নানা সমীকরণে জামায়াত by আহমেদ জামাল

ফের আলোচনায় জামায়াত। রাজনীতির অন্দরে-বাইরে দলটিকে ঘিরে নানা হিসাব। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের কথা চলছে তাও অনেকদিন হয়ে গেল। এজন্য আইনে সংশোধনীও আনা হয়। তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদনও জমা দেয় প্রসিকিউশনের কাছে। কিন্তু হঠাৎ আইনমন্ত্রী আনিসুল হক উপলব্ধি করেন, দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের জন্য আবারও আইনের সংশোধন প্রয়োজন। কারণ আইনে দোষী সাব্যস্ত হলে জামায়াতের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে তা বলা নেই। এরপর আইনমন্ত্রী অনেকবারই বলেছেন, মন্ত্রিসভার আগামী বৈঠকেই জামায়াতের বিচারে আইনের সংশোধনী প্রস্তাব উঠবে। কিন্তু সে আগামী বৈঠক এখনও আসেনি। জামায়াত নিষিদ্ধের কোন পদক্ষেপও সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। যদিও বিএনপিকে সরকারি মহল থেকে বারবার পরামর্শ দেয়া হয়েছে জামায়াত ত্যাগের। বুধবার রাতেই টক শো-তে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ না করে বিএনপিকে জামায়াত ত্যাগের পরামর্শ দেয়া কতটুকু নৈতিক।
পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই ধারণা, জামায়াতের নিষিদ্ধের মতো চূড়ান্ত কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগে প্রভাবশালী মহল নানা কৌশলের খেলা অনুসরণ করছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি সপ্তাহেও দলটিকে নতুন করে একটি টোপ দেয়া হয়েছে। জামায়াতের সব শীর্ষ নেতা মৃত্যুদণ্ডের ঝুঁকিতে থাকার কারণে দলটিতে নানা দৌদুল্যমানতা রয়েছে। চলতি সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াত-শিবির সর্বশক্তি নিয়োগ করেনি বলেও ২০ দলীয় জোটের অনেকে মনে করেন। তবে জামায়াতের সূত্র এ দাবি মানতে রাজি নয়। তাদের দাবি হচ্ছে, প্রতিনিয়ত তাদের দলের নেতাকর্মীরা জীবন দিচ্ছেন- অনেকে পঙ্গুও হচ্ছেন। কারাবন্দি নেতারা বর্তমানে জামায়াতের নীতি-নির্ধারণে কোন ভূমিকা রাখছেন না বলে জানা গেছে। তারা কারাবন্দি হওয়ার পর শিবিরের কয়েকজন সাবেক সভাপতি জামায়াতের নীতি-নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা শুরু করেন। তবে তাদের অন্তত তিন জন বর্তমানে কারাবন্দি। এ অবস্থায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাকের দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে অবস্থান, সহিংসতার মামলা মাথায় নিয়েও কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহেরের বিদেশ গমনে দলটির ভেতরে-বাইরে নানা প্রশ্ন তৈরি করেছে। আন্দোলন কৌশল নিয়েও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে। জামায়াত ছাত্রদল ও শিবিরসহ ২০ দলীয় জোট সমর্থিত ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য গঠনের পক্ষে থাকলেও বিএনপি এ প্রস্তাবে রাজি নয়। যদিও সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বেড়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
গত পাঁচ বছরেই সরকারি কৌশল মোকাবিলায় জামায়াতকে খাবি খেতে হয়েছে। কাদের মোল্লার রায়ের আগে জামায়াতকে শাপলা চত্ব্বরে সমাবেশের সুযোগ দিয়েছিল সরকার। এতে দলটিতে উৎফুল্লভাব দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত ‘শাহবাগ অভ্যুত্থানে’ তা মিলিয়ে যায়। এক বছর পর কার্যকর হয় কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড। এর আগে আওয়ামী লীগের বিগত শাসনের শুরুর দিকে মীর কাসেম আলীর ভিআইপি লাউঞ্জ ব্যবহার করে বিদেশ গমন নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জামায়াতকে ক্ষয়-ক্ষতির শিকার হতে হয়েছে। দলটির তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের পুরো শীর্ষ নেতৃত্ব দণ্ডিত। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির সব নেতা আত্মগোপনে। তিন বছরের বেশি সময় কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সব কার্যালয় বন্ধ। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে ঝুলে আছে নিবন্ধনের ভাগ্য। এমনকি দল হিসেবে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধের দাবি তো আছেই। এ অবস্থায় প্রভাবশালী মহল কৌশলের অংশ হিসেবে মাঝে-মধ্যে জামায়াতকে সমঝোতার প্রস্তাবও দিয়েছে। কখনও জামায়াতের কাছে প্রস্তাব এসেছে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার। কখনও বলা হয়েছে, শীর্ষ নেতাদের বাদ দিয়ে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এবং রফিকুল ইসলাম খানকে সামনে আনার কথা। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোন নির্বাচন হলে সেখানে নতুন নেতৃত্বে জামায়াতের অংশগ্রহণের আলোচনাও রয়েছে। তরুণ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, কেন তোমরা যুদ্ধাপরাধী নেতাদের দায়ভার বহন করবে। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও অতীতে একাধিকবার অভিযোগ করেছিলেন, সরকার তলে তলে জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে ওই দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। তবে জামায়াতের তৃণমূল নেতারা সরকারের সঙ্গে কোন ধরনের সমঝোতার পক্ষে নয়। এ অবস্থায় সর্বশেষ টোপ জামায়াত কিভাবে গ্রহণ করে তাই এখন দেখার বিষয়।

No comments

Powered by Blogger.