বিশ্বশিল্পকলার নেতৃত্বে থাকবে বাংলাদেশ by রফি হক

বাঙালি জাতির দীর্ঘ ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। যা শুধু একটি দেশেরই জন্ম দেয়নি, সেইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে একটি জাতিসত্তার গর্বিত উত্থানের। আমরা পেয়েছি সৃষ্টিশীল বিকাশের অনুপম পরিবেশ। আমাদের শিল্পে, সাহিত্যে, নাটকে, নানা সাংস্কৃতিক আয়োজনে অনিবার্যভাবেই এর প্রকাশ ঘটেছে। আর তেমনি একজন শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ। নিজ হাতে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, অংশ নিয়েছেন সম্মুখ সমরে। তিনি ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। এবং স্বাধীনতার পর অস্ত্র ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছেন ক্ষিপ্র ব্রাশ। মুক্তিযুদ্ধের উন্মত্ততা, বিজয়ের উচ্ছ্বাস নিয়ে এঁকে চলেছেন নিরন্তর, বিরামহীন। চার দশকের দীর্ঘ প্রবাস জীবনে সংকট সংকুলকালেও তার ক্যানভাসের সব প্রান্তজুড়ে একমাত্র মুক্তিযুদ্ধই হয়েছে উপজীব্য বিষয়। তিনিই তাই বলতে পারেন, ‘একাত্তরে যুদ্ধ করেছি স্বাধীনতার জন্য। ...এখন যুদ্ধ করছি মানুষ হওয়ার জন্য।’
সম্প্র্রতি প্যারিসপ্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ চিত্রকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য ফ্রান্সের সম্মানজনক নাইট উপাধি পেয়েছেন। ফ্রান্সের এ সর্বোচ্চ সম্মাননায় আমরা অত্যন্ত গর্বিত। এটি দেশ এবং জাতির জন্য অত্যন্ত সম্মানের। শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ আর্ট ম্যাগাজিন ‘শিল্পপ্রভা’র জন্য একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। মূল সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন আমজাদ আকাশ। সেখানে তিনি শিল্পী হওয়ার জন্য তার একাগ্রতার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি বলেছেন শিল্পভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা। ওই সাক্ষাৎকারের কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ যুগান্তরের পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি। আমার ধারণা অনেক নবিস ও তরুণ শিল্পীরা এতে উপকৃত হবেন।
প্রবাসে থেকে শিল্পচর্চা করতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতি থেকে বলেছেন, ...ছবির জগৎটা অন্যরকম। বাইরে অনেকে যায়। অনেকে মোটামুটি নাম করেছে... অনেকে গিয়ে কিছুই করতে পারে না। দম রাখতে পারে না। আমাদের এখানে যে কিছু আর্টিস্ট আছে, তারা নদীই পার হতে পারে না। সুতরাং সমুদ্রে যাবে কী করে? এইটা আমাদের প্রবলেম। ভিত্তিটা আমাদের শক্ত নয়। শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপারটা ম্যারাথনের মতো। সেখানে অনেক ধৈর্য ধরতে হয়।...
...যেমন ধরো মেসি ইউরোপে যতই ভালো খেলুক, দেখবা আর্জেন্টিনা দলে অত ভালো খেলতে পারে না। কারণ হল, তাকে সহযোগিতা করার মতো ওখানে তেমন কেউ নেই। ...দ্যাটস মিন দলটা ঠিক না। আমাদের দেশে আর্টের ব্যাপারটা ঠিক ওইরকম... ট্যালেন্ট আছে অনেক... কিন্তু দলটা ঠিক না। ...শিল্পী-সাহিত্যিক-কবি অনেক কিছু দেখে মনে রাখে। প্রকাশ করে কাজের মাধ্যমে। আমি যে ছবি আঁকি, তা নিয়ে অনেকেই হয়তো অনেক কথা বলতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কী ভেবে আমি ছবিটা এঁকেছি তা তো আমি জানি। আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। তাই না? নিজে যদি নিজেকে ফাঁকি দেই, ইন দ্য লং রান কিছু হবে না। কাজ টিকে থাকবে না।...
...আমরা তো কোনো নতুন জিনিস করতে পারি না। একমাত্র বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন। এজন্যই তাকে রক্ত দিতে হয়েছে। বাকি সব সিস্টেম তো ব্রিটিশের।...কিছু জিনিস চেঞ্জ করতে পারলেই তো পরিবর্তন হয়ে গেল বাংলাদেশ। এ পরিবর্তনের জন্য স্ট্রং পারসন দরকার। বঙ্গবন্ধুর মতোন...”
শিল্পী হওয়ার সংগ্রামমুখর দিনগুলোর কথা মনে করতে গিয়ে বলেছেন, ...একসময় মনে হয়েছিল, আর্ট কলেজের শিক্ষক হওয়া বোধ হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যখন প্যারিস চলে গেলাম, তখন ওইখানে গিয়ে দেখি, হায় হায়, এভাবে তো শিল্পী হওয়া যায় না। চারুকলা হোক আর যা-ই হোক, এটা একটা চাকরি তো। চাকরি করে কখনও শিল্পী হওয়া যায় না। চাকরি সব সময় খেয়ে ফেলে। আমি ওইখানে দেখি যে বড় বড় শিল্পীকে, তারা কিন্তু সারা দিন ছবি আঁকে। ... তুমি যত ট্যালেন্টই হও, এক দিন, দুই দিন, তিন দিন- এক সময় পিছে পড়ে যাবে। ...আর ট্যালেন্ট আছে বলে সপ্তাহে একদিন ছবি আঁকলে কাজ হবে না। নিজের মেধাকে সজীব রাখার জন্যই প্রতিদিন চর্চা করা। সাধনা করা। রঙ নিয়ে খেলা। এটাই আমার সাধনা। রঙ যখন ধরি, ক্যানভাস ধরি। ছবি না আঁকলেও আমি আঁকি...”
মডার্ন আর্ট নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘মডার্ন আর্ট মানে এই নয় যে অবাস্তব কিছু। মর্ডান আর্ট আর ক্লাসিক হচ্ছে গাড়ি আর রিকশার মতো। দুইটারই কিন্তু মূল্য আছে। গাড়িরও যেমন প্রয়োজন আবার রিকশারও। অনেকেই রিকশা উঠিয়ে দেয়ার পক্ষে, কারণ মেইনটেইন করতে পারছি না। কিন্তু আমাদের রিকশার একটা অরিজিন্যালিটি আছে। যেটা অন্য দেশে নেই। এ অরিজিন্যালিটিটা রেখে খেলা এইটা হচ্ছে মডার্ন। তার মানে এই নয় যে, রিকশা ফেলে দিয়ে মেশিন আনলেই মডার্ন হয়ে গেলাম।
এই যে আমার পেইন্টিংয়ে স্পিড অব টাইম আছে, সেটা আগের ক্লাসিক্যাল যুগের মতো নয়। তার মানে সময় নিয়ে করলেই পেইন্টিং ভালো হবে তার কোনো মানে নেই। কম সময়েও ভালো পেইন্টিং হতে পারে। অনেকে বলে শাহাবুদ্দিন ফটাফট এঁকে ফেলে। কিন্তু খেয়াল করল না আমার সারা জীবনের শ্রম সাধনা! এটা একদিনে হয়ে ওঠেনি।
আমি মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম বলেই সমুদ্রে যাওয়া রেজিস্ট্রি করতে পেরেছি। অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। অনেক সমস্যায় পড়েছি। বিপদের শেষ ছিল না। কিন্তু দম ছাড়িনি।
বাংলাদেশের শিল্পকলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শাহাবুদ্দিন আহমেদ ভীষণরকমের আশাবাদী। তিনি বাংলাদেশের তরুণ শিল্পীদের চিত্রকর্ম নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। তার স্বপ্ন এবং বিশ্বাস বাংলাদেশের আজকের তরুণ শিল্পীরা বিশ্বশিল্পঅঙ্গন জয় করে নেবে। এবং একদিন বিশ্বশিল্পকলার নেতৃত্বে থাকবে বাংলাদেশ।
সূত্র : আর্ট ম্যাগাজিন ‘শিল্পপ্রভা’র সঙ্গে শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মূল সাক্ষাৎকার আমজাদ আকাশ। (শিল্পপ্রভা, প্রথমবর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ভাদ্র ১৪১৯)
আলোকচিত্রী রফি হক

No comments

Powered by Blogger.