মহাসড়ক সমাচার by আতাউর রহমান

আমাদের রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা প্রায়ই বলেন, ২০২১ সাল নাগাদ এই দেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। কিন্তু কবে আমরা সভ্য হব, তা কেউ বলেন না।
সম্প্রতি হাইওয়ে তথা মহাসড়ক দিয়ে নিজের গাড়িতে করে জন্মস্থান সিলেটে যাওয়া-আসার সময় কথাটা মনে পড়ল। সরকারি চাকরির সুবাদে বহু দেশ সফর করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে; কোথাও মহাসড়কের গোলচত্বরে দিকনির্দেশনাসংবলিত ফলকগুলোকে রাজনৈতিক পোস্টার ও বিজ্ঞাপন দিয়ে ঢেকে ফেলতে দেখিনি। এক জায়গায় চোখে পড়ল, দিকনির্দেশনার ফলকটি একটি চুলকানির ওষুধের বিজ্ঞাপন দিয়ে আবৃত। আমার মনে পড়ল, আমাদের ছোটবেলায় একবার গ্রামবাংলায় চুলকানির প্রাদুর্ভাব ঘটলে পল্লির চারণকবি গীত রচনা করেছিলেন: ‘ওগো সজনী, এবারকার বছর আইছে চুলকানি/ মায়ে চুলকান, বাপে চুলকান আরও চুলকায় চাকরানি/ ওগো সজনী, এবারকার বছর আইছে চুলকানি।’ এসব রোগ আমাদের দেশে এখন নির্মূলপ্রায়; কিন্তু এগুলোর তথাকথিত প্রতিষেধকের বিজ্ঞাপনের অত্যাচার থেকে বুঝি আর রেহাই পাওয়া গেল না।
সে যা-ই হোক। আজকাল প্রাইভেট কার, ট্রাক ও গণপরিবহনের যাতায়াত মহাসড়কগুলোতে ধারণাতীত বেড়ে গেছে। সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজারসংলগ্ন মসজিদে শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে প্রত্যক্ষ করা গেল উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মাজার জিয়ারতকারীদের নিয়ে আসা বাসের সুদীর্ঘ লাইন। এসব বাস ও ট্রাকের চালকেরা গোলচত্বরসমূহের দিকনির্দেশনামূলক ফলকগুলো আবৃত থাকায় ওগুলোতে দু-একবার চক্কর খেয়ে থাকবেন, এটা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। আমি নিজেই এটার শিকার হয়েছি এবং একবার তো একজন পথচারী ভুল তথ্য দিয়ে আমাদের বিভ্রান্তই করে ফেলেছিল প্রায়। প্রসঙ্গত, বিদেশে সংঘটিত এ–সংক্রান্ত কিছু সরস ঘটনা মনে পড়ে গেল:
মহাসড়ক দিয়ে মোটরগাড়ি চালনাকালে জনৈক চালকের মনে সন্দেহ হওয়ায় তিনি পথিপার্শ্বস্থ বাড়ির দাওয়ায় উপবিষ্ট বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করে সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে বেশ কিছুদূর এগোনোর পর গাড়ির আয়নায় প্রত্যক্ষ করলেন বৃদ্ধা তাঁকে হাতের ইশারায় ডাকছেন। তিনি গাড়ি নিয়ে ফিরে এসে বৃদ্ধার দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকাতেই বৃদ্ধা এবার স্মিতহাস্যে বললেন, গৃহে অবস্থানরত আমার স্বামীকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনিও আপনার প্রশ্নের উত্তর জানেন না। বারান্তরে আরেক মোটরচালক পথ হারিয়েছেন সন্দেহ হওয়ায় পথিপার্শ্বস্থ শস্যক্ষেত্রে কর্মরত কৃষককে সড়কটির পরিচয় ও সেটা কত দূর পর্যন্ত গেছে জিজ্ঞেস করে না-বোধক উত্তর পাওয়ায় ঈষৎ উষ্মার ভাব দেখিয়ে যখন মন্তব্য করলেন, ‘আপনি দেখছি কিছুই জানেন না,’ তখন কৃষক ঝটপট জবাব দিল, ‘তা বটে, তবে আমি কিন্তু পথ হারাইনি।’
আরেক মোটরচালক নিজের গাড়িতে করে দেশভ্রমণে বেরিয়ে অনেক দূর যাওয়ার পর তাঁর ইচ্ছে হলো জায়গাটার নাম জানবেন। তিনি একজন পথচারীকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘বলতে পারেন, আমি কোথায় আছি?’ প্রত্যুত্তরে সে যা বলল তাতে তিনি একেবারে থ। ‘আমাকে বোকা বানাতে পারবেন না’, লোকটি আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বলল, ‘আপনি একটি গাড়ির ভেতরে আছেন।’ পরবর্তী ঘটনাটি প্রসঙ্গে জনৈক রসিক ব্যক্তির মন্তব্য ছিল: উত্তরটি একেবারে আমাদের দেশের সংসদীয় প্রশ্নোত্তরের মতো হয়েছে। প্রথমত, উত্তরটা টু দ্য পয়েন্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দও বলা হয়নি। আর তৃতীয়ত, প্রশ্নকর্তা উত্তরের আগে যে অবস্থানে ছিলেন, ঠিক সেই অবস্থানেই রয়ে গেছেন।
তো মহাসড়কগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা ধারণাতীত বেড়ে গেছে বিধায় অচিরেই ওগুলোকে চার লেনে উন্নীত করে সড়ক-বিভাজক স্থাপন করা অত্যাবশ্যক। কেননা, আমাদের দেশের যানচালকদের মধ্যে স্বল্প পরিসরে ওভারটেকিংয়ের প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। এভাবে সামনের গাড়িকে ডিঙ্গাতে গিয়েই বিপরীত দিক থেকে ধেয়ে আসা কোনো মোটরযানের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে। এবারকার সিলেটযাত্রায় আমার গাড়িচালক আর কী গাড়ি চালাল, চালালাম তো আমিই—সর্বক্ষণ তার পেছনে সতর্ক বসে থেকে নির্দেশ দিয়ে গেলাম, ‘আস্তে চালাও’, স্পিড আর বাড়িয়ো না’, ‘এখন ওবারটেক কোরো না,’ ইত্যাদি। ইংরেজিতে এটাকেই বুঝি বলে ‘ব্যাকসিট ড্রাইভার’!
আর মানলাম, আমাদের দেশের অধিকাংশ লোকই অশিক্ষিত ও গোঁয়ার, তাই তাঁরা সড়কদ্বীপগুলোকে ওভাবে কলুষিত করে থাকেন। কিন্তু সড়ক ও জনপথ বিভাগের মাঠকর্মীরা ও হাইওয়ে পুলিশ কি ভেরেন্ডা ভাজে? এগুলো দেখার দায়িত্ব তো তাদেরই, তাই নয় কি?
হাইওয়ে পুলিশের প্রসঙ্গে আরও দুটো মজার গল্প: এক বিলেতি সাহেব স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মহাসড়ক দিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বেগে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। হাইওয়ে পুলিশ আটকালে তিনি তর্ক জুড়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনাদের রাডারের যন্ত্রাংশে ত্রুটি থাকতে পারে।’ এই পর্যায়ে ওর স্ত্রী গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বের করে পুলিশের উদ্দেশে বলে বসলেন, ‘ওর কথায় কান দেবেন না, অফিসার। ও মদ খেয়ে গাড়ি চালালে এ রকম জেদি হয়ে যায়।’ আরেক মহিলা মহাসড়কে ৬০ মাইল বেগে গাড়ি চালানোয় হাইওয়ে পুলিশ তাঁর পিছু নিল। তিনি সেটা বুঝতে পেরে স্পিড আরও বাড়িয়ে পথে সার্ভিস স্টেশন পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে তড়িঘড়ি নারীদের শৌচাগারে ঢুকে পড়লেন। খানিকক্ষণ পর বেরিয়ে এসে দুই মূর্তিমান পুলিশকে দেখে মহিলা বললেন, ‘আমি বাজি ধরতে পারি, আপনারা ভেবেছিলেন আমি টয়লেট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারব না।’
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷

No comments

Powered by Blogger.