পারুল বলেছিল ‘প্রতারক মনিরের শাস্তি চাই’

অভাবী পারুল স্বপ্ন দেখেছিল সুন্দর জীবনের। চেয়েছিল একটু সুখ ও শান্তি। তাই সরল বিশ্বাসে দেহ, মন উজাড় করে দিয়েছিল গৃহকর্তার ছেলে মনিরকে। কিন্তু দিনের পর দিন মনির তাকে অবৈধ সম্পর্ক গড়তে বাধ্য করেছে। যখনই পারুল বিয়ের জন্য মনিরকে চাপ দেয় তখনই তার আসল রূপ প্রকাশ পেতে থাকে। জানায় এ মুহূর্তে বিয়ে করা সম্ভব নয়। একদিকে প্রেমিকের প্রতারণা ও সম্ভ্রম হারানো। অন্যদিকে লোকলজ্জার ভয়। হতাশ ও অভিমানী পারুল চেষ্টা চালায় আত্মহত্যার। বিয়ের প্রলোভনে দেখিয়ে পরে বিয়ে করতে অস্বীকার করায় নিজেই নিজের গায়ে কেরোাসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় সে। মুমূর্ষু অবস্থায় পারুলকে ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। তিন দিন অসহনীয় যন্ত্রণায় সয়ে গতকাল সকালে সেখানেই মারা যায় পারুল। আগুনে পারুলের মুখ, হাত, বুক, পেট ঝলসে যায়। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা জানান, পারুলের শরীরের ৬০ শতাংশ আগুনে পুড়েছে। পুড়েছে শ্বাসনালী। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি। হাসপাতালে ভর্তির সময় হতভাগী পারুলের পাশে কেউ ছিল না। মৃত্যুর পরেও কেউ আসেনি। লাশের দাবিদারও কেউ নেই। তাই পারুলের লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতালের মর্গে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে লাশের দাবিদার কেউ না থাকলে দু’দিনের মধ্যে তা আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার গাজীপুরের জয়দেবপুরের কলাবাগান ইটাহাটা এলাকার মুন্সীর বাড়িতে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের জামশেদ মিয়া ও মা রিজিয়া বেগমের কন্যা পারুল আক্তার। পিতামাতা ছিলেন হতদরিদ্র। কয়েক বছর আগে তারা মারা যান। পিতামাতা হারা ছোট্ট পারুলকে তারই সৎ বোন রিনা আক্তার নিয়ে আসে গাজীপুরে। গৃহকর্মী হিসেবে কাজ দেয় জয়দেবপুরের কলাবাগান ইটাহাটা এলাকার মুন্সীর বাড়ির ব্যবসায়ী মকবুল মিয়ার বাড়িতে। ছোট্ট পারুল বিগত এক দশক ধরে এ বাড়িতেই থাকে। প্রতারক প্রেমিক মনিরের সঙ্গে সম্পর্কের শুরু এখানেই। গত বুধবার ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দোতলায় হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে দুই নম্বর বেডে চিকিৎসাধীন যন্ত্রণায় কাতর পারুল এ প্রতিবেদককে জানায়, ছোটবেলা থেকেই একই বাড়িতে থাকার ফলে মনিরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বছর দুয়েক আগে সে মনিরের সঙ্গে ভালবাবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। মনির তাকে আশ্বাস দেয় বিয়ের। বাধ্য করে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে। পারুলও সরল বিশ্বাসে মন প্রাণ দেহ উজাড় করে দেয় মনিরকে। এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে পারুল। এলাকায় চলে কানাঘুষা। গাজীপুরের একটি ক্লিনিকে নিয়ে তার গর্ভপাত করায় সুচতুর মনির। এভাবে আরও অন্তত তিন তিনবার অন্তঃসত্ত্বা হয় পারুল। প্রতিবারই তার গর্ভপাত করায় প্রতারক প্রেমিক মনির। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় পারুলের। বিয়ের জন্য চাপ দেয় মনিরকে। কিন্তু কিছুদিন ধরেই বদলে যেতে থাকে মনির। সম্পর্ক অস্বীকার করে বিয়ে করবে না বলে সাফ জানিয়ে দেয়। প্রেমিকের প্রতারণায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়া পারুল গত মঙ্গলবার মনিরকে শেষবারের মতো বিয়ের জন্য চাপ দিলে দু’জনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। মনির তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলে পারুল বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। নিজের গায়ে নিজেই কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তার চিৎকারে আশপাশের অনেকেই এগিয়ে আসে। একপর্যায়ে ওই দিন মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপতালের বার্ন ইউনিটে তাকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় মনিরের স্বজনরা। পারুল জানায়, মনিরের আশ্বাসে সরল বিশ্বাসে সে সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিল। কিন্তু তার প্রতারণায় দু’চোখে অন্ধকার দেখি। মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। একদিকে নিজের সম্ভ্রম হারিয়েছি অন্যদিকে লোকলজ্জা তাই মৃত্যুকেই আমি শ্রেয় মনে করেছি। এজন্যই এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যন্ত্রণাক্লিষ্ট কণ্ঠে পারুল বলেছিল, আমি বাঁচতে চাই। বেঁচে থেকে প্রতারক মনিরের বিচার দেখতে চাই। লম্পট মনিরের যেন শাস্তি হয়। কিন্তু সকল যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে পারুল চলে গেছে না ফেরার দেশে।

No comments

Powered by Blogger.