বিস্তৃত হল। বাংলা একাডেমিতে মেলা জমল। প্রথম প্রথম শিল্পকলার আর্ট গ্যালারিতে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের বইমেলা শুরু হয়েছিল। বাঙালির সরকার শিল্পকলা একাডেমিতেও অনুষ্ঠান করতে আরম্ভ করল। ধানমণ্ডি লেকের ধারে বুলবুল একাডেমি পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন করতে লাগল। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের ইমদাদ হোসেন দেশের নানা জায়গায় বৈশাখী মেলার সমারোহ লাগিয়ে দিলেন। ঢাকাকেন্দ্রিক রইল না আর পহেলা বৈশাখ। মেলা শহরে এলো, মফস্বল শহরে এলো, জেলা শহরগুলোতে শহুরে মানুষের অনুষ্ঠানের পাশে পাশে মহা ধুমধাম করে বৈশাখী মেলা বসতে লাগল! নাগরিক গান আর গ্রামীণ মেলা এবার মিলল পরস্পর।
তবে কিছু শহুরে বুদ্ধিজীবী খবরের কাগজে আর এক ধারায় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগলেন- নাগরিক পহেলা বৈশাখ এক অর্থহীন অনুষ্ঠান। নাকি বছরের প্রথম দিনে নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে শখের পান্তাভাত খাবার অনুষ্ঠান। সুন্দর জিনিসের বিকৃতি ঘটাতে সময় লাগে না। ব্যবসাবুদ্ধি নিয়ে নিতান্ত অর্থলালসায় দোকান সাজিয়ে বসে কৃত্রিম বাঙালি ভড়ং দেখিয়ে পরিবেশ কলুষিত করে যারা, তারা নিন্দনীয় নিঃসন্দেহে কিন্তু শুধু ওই বিকৃতি দিয়ে বাঙালির এ উৎসবকে অর্থহীন বলে ছাপ দিয়ে দেয়া যায় না। পাশাপশি ব্যান্ড-শো আর পপ গান নিয়ে উচ্ছ্বাসে তো ভাটা পড়তে দেখা যায় না! বুদ্ধিজীবীরাও বেশ মেতে ওঠেন ওই বিজাতীয় সংস্কৃতির মত্ততায়!
চারু ও কারুকলা ইন্সটিটিউটে মুখোশ আর হাতি-ঘোড়া-বাঘ ইত্যাদি তৈরি করে যে বর্ণময় মিছিলটি পহেলা বৈশাখের দিনে শুরু করেছে, এর তুলনা নেই। চারুকলার ছাত্ররা আধুনিক শিল্পচর্চার সঙ্গে লোকশিল্প জড়িয়ে-মিশিয়ে নগরের বুকে যে সমারোহটি সম্ভব করে তুলেছে, এতেও আমি নগর আর পল্লীর মেলবন্ধন দেখতে পাই। এ উৎসবের বুদ্ধিজীবী সমালোচকরা কি এ সৌন্দর্য চোখ মেলে দেখেছেন? চারু-কারুকলার উৎসবে ছাত্রদের দিকনির্দেশনা দিতেন ছায়ানটের সেই পুরনো বন্ধু ইমদাদ হোসেন। গ্রাম আর শহরের শিল্পকে কাছাকাছি নিয়ে এসে উভয়ের যোগ ঘটানোর এ প্রয়াসের জন্য তাকে শ্রদ্ধা জানাই।
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা শহরে নববর্ষের আনন্দানুষ্ঠান কয়েকদিন ধরে চলে। খোলা আকাশের নিচে মেলা-মেশার, বই কিনে প্রীতিভাজনকে উপহার দেয়ার এ সুযোগ বাঙালির জীবনকে অধিকতর বাঙালি হয়ে উঠবার জন্য নিরন্তর হাতছানি দিচ্ছে। ময়মনসিংহের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নদীর ধারে হয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরপর সেখানে নৃত্যগীতের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হুমকি সত্ত্বেও নববর্ষের আবাহন চলছে। ঘরোয়াভাবে এক অধ্যাপকের সুপ্রসর বাগানসংলগ্ন ঘরে নতুন বছরকে বরণ করা নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও এ বরণানুষ্ঠানের রেওয়াজ হয়েছে। সব জায়গার নাম করার দরকারই বা কি, শুধু আনন্দিত চিত্তে স্মরণ করি ১৯৬৭ সালে রমনার অশ্বত্থগাছের নিচে সর্বসাধারণের জন্য শুরু হওয়া ছায়ানটের সেই অনুষ্ঠানটি আজ স্বাধীন বাঙালির কত আদরের কত উচ্ছ্বাস প্রকাশের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। আগেও বলেছি, আবার বলি, বাঙালির অন্তরের গভীরে লালিত সংস্কৃতি বোধ এ উৎসারণের জন্য অপেক্ষা করে ছিল। তাই পাকিস্তানি বাধা অপসৃত হতেই উচ্ছল আনন্দে এ উৎসবকেও সবাই বরণ করে নিয়েছে আপন উৎসব বলে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মেলবার এ আয়োজন শান্তিপ্রিয় সহাবস্থানে অভ্যস্ত বাঙালির অতীত ঐতিহ্যকে জাগ্রত করেছে আবার।
বাঙালি এখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে শোকের ক্ষেত্রে মিলতে শিখেছে, মিলছে বিজয় উৎসবে, স্বাধীনতা দিবসে। অনেক আত্মাহুতি আর ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া এ সম্মিলনের ধারা বাঙালি জীবনে অব্যাহত থাকুক। বাঙালি নববর্ষে তো মিলবেই, আরও মিলুক নানান ঋতু-উৎসবে। বসন্তে, শরতে, শীতে উৎসবের তরঙ্গ আমাদের একপ্রাণ করুক। প্রীতিবন্ধনেই বাঙালির জাতিসত্তার বিকাশ ঘটবে, এ উপলব্ধি আমাদের জীবনে শুভ সূচনা ঘটাবে। আসুন, আমরা শহরে-গ্রামে, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আর যত আদিবাসীতে মিলে সবার হৃদয়ে রাখিবন্ধনের উদ্যোগ নেই।

No comments

Powered by Blogger.