অনলাইনে উগ্রপন্থিদের ভয়ঙ্কর প্রচারণা by নুরুজ্জামান লাবু

জিহাদের নামে ইন্টারনেটে ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালিয়ে আসছে উগ্রপন্থি ধর্মীয় একাধিক গ্রুপ। কোরআন-হাদিসের নানা রকম ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে তারা  সবাইকে জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, বোমা তৈরি থেকে শুরু করে অস্ত্র চালনা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার নানা কৌশল বাতলে দিচ্ছে নিজস্ব ব্লগ ও ওয়েব সাইটে। এমনকি টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে সবার চোখ এড়িয়ে কিভাবে হত্যা করা যায় তার বিষদ বিবরণ প্রচারণা করা হচ্ছে। তাদের ভাষ্য মতে, বাংলাদেশে জিহাদ করা ফরজ হয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমনিতেই জিহাদের নামে যেভাবে ইন্টারনেটে প্রচারণা চলছে তারপর আবার সম্প্রতি আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরির ঘোষণায় উগ্রপন্থিরা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হতে পারে। এ কারণে এসব প্রচার-প্রচারণা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, ইন্টারনেটে এ রকম প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করতে সবসময় নজরদারি করা হয়। ইতিমধ্যে কিছু কিছু ওয়েসাইট ও ব্লগ বিটিআরসি’র সহায়তায় বন্ধও করা হয়েছে। কিন্তু বন্ধ করার কয়েক দিনের মধ্যেই তারা আবার নতুন নামে ওয়েবসাইট খুলে প্রচারণা চালায়। মনিরুল ইসলাম বলেন, আল-কায়েদা ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গি কার্যক্রমকে চাঙ্গা করার জন্য নতুন ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশে যেন আল-কায়েদা তাদের কোন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক রয়েছে। গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইন্টারনেটে উগ্রপন্থিদের এমন কয়েকটি ব্লগ ও ওয়েবসাইট রয়েছে যাতে প্রতিনিয়ত জিহাদে উদ্বুদ্ধ করার কথা জানিয়ে নানারকম পোস্ট আপলোড করা হয়। এমনকি এসব ব্লগ ও ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে জিহাদ কেন ফরজ হয়ে পড়েছে কোরআন-হাদিসের আলোকে তার নিজস্ব ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বোমা তৈরির কৌশল, ক্ষুদ্রাস্ত্র থেকে ভারি অস্ত্র চালনার কৌশল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ফোন ও কম্পিউটার আইপি ট্র্যাকিং করে ধরা না পড়ার কৌশল বিস্তারিত তুলে দেয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকেও এ ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে। উগ্রপন্থিদের মতে এটিকে তারা প্রাথমিকভাবে অনলাইন জিহাদ নামে প্রচারণা চালাচ্ছে। ইন্টারনেটে খোঁজ করে এমন একটি ওয়েবসাইট পাওয়া গেছে, যেখানে ‘একটি বোমা তৈরি করো তোমার মায়ের রান্নাঘরে’ শিরোনামে বোমা তৈরির কৌশল ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ম্যাচের কাঠির মাথায় থাকা বারুদের সঙ্গে চিনির মিশ্রণে দাহ্যবস্তু তৈরি করে লোহার পাইপের মাধ্যমে কিভাবে বোমা বানানো যায় তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সহজলভ্য উপাদান তৈরি এই বোমা দিয়ে কমপক্ষে দশ মানুষকে সহজেই হত্যা করা সম্ভব। এছাড়া টেবিল ঘড়ি ও ব্যাটারি দিয়ে টাইম বোমা তৈরি ও প্রেসার কুকার দিয়ে বোমা তৈরির বিষয়গুলো চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবে সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে বোমা তৈরির কলা-কৌশল প্রচার করা হলে যে কেউ অতি উৎসাহিত হয়ে নিজেই এসব তৈরির চেষ্টা করতে পারে। এতে নিজেরও যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তেমনি উগ্রপন্থিদের কথা মতো কথিত জিহাদি গ্রুপের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়ে যেতে পারে। উগ্রপন্থিদের ব্লগ ও ওয়েবসাইট ঘেটে দেখা যায়, বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র একে-৪৭-এর ব্যবহার, চালনাসহ নানারকম নির্দেশনামূলক পোস্ট দেয়া রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের একটি পোস্টে বলা হয়েছে, যারা জিহাদে শামিল হতে আগ্রহী তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে অবশ্যই আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে হবে। জিহাদের প্রশিক্ষণ নামের ওই ফেসবুক পেজে পুলিশের গুলি থেকে বাঁচতে টিনের বা লোহার ঢাল তৈরি করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যানবাহনের চাকা ফুটো করে দেয়ার পদ্ধতি, তীরের মাধ্যমে পেট্রল বোমা ছোড়ার পদ্ধতি, পুলিশের অস্ত্র লুটের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশী জিহাদিদের একটি ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, সেখানে মোবাইল ফোন, রিমোট কন্ট্রোল ও ওয়াকিটকি দিয়ে ডেটোনেটর তৈরির ভিডিও ক্লিপ, বিভিন্ন রাসায়ানিক উপাদান মিশিয়ে কিভাবে সুপার পাওয়ার বিস্ফোরকদ্রব্য তৈরি করা যায় তার ভিডিও ক্লিপ, গ্রেনেড, হাত বোমা, ককটেল তৈরিসহ বিভিন্ন ধরনের ধারালো অস্ত্র তৈরির বর্ণনা ও চিত্রের সাহায্যে পেট্রল বোমা তৈরির পদ্ধতি তুলে ধরা হয়েছে। শুধু অস্ত্র তৈরির কৌশলই নয়, এসব ব্লগ ও ওয়েবসাইটে শারীরিক প্রশিক্ষণের বিস্তারিত বর্ণনা ও ভিডিও ক্লিপও তুলে ধরা হয়েছে। অপর একটি ওয়েব সাইট ঘেটে দেখা যায়, সেখানে নীরবে হত্যার কৌশল শিরোনামে দেশীয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে কিভাবে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে সহজেই হত্যা করা যায়, শরীরের ঠিক কোন অংশে আঘাত করতে হবে এবং কিভাবে ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়তে হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য হওয়ার জন্য হাদিসের আলোকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।
উগ্রপন্থিদের একটি ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃষ্টি এড়াতে নানারকম কৌশলের কথা বলা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোবাইল ও কম্পিউটারের আইপি অ্যাড্রেস ট্র্যাকিং করে ধরতে পারে উল্লেখ করে কি করলে মোবাইল ব্যবহার করেও এবং কম্পিউটার ব্যবহার করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া ছদ্মবেশে চলাফেরা করতে এবং তথ্য-আদান প্রদানের জন্য নানা রকম পদ্ধতির কথাও বলা হয়েছে এসব ওয়েব সাইটে।

No comments

Powered by Blogger.