বাঘেরা বাঁচুক সুন্দরবনের জন্য by কাজল ঘোষ

কিছুদিন আগে চিড়িয়াখানা দেখে আসা একদল উৎসাহী তরুণের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাঘ নিয়ে। আমাদের এখানে যে দু’চারটি বাঘ আছে তাদের কোনটিরই প্রাণশক্তি আছে বলে মনে হয় না। অতিকষ্টে তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেই যেন এদের পথচলা। এদের দেখলেই যে কেউ বুঝবে এদেশে খাবারের অভাব। খাদ্য বণ্টনে সততা নেই। খাদ্য লুটপাটকারীদের নেই বিচার। সর্বোপরি সুশাসনের অভাব। আলোচনা বুঝি ধীরে ধীরে সুশীল সমাজের দিকেই এগোচ্ছে। একবার ভাবুনতো চিড়িয়াখানায় গিয়ে বাঘের হাঁক ক’জন শুনেছেন। যারা শুনেছেন নিঃসন্দেহে তারা সৌভাগ্যবান। যারা বাঘ নিয়ে জরিপ করেন তারা যদি কোনভাবে শহরে বাসরত নাগরিকদের যারা চিত্তের বিনোদনে চিড়িয়াখানায় গেছেন তারা কি বাঘের শব্দ শুনেছেন। এমন ভাগ্যবানদের তালিকা খুব লম্বা হওয়ার কোন কারণ দেখি না। কেন বাঘ আর আওয়াজ করতে পারে না। তা চিড়িয়াখানার হাঁড়ির খবর নিলেই বেরিয়ে আসবে।
একাধিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোর খাবার সরবরাহ সঠিকভাবে হয় না। কিউরেটরের এক চিঠি থেকে জানা যায়, জানুয়ারি মাসে ১৬০০ কেজি সবুজ ঘাস সরবরাহের নির্দেশ থাকলেও মাত্র ৮০০ কেজি ঘাস সরবরাহ করা হয়। অথচ খাতায় লেখা হয় ১৬০০ কেজিরই তথ্য। পরে বিষয়টি নিয়ে প্রাণীপুষ্টি অফিসার আবু সাঈদ কামাল বাচ্চুর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেনে থমকে যায় জবাব প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু ঘাস নয়; প্রাণীগুলোর অন্যতম খাবার মাংস সরবরাহেও অর্ধেক দেয়া হয়। এছাড়া, খাবার হিসেবে ২ দাঁতের অল্পবয়সী গরুর মাংস সরবরাহের নির্দেশনা থাকলেও দেয়া হয় বুড়ো জীর্ণশীর্ণ মৃতপ্রায় গরু-মহিষের মাংস। মানসম্মত পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে এবং নিয়মিত ওষুধসহ সঠিক পরিচর্যার অভাবে চিড়িয়াখানার বেশির ভাগ প্রাণীই ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। অভিযোগ আছে, নির্ধারিত বরাদ্দের বিপরীতে অর্ধেক পরিমাণ খাবার সরবরাহ নেয়া হয় ঠিকাদার থেকে। আর এর নেপথ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। এর জন্য যদিও একাধিক তদন্ত কমিটি হয়েছে; সংসদীয় তদন্ত কমিটিও কাজ করেছে। ওই পর্যন্তই। বাঘেরাতো খাঁচায় বন্দি। না হলে হয়তো ওদের বরাদ্দের হিসাব পাই পাই করে বুঝে নিতো। আর যাই হোক বাঘেরা দলবলে কম হলেও দুর্বল নয়। নিয়তির পরিহাস চিড়িয়াখানার এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের জন্য বেচারা বাঘ মামার দল এক পা কবরে দিয়ে আমাদের বিনোদন দিচ্ছে। এ চিত্র শুধু ঢাকা চিড়িয়াখানার- এমন ভাবার কোন কারণ নেই। কক্সবাজারে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এটা তো পশু-পাখিদের জন্য অভয়ারণ্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেখানকার যে দু’চারটি বাঘ আছে তারাও মর-মর। এসবের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের জবাবদিহি আছে বলে মনে হয় না। কার বরাদ্দ কে পরীক্ষা করে? লুট করে প্রাণীকুলকে পথে বসানোই এদের কাজ। ব্যক্তিগত আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলে মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। কিভাবে প্রাণীদের খাবার না দিয়ে নিজেরাই লুট করে নেয় তা দেখার সুযোগ হয়েছিল বাগেরহাটে। সেখানকার খানজাহান আলীর মাজারে পরপর দু’বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। খুলনায় অফিসের কাজে গেলে সেখান থেকেই ষাট গম্বুজ মসজিদসহ মাজার এলাকায় গিয়েছি। ছোট থেকেই খানজাহান আলীর মাজারের কালা পাহাড় আর ধলা পাহাড়ের গল্প শুনেছি। গাঁয়ের বাজারে, রেল স্টেশনের বুকে ওই মাজারের পুকুরঘাটের দু’পাশে দুই কুমিরের ছবিসদৃশ তাবিজ বিক্রেতার ছবিটি চোখে ভাসে। সুযোগ পাওয়ায় কালা পাহাড় আর ধলা পাহাড় দেখার আগ্রহ নিয়েই মাজারে নেমে খোঁজ নিতে শুরু করি। কালা পাহাড় প্রয়াত হয়েছেন অনেক আগেই। এখনও আছেন ধলা পাহাড়। পুকুরের চারপাশে বিভিন্ন বাড়ির পেছনে কখনও কখনও দেখা মেলে নিঃসঙ্গ এই ধলা পাহাড়ের। হঠাৎ সমস্বরে আওয়াজ দেখা মিলেছে অমুক বাড়ির ঘাটে। আমার সঙ্গী-সাথিদের রেখেই আমি ছুটলাম। এ সুযোগ কোনভাবেই মিস করতে চাই না। চারপাশে ভিড় করে আছে মুরিদ নামের এক দঙ্গল মানুষ। যারা কোনভাবেই ধলা পাহাড়ের কাছে যেতে দিচ্ছে না। আগে চাই টাকা অথবা মানতের মুরগি, ছাগল অন্য কিছু। সামনেই দেখলাম দূর থেকে আসা এক পরিবার তাদের পালা দু’টি মুরগি নিয়ে এসেছে মানতের জন্য। ধলা পাহাড় ছুঁয়ে মুরগিগুলো নিয়ে রেখে দিলো ওই লোকেরাই। ঝটপট উত্তর, সরে দাঁড়ান। ওগুলো পরে দেয়া হবে। এটা ধলা পাহাড়ের এখন খাবার সময় না। নির্বিকার মানুষ বোকার মতোই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে প্রস্থান করলো। আমি ভিড় ঠেলে ধলা পাহাড়ের গায়ে হাত দিতেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলো ভিড় করে থাকা মুরিদের দল। আমার কাছে টাকাও চাইলো। কোনরকম পাত্তা না দিয়েই সরে আসি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি এখানেও আছে এদের মস্ত সিন্ডিকেট। এরা পুকুরের চারপাশে আস্তানা গেড়েছে। ধলা পাহাড় আর কালা পাহাড়ের নামে তারা লুটের কারখানা খুলেছে। আর ধুঁকে ধুঁকে মরছে কুমিরগুলো। পরওয়ারদিগারের কাছেই এদের বিচার প্রার্থনা করে বিদায় নিলাম। বারবার মনে হলো কি দুর্ভাগ্য এই কুমিরগুলোর। ওদের নামেই সব আসে কিন্তু খায় অন্যেরা। আমাদের চিড়িয়াখানাগুলোতে মানুষরূপী দুর্বৃত্তরাই পশুদের জন্য বরাদ্দ খাবার লুটে নিয়ে পশুদের ভাগ্যের বারোটা বাজাচ্ছে। যা হোক ঢাকায় বাঘদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হচ্ছে। প্রথম বাঘ সম্মেলন হয়েছিল ২০১০ সালে রাশিয়ায়। তখনও শেখ হাসিনাই দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। বর্তমানে ঢাকায় দ্বিতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক এই সম্মেলন চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই এই সম্মেলনের উদ্বোধক ছিলেন। কিভাবে বাঘ সংরক্ষণ করা যায়। বাঘদের নানা নিরাপত্তার দিকও এই সম্মেলনে আলোচনা চলছে। বাঘ সম্মেলনে প্রকাশিত পুস্তিকায় জানা যায়, দুনিয়ায় বাঘ আছে মাত্র ৪,১৪৭টি আর তার মধ্যে বাংলাদেশে আছে ৪৪০টি। ৬০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের বাস। সম্মেলনে আলোচনায় উঠে এসেছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে এখানে বাঘেদের বসবাসে কোন ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না। চারদিনের এই সম্মেলনে গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০২২ সালে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার যে টার্গেট ধরা হয়েছে তাতে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বাঘ বসবাসের যে সমতল ভূমি, মিঠা পানি আর পর্যাপ্ত খাদ্যের সংস্থান থাকা দরকার তা অপ্রতুল। অথচ সারা বিশ্বের অন্য সব দেশ তাদের টার্গেট পূরণে সফল হবে। অথচ এই আমাদের সরকারের লোকজনই বলে বেড়াচ্ছেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে কোন প্রভাব ফেলবে না। এটা একেবারেই দ্বৈত অবস্থান। বাঘের জন্য যে দিগন্ত বিস্তৃত অভয়ারণ্য দরকার তা ধীরে ধীরে কমে আসছে। যেভাবে আমাদের এখানে কৃষিজমি কমছে। সেই একই ভাবে আগ্রাসী লোভী মানুষেরা বন কেটে কাঠ পাচার করে বনভূমি ধ্বংস করে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের উন্মত্ততায় লিপ্ত। ক’বছর আগে ভুটান সফরের সুযোগ হয়েছিল। সেখানে মোট ভূমির ৬৫ ভাগই রিজার্ভ ফরেস্ট। অথচ আমরা রাষ্ট্রীয়ভাবে বনভূমির বারোটা বাজাতে ব্যতিব্যস্ত। না হলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তড়িঘড়ি করে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ নেয়া হতো না। ইতি টানছি লেখাটির এই বলে, যে বাঘেদের রক্ষায় এই সম্মেলন তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব রাখা হয়নি। যদি বাঘেদের পক্ষে কেউ তাদের যন্ত্রণা মর্মবেদনা তুলে ধরতো তবে হয়তো বিশ্ববাসীর চোখ পড়তো কতটা অসহায় এই জীবকুল।
১৬.০৯.২০১৪

No comments

Powered by Blogger.