মানচিত্র পাল্টে যাচ্ছে

পাল্টে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের মানচিত্র। ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় জমিসংক্রান্ত সমস্যা নিরসন এবং দেশের অচিহ্নিত সীমানা চিহ্নিত করায় দু’দেশের সীমান্ত রেখায় কিছুটা পরিবর্তন আসবে। এই পরিবর্তনের ফলে ৫২ হাজার ছিটমহলবাসীর ৬৩ বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটতে যাচ্ছে। দীর্ঘদিনের সমস্যা নিরসনে ভারতের সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে দেশটি সব প্রস্তুতিও সম্পন্ন করছে। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, সংসদের চলতি শীতকালীন অধিবেশনেই বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভারত সরকার তাদের সংবিধান সংশোধনীর বিল পাস করতে যাচ্ছে। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, চুক্তির বাস্তবায়ন হলে ভারত তার প্রতিশ্রুতি পূরণের পথে এক ধাপ এগোবে। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বরফ গলবে অনেক বেশি, যা অপরাপর অমীমাংসিত ইস্যু নিষ্পত্তিতে সহায়ক হবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভারত আমাদের আশ্বস্ত করেছে, তারা শিগগিরই সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করবে। আমরা আশা করি, এই লক্ষ্যে শীতকালীন অধিবেশনেই ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হবে।’ ভারতের পার্লামেন্টে ২৪ নভেম্বর শুরু হওয়া শীতকালীন অধিবেশন ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এর আগে অনুষ্ঠিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বিল পাসের পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং। তিনি বলেন, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হলে ভারত ভূমি হারাতে পারে বলে কোনো কোনো মহল থেকে যে আশংকার কথা বলা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। কারণ যে জমি ভারতের দখলে নেই, সেই জমি হারানোর প্রশ্ন আসে কিভাবে। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত ১৯৭৪ সালের সীমান্ত চুক্তির একটি অতিরিক্ত প্রটোকল সই হয়। সেখানে ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর এবং অচিহ্নিত স্থলসীমানা চিহ্নিত করার মাধ্যমে একটি প্যাকেজ সমাধান করা হয়। এই সমাধানের লক্ষ্যে দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা বিরোধপূর্ণ এলাকায় গিয়ে গুচ্ছ মানচিত্র প্রস্তুত করেন। এই গুচ্ছ মানচিত্র দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষর ও হস্তান্তর হয়েছে। ফলে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বলে পরিচিত সীমান্ত চুক্তিতে এমনভাবে ২০১১ সালের নতুন প্রটোকলে যুক্ত করা হয়েছে যে, সীমান্তের কোনো বাসিন্দাকেই সরানো হবে না। যারা যেভাবে বর্তমানে সীমানা দখলে রেখেছেন তা স্থির রেখে নতুন সীমানা রেখা টানা হয়েছে। ফলে দুই দেশের মানচিত্রে খানিকটা বদল হয়েছে বটে। মানচিত্র বদলের কারণেই ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধন করে এই চুক্তি অনুসমর্থন করতে হচ্ছে।
ছিটমহল বিনিময়ের পর ভারতের ছিটে বসবাসকারীদের পুনর্বাসনের সব দায়-দায়িত্ব ভারত সরকার বহন করবে। আগেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ছিট বিনিময়ের আগ মূুহূর্তে বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্যই বৃহস্পতিবার দিল্লিতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। এতে সিদ্ধান্ত হয় পুনর্বাসনের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্যের নয়। একই সঙ্গে তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারকে অবহিত করার বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতীয় ছিটমহল বসবাসকারীদের কেউ যদি ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন তবে তার পুনর্বাসনে সব দায় কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নাগরিকত্ব দেয়াসহ সব দায়িত্ব পালন করবে ভারতের সরকার। ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব দেয়াসহ পুনর্বাসনে রাজ্য সরকারের কোনো সুপারিশ থাকলে কেন্দ্র তাও বিবেচনা করবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব এবং রাজ্য পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ডিজি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে একদা বিরোধিতাকারী বিজেপির এখনকার যুক্তি হল, আসামসহ ভারতে বাংলাদেশীদের ‘অনুপ্রবেশ’ বন্ধে মোক্ষম হাতিয়ার হবে এই চুক্তির বাস্তবায়ন। নিউইয়র্ক ও কাঠমান্ডুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর এই বিল পাসে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার বিজেপি। তিস্তার পানিবণ্টন ও সীমান্ত চুক্তির ইস্যুতে ভারত প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন না করায় বাংলাদেশ ট্রানজিটের প্রস্তাবিত অবকাঠামো চুক্তি নিয়েও অগ্রসর হচ্ছে না। অনেকেই মনে করেন, ভারতে মোদির বর্তমান সরকার একটি ব্যবসাবান্ধব সরকার হওয়ায় গোটা ভারতে বাণিজ্য বাড়াতে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ট্রানজিট জরুরি। বাংলাদেশের সহায়তা ছাড়া এই কানেকটিভিটি সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মোদি আগে প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়েছেন। এদিকে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের কাছাকাছি সময়ে ১৮ ডিসেম্বর ভারত সফরে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সফরকালে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হবে। এই চুক্তির বাস্তবায়নকে সীমান্তে হত্যা বন্ধে একটি হাতিয়ার হিসেবে মনে করে।
জানা গেছে, কংগ্রেসদলীয় এমপি শশী থারুরের নেতৃত্বে পার্লামেন্টের এ সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি বিলটি পাসের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। মোদির আসাম সফরের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন বিজেপির আসাম শাখার এই বিলের ব্যাপারে আপত্তি আর নেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রীতিমতো ইউটার্ন নিয়ে কুচবিহার সীমান্তে ঘোষণা দেন যে, তিনি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে। ফলে এই বিল পাসে আপত্তি দেয়ার মতো একমাত্র দল ‘আসাম গণপরিষদ’। কিন্তু বাধা দিয়ে এই বিল আটকে দেয়ার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে বিলটি পাস হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
গত কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনের এই বিল ভারতের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় উত্থাপন করা হলে বিজেপি, আসাম গণপরিষদ এবং মমতার তৃণমূল কংগ্রেস তার বিরোধিতা করে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এই বিলের ব্যাপারে তেমন আপত্তি না থাকলেও আসাম ইউনিট এই বিষয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করে। ভারতের পার্লামেন্টের নিয়ম অনুযায়ী সেখানে একবার কোনো বিল উত্থাপন হলে তা থেকে যায়। এই কারণে বিগত আমলে কংগ্রেস যে বিলটি এনেছিল, তা এখন পরিবর্তন ও পরিবর্ধনসহ পাস হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ভারতে সংবিধান সংশোধন করতে হলে পার্লামেন্টে উভয় কক্ষ অর্থাৎ উচ্চকক্ষ রাজ্যসভা এবং নিুকক্ষ লোকসভায় দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে তা পাস হতে হবে। লোকসভায় বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় অনায়াসেই এই বিল পাস হয়ে যাবে। রাজ্যসভায় সংবিধান সংশোধনের মতো বিল পাসে পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বিজেপির। কিন্তু বিলটি যেহেতু গত আমলে কংগ্রেসই উত্থাপন করেছে, ফলে এই বিলে কংগ্রেস সমর্থন দেবে। এ অবস্থায় সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল পাসে তেমন কোনো বাধা নেই। এখন শুধু অপেক্ষা কবে এটি পাস হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি সোমবার দিল্লি থেকে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘আশা করি আগামী ১০ দিনের মধ্যেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল পার্লামেন্টে পাস হবে। কার্যপ্রণালী বিধি মোতাবেক এখন পার্লামেন্টের যৌথসভা ডাকা হবে। সেখানে বিলটি নেয়া হলে তার ওপর ভোটাভুটি হবে। এছাড়া এই বিল পাসের ক্ষেত্রে বড় কোনো বাধা নেই।’
সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন যে দুই দেশের জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার পূরণ ঘটাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই- এমন কথাই বলেছেন ভারতের অবসরে যাওয়া কূটনীতিক বীণা সিক্রি। তিনি বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্কে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন। দেখুন, সীমান্তের এই সমস্যাটা বাংলাদেশের স্বাধীনতারও বহু আগের। দীর্ঘদিন ধরেই ঝুলে আছে এই সমস্যা। তারপর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি হল। প্রটোকল সই হল। এখন সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হলে মাঠ পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন হবে।’
সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন বাংলাদেশ ও ভারতের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা জানতে চাইলে বীণা সিক্রি বলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সীমান্ত চুক্তি কিভাবে প্রভাব ফেলবে বলতে পারছি না। তবে ভারতে প্রত্যেকেই এই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের অপেক্ষায় আছেন। সবারই প্রত্যাশা, দীর্ঘদিন ধরে যে চুক্তি ঝুলে আছে তার বাস্তবায়ন সম্পন্ন হোক। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার দায়িত্ব গ্রহণের একেবারে শুরু অর্থাৎ মে মাস থেকেই এই চুক্তি বাস্তবায়নে সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে দায়িত্ব গ্রহণের ছয় মাসের মাথায় ডিসেম্বরের মধ্যে চুক্তির বাস্তবায়নকে সবাই বিজেপির সাফল্য হিসেবে দেখবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই চুক্তির বাস্তবায়ন সবচেয়ে ভালো খবর হয়ে আসবে ছিটমহলবাসীর মধ্যে। সেখানে লোক গণনা হয়ে গেছে।’ বীণা সিক্রি বাংলাদেশে হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমার সময়ে একবার বন্যা হয়েছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলের বাসিন্দারা তখন কোনো সহায়তা পায়নি। বাংলাদেশ থেকে সহায়তা করা হয়নি যেহেতু তারা ভারতের নাগরিক। অপরদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে ভারতও কোনো সহায়তা করতে পারেনি। ফলে ছিটমহলের বাসিন্দারা অভাবনীয় দুর্ভোগে দিনাতিপাত করেছেন। ছিটমহলের মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত। তারা যে অন্তহীন সমস্যার মধ্যে থাকেন তার একটা অবসান হবে এটাই শুভ সংবাদ।’ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পর কি নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসতে পারেন এই প্রশ্নে বীণা সিক্রি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দুই দফা দেখা হয়েছে। একবার নিউইয়র্কে, আরেকবার কাঠমান্ডুতে, তারা নিশ্চয়ই আলোচনা করেছেন। ফলে অপেক্ষা করুন, দেখুন কী হয়।’
সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের পার্লামেন্টে সহসাই পাস হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভারতের পার্লামেন্টের চলতি শীতকালীন অধিবেশনেই সীমান্ত চুক্তির বিল পাস করা সম্ভব। তবে যেভাবে প্রক্রিয়াটা অগ্রসর হচ্ছে তাতে শুধু সংবিধান সংশোন বিল পাসই যথেষ্ট নয়, বরং মাঠ পর্যায়ে এই চুক্তির বাস্তবায়নও প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধান সংশোধনী বিল পাস হলে এটা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই ইতিবাচক হবে। দুই দেশের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। তবে আমরা একই সঙ্গে আশা করি, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিসহ অনিষ্পন্ন সব ইস্যুর দ্রুত নিষ্পত্তি করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির আরও বলেন, ‘সীমান্ত চুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে ছিটমহলে মানুষ যে অমানবিক জীবনযাপন করছে তার একটা অবসান হবে। তাদের মানবেতর জীবনের অবসান করাটা একটা মানবিক দায়িত্ব। এই দায়িত্বই পালন হবে।’
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাজনের লক্ষ্যে স্যার সিরিল রেডক্লিফের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ। এখন সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই মানচিত্র কিছুটা বদলে যাবে। এ কারণে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কূটনীতিক বলেছেন, সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন প্রয়োজন হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ইতিপূর্বে বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তরের সময়েও বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হয়েছিল।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসীন মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘ভারতে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করে এই বিল পাস করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে এই ঐকমত্যের সৃষ্টি হওয়ায় এতদিন ঝুলে থাকা সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে। এই বিল পাস হলে এটা ইতিবাচক হবে এ কারণে যে, এর মাধ্যমে সীমান্তে বহু সমস্যা সমাধানের পথ খুলে যাবে। যেমন- সীমান্ত হাট, সীমান্ত এলাকার উন্নয়ন, যার সুফল ভোগ করবে দুই দেশের জনগণ।’
ছিটমহল বিনিময় : ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি অনুমোদনের পর এখন দেশটির পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে সংবিধান সংশোধনী পাস হলেই সীমান্ত সংক্রান্ত তিনটি বিরোধের নিষ্পত্তি হবে। এগুলো হল- ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর এবং অচিহ্নিত স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণ। ছিটমহল হচ্ছে কোনো দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানা থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অন্য একটি দেশের মূল ভৌগোলিক সীমানার অভ্যন্তরে বিরাজমান ভূখণ্ড বা জনপদ। ছিটমহল থেকে বিচ্ছিন্ন এবং ওখানে যেতে হলে অন্য দেশটির জমির ওপর দিয়ে যেতে হয়। ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় সম্ভব হবে। এর জন্য ভারতকে ১৭ হাজারের কিছু বেশি একর জমি বাংলাদেশকে দিতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের এখন ১১১টি ছিটমহল রয়েছে। এগুলো বাংলাদেশ পাবে। অপরদিকে ভারত পাবে সাত হাজার একরের একটু বেশি জমি। ২০১১ সালের লোক গণনা মোতাবেক বাংলাদেশে ভারতের ছিটমহলে জনসংখ্যা ৩৮ হাজার এবং ভারতে বাংলাদেশের ছিটমহলে লোকসংখ্যা ১৪ হাজার। কেননা ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের যে ৫১টি ছিটমহল রয়েছে সেগুলো ভারত পাবে। এসব ছিটমহল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম জেলায় এবং সীমানার ওপারে ভারতের কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলায় অবস্থিত। কোচরাজারা এবং রংপুরের মহারাজারা মূলত ছিল সামন্ত। তাদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এমনকি ঋণ পরিশোধে মহলের বিনিময় পর্যন্ত ছিল। মোগল আমলে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দুই ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা ও মহারাজারা মিলিত হতো তিস্তা পারে দাবা ও তাস খেলার উদ্দেশে। খেলায় বাজি ধরা হতো বিভিন্ন মহলকে, যা কাগজের টুকরা দিয়ে চিহ্নিত করা হতো। খেলায় হার-জিতের মধ্য দিয়ে এই কাগজের টুকরা বা ছিট বিনিময় হতো। সঙ্গে সঙ্গে বদলাত সংশ্লিষ্ট মহলের মালিকানা। এভাবে সেই আমলে তৈরি হয়েছিল একের রাজ্যের ভেতরে অন্যের ছিটমহল।
অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর : ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, আসাম এবং ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় অনেক স্থানে দুই দেশের বাসিন্দারা সীমান্ত রেখা ছাড়িয়ে গিয়ে ভূমি দখল করে রেখেছে বছরের পর বছর। যাদের দখলে আছে তারা এসব বিরোধপূর্ণ স্থানে কৃষি কাজও করছে। এখন এসব ভূমি বহু বছর ধরে যে দেশ দখল করে রাখছে তাদের কাছে ছেড়ে দিয়ে অপদখলীয় ভূমির হস্তান্তর হবে চুক্তি বাস্তবায়ন হলে। এক্ষেত্রে রেডক্লিফের সীমান্ত রেখারও পরিবর্তন হচ্ছে। যার ফলে নতুন গুচ্ছ মানচিত্র তৈরি করেছেন দুই দেশের জরিপ কর্মকর্তারা। অপদখলীয় ভূমিগুলোও বিনিময় করা হবে, যার ফলে ভারত প্রায় দুই হাজার আটশ’ একর জমি পাবে। আর বাংলাদেশকে দিতে হবে দুই হাজার দুইশ’ ষাট একরের মতো জমি।
অচিহ্নিত স্থলসীমানা চিহ্নিতকরণ : বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি স্থলসীমান্ত রয়েছে। এই দীর্ঘ সীমান্তের মধ্যে তিনটি স্থানে সাড়ে ছয় কিলোমিটার সীমানা এখনও অচিহ্নিত রয়েছে। এই স্থানগুলোতে বিরোধপূর্ণ এলাকা দিয়ে প্রায়ই সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখন সীমানায় যে স্থান যার দখলে রয়েছে সেখানেই সীমান্ত রেখা টেনে গুচ্ছ মানচিত্র করা হয়েছে। সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হলে এই অবশিষ্ট অচিহ্নিত সীমানাও চিহ্নিত হয়ে যাবে।
ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর সিরিল রেডক্লিফ ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এঁকেছিলেন। তারপর পূর্ব পাকিস্তানের এলাকাগুলো নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ। এখন সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেই মানচিত্রের কিছুটা বদলে যাবে। এ কারণে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কূটনীতিক বলেছেন, সীমান্ত চুক্তির অনুসমর্থনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন প্রয়োজন হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ইতিপূর্বে বেরুবাড়ী ভারতের কাছে হস্তান্তরের সময়েও বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হয়েছিল।

No comments

Powered by Blogger.