‘আওয়ামী শিশু লীগ’ বনাম ‘জাতীয়তাবাদী সাপুড়ে দল’ by রোবায়েত ফেরদৌস

বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে কথা হচ্ছে। কনের মা জিজ্ঞেস করছেন, ‘পাত্র কী করে?’; ঘটক সহাস্যে উত্তর দিচ্ছেন, ‘পাত্র ছাত্রলীগ করে’। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ঘটক নিশ্চয়ই বলতেন, ‘পাত্র ছাত্রদল করে’। কারণ, কোনো চাকরি/ব্যবসা না, ছাত্রলীগ/ছাত্রদল করাই এখন মস্ত ক্যারিয়ার! আবার ধরুন, আওয়ামী পর্যটন লীগ, ভাঙ্গারি লীগ, শিশু লীগ কিংবা আওয়ামী প্রতিবন্ধী লীগ—প্রিয় পাঠক এ রকম পোস্টার ঢাকা বা ঢাকার বাইরে নিশ্চয়ই আপনারা লক্ষ করেছেন; আবার জাতীয়তাবাদী শুঁটকি ব্যবসায়ী দল, জাতীয়তাবাদী তাঁতী দল কিংবা জাতীয়তাবাদী হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য ফ্রন্ট—এ রকম সংগঠনের কার্যকলাপের খবরও বোধ করি আপনাদের চোখ এড়ায়নি। বাংলাদেশে ছাত্রসংগঠনগুলো কেন এ রকম চরিত্র পায়? কেন সিভিল সোসাইটি সংগঠন নিজেদের স্বতন্ত্র নাম নিয়ে দাঁড়াতে পারে না? সংগঠনের সবাইকে কেনই-বা আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপির লেজুড়বৃত্তি করতে হয়—সংগঠনের নামে এবং অবশ্যই কাজে? আজকের লেখায় চলুন এর সুলুক সন্ধান করি। আমার প্রতীতি, এটি হয় পার্টিতন্ত্রের কারণে; এ জন্য ‘পার্টিয়ার্কি’ বা ‘পার্টিতন্ত্র’ বলতে কী বোঝায় তা খোলাসা করতে হবে।
‘পেট্রিয়ার্কি’ বা ‘পুরুষতন্ত্র’ যেমন মনে করে চিন্তা, সম্পদ ও ক্ষমতার সমস্ত এলাকা কেবল পুরুষের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সবকিছু কেবল পুরুষের চোখ দিয়ে দেখতে হবে, সবই পুরুষের অধীন হবে, ঠিক তেমনি ‘পার্টিয়ার্কি’ বা ‘পার্টিতন্ত্র’ মনে করে রাষ্ট্র ও সমাজের তাবৎ বিষয় নিয়ন্ত্রণ করার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কেবল পার্টির; নারী-পুরুষতন্ত্রের প্রধান শিকার আর পার্টিতন্ত্রের প্রধান শিকার সাধারণ জনগণ। পুরুষতন্ত্রের দাপটে যেমন নারীর অধিকার ও সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়, পার্টিতন্ত্রের প্রতাপে রাষ্ট্র ও সমাজে জনগণের প্রত্যাশা-চাহিদা-অধিকার তেমনি পরাস্ত হয় প্রতিদিন, প্রতি রাত। জনগণের জন্য রাষ্ট্র হয় এ রকম: ‘দুর্বল দিন শেষে দুর্গম রাত’; আর সমাজ হয়: ‘প্রতারিত দিন শেষে পরাজিত রাত’। এটা সত্য যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিস্তম্ভ হচ্ছে পার্টি; কিন্তু সমস্যা যেমন পুরুষে নয়, সমস্যা পুরুষতন্ত্রে; তেমনি পার্টি কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা পার্টিতন্ত্রে।
বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে, রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করবে এবং রাষ্ট্র চালাবে, কিন্তু বলা নেই যে দেশের সব মানুষ রাজনৈতিক দল করবে; রাষ্ট্রীয় সুশাসনের স্বার্থেই সব নাগরিকের পলিটিক্যাল পার্টিতে নাম লেখানোর দরকার বা আবশ্যিকতা কোনোটিই নেই; ব্যক্তির ‘পারিবারিক’ আর ‘রাজনৈতিক পরিচয়’-এর মাঝখানে যে স্পেস/পরিসর থাকে সেখানেই সিভিল সোসাইটি তার ভূমিকা রাখে; বলা হয় জাতি হিসেবে আমরা কেবল ‘স্বাধীনতা’ আর ‘পরাধীনতা’ বুঝি—কিন্তু এ দুইয়ের বাইরে যে ‘অটোনমি’ বা ‘স্বায়ত্তশাসন’-এর ধারণা, সেটা আমরা বুঝতে পারি না। আমাদের বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে এই ‘সেন্স অব অটোনমি’র উপলব্ধি চিন্তায় আনতে ও চর্চায় মানতে; অথচ সিভিল সোসাইটি নিজেকে সেই স্বায়ত্তশাসিত স্পেসে প্রোথিত করে তবেই না কাজ করে। কিন্তু পার্টিতন্ত্র সেই স্পেসকেও নষ্ট করতে চায়—এ প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংকুচিত হয়ে পড়ে সরকারে, সরকার রিডিউসড হয়ে যায় পার্টিতে আর পার্টি সংকুচিত হয়ে পড়ে মাস্তানতন্ত্রে; এ কারণে পার্টি/মাস্তানতন্ত্র/সরকারের সমালোচনা করলে তাকে চিহ্নিত করা হয় ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে। এভাবে পার্টিতন্ত্র সমালোচনা বা বিরোধী মত-পথকে দমন করে বল্গাহীনভাবে রাষ্ট্র ও সমাজের সবকিছুর ওপর পার্টির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বর্তমান বাংলাদেশের চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থা এর জ্বলন্ত সাক্ষী।
রাজনীতিবিজ্ঞানে ‘পার্টিয়ার্কি’ বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায়, যেখানে পলিটিক্যাল পার্টি সকল ‘রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয়’ (স্টেট ও নন-স্টেট) প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের দখলে আনে কিংবা প্রতিনিয়ত দখলের চেষ্টা জারি রাখে। পার্টিয়ার্কি রাষ্ট্র ও সমাজের সব সংস্থা/প্রতিষ্ঠানকে এক শ ভাগ পার্টির কবজায় আনার কোশেশ চালায়। পার্টিতন্ত্রে রাজনৈতিক দল একচেটিয়াভাবে ফরমাল বা আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং পুরো সমাজকে তার মতো করে পার্টি-পলিটিকসের ভেতরে নিয়ে আসতে চায়; পার্টিতন্ত্রে রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণকে সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির বাতাবরণে আবদ্ধ করে ফেলে; অন্য সব রাজনৈতিক/সামাজিক সংগঠনের স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সত্তাকে হত্যা করে। এ প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সমাজের বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গোষ্ঠী যেমন শ্রমিক ইউনিয়ন, পেশাজীবীদের সংগঠন, সিভিল সোসাইটি গ্রুপকে বিভিন্ন পদ-পদবি-সুবিধা দিয়ে সাংগঠনিক ও মতাদর্শিকভাবে পার্টি লাইনে নিয়ে আসে।
বাংলাদেশে দুই দশক ধরে এই পার্টিতন্ত্রই আমরা দেখছি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খুব সফলভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে এই পার্টিতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এর চেয়ে ক্ষতিকর আর করুণ ঘটনা খুবই বিরল! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অধিকার আদায়ের নীল দল এখন পরিণত হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আওয়ামী শিক্ষক লীগ’-এ আর ন্যক্কারজনকভাবে সাদা দল রূপান্তরিত হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয়তাবাদী-জামায়াতী দল’-এ। সাদা সাদা আরও সাদা—নীল নীল বাড়তি নীল; আবার কেউ কেউ এমন ‘সাদা’ যে বাড়তি ‘নীল’-এর দরকার পড়ে না। একই অবস্থা সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের। তাই ড্যাবের বিপরীতে আছে স্বাচিপ! বিএফইউজের ‘একাংশের’ উল্টো দিকে বহাল তবিয়তে দণ্ডায়মান আছে বিএফইউজের ‘আরেকাংশ’; এর ফলে সিভিল সোসাইটি নিজেদের স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সত্তা নিয়ে বিকশিত হতে পারছে না। সবই এখানে ‘অব দ্য পার্টি, ফর দ্য পার্টি অ্যান্ড বাই দ্য পার্টি’; পার্টির প্রতি আনুগত্যই হচ্ছে কাজ/চাকরি পাওয়ার মূল ও মুখ্য নিয়ামক (স্মরণ করুন ছাত্রলীগ কর্মীদের বিসিএস পরীক্ষায় চাকরি পাইয়ে দেওয়া নিয়ে এইচ টি ইমামের বক্তব্য); বল্গাহীন পার্টিয়ার্কির এমনবিধ কারণে রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার বোধ হারিয়ে যাচ্ছে; যোগ্য, মেধাবীরা ক্রমেই হতাশ ও কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। দুর্বল, অযোগ্য কর্মচারী/কর্মকর্তা দিয়ে বাকি বিশ্বকে মোকাবিলা করা যাবে না। চাটুকার দলবাজ আর অনুগত দলদাস দিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ সম্ভব নয়।
একই কথা সিভিল সোসাইটির ক্ষেত্রেও সত্য; পার্টিতন্ত্রের ভেতরে ‘পরজীবী’ হয়ে বসবাসরত সিভিল সোসাইটি কেবল আরামে বসে খুদকুঁড়া খাবে; নিজে মোটাতাজা হবে, সমাজের কোনো কাজ হবে না। ভুলে গেলে ভুল হবে যে পৃথিবীর যেখানে সিভিল সোসাইটি শক্তিশালী হয়েছে, সেখানেই কেবল গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে দৃঢ় ও স্বাধীনচেতা সিভিল সোসাইটির কোনো বিকল্প নেই; এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রসমূহ—গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে যেখানে নিয়ামকের ভূমিকা রেখেছে সুশীল সমাজ এবং এখনো তা রেখে চলেছে। সিভিল সোসাইটিকে বলা হয় গণতন্ত্রের পাহারাদার—তারা রাজনৈতিক দল করবে না বা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে না, কিন্তু রাজনৈতিক দল বা সরকার ঠিকমতো কাজ করছে কি না নিয়ত তার নজরদারি করবে। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে চোখে চোখে রাখবে—এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে জবাবদিহির বোধ প্রতিষ্ঠা হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা তৈরি হবে। এ পর্যায়ে প্রথম আলোর অগ্রসর পাঠকের কাছে আমার প্রশ্ন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—রাষ্ট্র ও সমাজজুড়ে যে সর্বগ্রাসী পার্টিতন্ত্র কায়েম করেছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? বিষয়টি নিয়ে পাঠকেরা ভাববেন এবং সমাজে তা নিয়ে বিতর্ক হলেই হয়তো একটি সমাধানের দিশা মিলবে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.