এভাবে শিক্ষার ভিত শক্ত হয় না by ড.সরদার এম আনিছুর রহমান

শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও এর ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে কথা বলে আসছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ২৭ নভেম্বর যখন জাফর ইকবালের ‘দোহাই, আমাদের শিশুদের ক্রিমিনাল বানাবেন না’ শিরোনামে লেখাটি পড়ছিলাম, তখন নিজের ভেতরকার কষ্টটা যেন আরও বেড়ে গেল।
জাফর ইকবাল লিখেছেন, এত দুঃখ নিয়ে এর আগে তিনি কখনও কাগজ-কলম নিয়ে বসেননি। এরপর তিনি দেশের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। তুলে ধরেছেন প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি। এখানে তিনি সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বলার চেষ্টা করেছেন সেটি হল, ‘আমাদের শিক্ষানীতিতে পঞ্চম শ্রেণীর শিশুদের জন্য কোনো পাবলিক পরীক্ষার কথা বলা নেই, আমলারা নিজেদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এটি বের করে জোর করে তা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাবা-মায়েরা আগে আরও বড় হওয়ার পর ছেলেমেয়েদের কোচিং করতে পাঠাতেন। এখন এ শিশুদেরই গোল্ডেন ফাইভ পাওয়ার জন্য কোচিং করতে পাঠাচ্ছেন। তাতেই শেষ হয়ে যায়নি- এখন তাদের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করা হচ্ছে, ছোট ছোট শিশুদের হাতে ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন ধরিয়ে দিয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হচ্ছে, সেই ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও এ নজির নেই, যেখানে একটি রাষ্ট্র তার দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখায়। একটা দেশের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেয়ার এর চেয়ে পরিপূর্ণ কোনো পদ্ধতি আছে কি?’
আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি মুহম্মদ জাফর ইকবালের এ কথাগুলো একবার হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করতেন, তাহলে হয়তো আমরা সহজেই জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হতাম। কিন্তু যেখানে নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে সবাই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, সেখানে কে শুনবে এসব কথা?
‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’- এ কথা আমরা সবাই স্বীকার করি এবং মুখে উচ্চারণ করি; কিন্তু বাস্তবে যত অবহেলা সব শিক্ষার প্রতি। তা না হলে কি ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীরা জাতির এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মতো করে খেলাঘর সাজাতে পারতেন? বিগত কয়েকটি সরকারের আমলে লক্ষ্য করা গেছে, নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই সেই সরকারের শিক্ষামন্ত্রী নতুন কিছু করে নিজের কৃতিত্ব জাহিরের জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বরং নতুন কিছু করে কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে জাতির মেরুদণ্ডকে আরও বেশি দুর্বল করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। বরং অন্যদের চেয়ে তাকে একটু বেশি উৎসাহী বলেই মনে হয়েছে। বিগত মহাজোট সরকারের ৫ বছরের প্রথম দিকে শিক্ষামন্ত্রী জাতিকে নতুন নতুন স্বপ্নের কথা বলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় হাত দেন এবং ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। তিনি এমন সব পদক্ষেপ নেন যে, তা ২-৩ বছরের ব্যবধানেই ম্লান হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে এর ত্র“টিপূর্ণ দিকগুলো।
শিক্ষামন্ত্রীর একান্ত ইচ্ছায় শিশুদের জন্য পিএসসি ও জেএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা চালু করা হল। এর ফলে জাতির মেরুদণ্ডে আঘাত এলো আরও বেশি করে। এখানেই শেষ নয়, যে কোচিং-বাণিজ্য শিক্ষাকে গ্রাস করছিল, তা আরও বেশি চাঙ্গা হয়ে উঠল। শিশুরা শিখল কীভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে পরীক্ষা দিয়ে গোল্ডেন জিপিএ ৫ পেতে হয়।
কীভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে জীবনকে ধ্বংস করতে হয়।
শিক্ষাকে সাধারণত শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা জীবনে সফল হওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করেন। জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণের অভ্যাস ও নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্বসমাজের উপযুক্ত, কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যম এটি। এদিক থেকে শিক্ষাকে উৎপাদনশীল একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করলে বলা যায়, দেশ ও বিশ্বসমাজের উন্নতির জন্য মানুষকে দক্ষ ও আদর্শবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কি সেটা করতে পারছে? এর উত্তরে সবাই হয়তো বলবেন, না। কিন্তু কেন পারছে না, সেটা কি আমরা একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি?
তাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার লেখায় প্রশ্ন তুলেছেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে ছোট ছোট শিশুদের অন্যায় করতে শেখানো হচ্ছে। সারা পৃথিবীর কোথাও এ নজির নেই, যেখানে একটি রাষ্ট্র তার দেশের শিশুদের অন্যায় করতে শেখায়। একটা দেশের মেরুদণ্ড পুরোপুরি ভেঙে দেয়ার এর চেয়ে পরিপূর্ণ কোনো পদ্ধতি আছে কি? নাই। সারা পৃথিবীতে কখনও ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না। শুধু আমাদের দেশেই, কিছু আমরা আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, একটা শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ধ্বংস করার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। যে জাতি শৈশবে অন্যায় করতে শিখে বড় হয় সেই জাতি দিয়ে আমরা কী করব?’
তাই তিনি এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার হর্তাকর্তাদের কাছে করজোরে প্রার্থনা করেছেন এ অবস্থা থেকে দেশের শিশুদের মুক্তি দিয়ে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য।
‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ কথাটার সারমর্ম হল, কোনো জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রথমে তার মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করতে হয়। আমরা দেখতে পাই, শিক্ষায় যে জাতি যত বেশি উন্নত, সে জাতি সব ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সেই রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক বিশ্বেও এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ইউরোপীয়রা। তাদের উন্নতির কথা আমাদের সবারই জানা।
অন্যদিকে বলা যায়, কোনো জাতিকে অকার্যকর করে রাখতে হলে তাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে উঠতে না দেয়ার নীতি অনেক আগে থেকেই অবলম্বন করে আসছে সাম্রাজ্যবাদীরা। প্রায় দুইশ’ বছরের ব্রিটিশ গোলামি এবং দুই যুগের পাকিস্তানি গোলামি থেকে আমরা স্বাধীন হয়েছি। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৩ বছর অতিবাহিত হচ্ছে, কিন্তু আমরা কি মেরুদণ্ড শক্ত করতে পেরেছি?
এজন্য যে মহাপরিকল্পনা ও সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন, আমরা কি সেটা পেয়েছি? বলা যায়, এর কোনোটিই নেই আমাদের। যখন যে সরকার ক্ষমতাসীন হয়, তারা নিজেদের মতো করে চিন্তা করে এবং শিক্ষায় নিজের দৃষ্টিভঙ্গি টেনে এনে তা বাস্তবায়ন করতে চায়। এতে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আর এ সুযোগে বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করছে। এটা জাতির জন্য খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয়।
তাই মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গে সুর মিলিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানাতে চাই, দয়া করে জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করুন। তা না হলে যত ভালো কাজই করুন না কেন, এতে জাতির কোনো লাভ হবে না। জাতির সার্বিক উন্নয়ন করতে হলে মেরুদণ্ডকে প্রথমে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে।
ড. সরদার এম আনিছুর রহমান : শিক্ষা ও সমাজবিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.