সংসদের মাধ্যমে তদন্ত নয় -বিশেষ সাক্ষাৎকারে শফিক আহমেদ by মিজানুর রহমান খান

উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত করা-সংবলিত একটি সংবিধান সংশোধন বিলের খসড়া সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এ নিয়ে বিচার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক চলছে। এই প্রেক্ষাপটে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো:
প্রথম আলো : সংসদ বনাম বিচার বিভাগের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব কি আসন্ন?
শফিক আহমেদ : একে দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখা ঠিক হবে না। তদন্ত না করে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বিচারকের আচরণে ব্যত্যয় বা তিনি অসমর্থ হলেন কি না, তা তদন্তে কমিটি বা কাউন্সিল লাগবে। এটা বর্তমানের মতোই বিচারকের হাতে রাখতে হবে।
প্রথম আলো : আইনমন্ত্রী বলেছেন, সামরিক শাসন জায়েজ করার কারণে জিয়া বিচারকদের পুরস্কৃত করেছিলেন। এটা কি বলার সুযোগ আছে?
শফিক আহমেদ : সেটা নেই। আইন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান তো এটা পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দিলেন।
প্রথম আলো :  আপিল বিভাগ কিন্তু এটা ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে বাতিল করেছিলেন। আপনারা কী বিবেচনায় এটা ১৫তম সংশোধনীতে রেখে দিলেন? তখন কেন বাহাত্তরে ফিরলেন না?
শফিক আহমেদ : হয়তো বা আমরা তখন লক্ষ করিনি। যখন এটা নিয়ে খসড়া কমিটি বা স্থায়ী কমিটিতে বসেছি, তখন আমরা মিস করেছি। তবে আপিল বিভাগ এ বিষয়ে যখন নির্দেশনা দিলেন, তখন আমরা এটা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নে সংসদে একটা ব্ল্যাংকেট আইন করেছিলাম।
প্রথম আলো :  সংসদীয় কমিটিতে গিয়ে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ও আইনবিদ কাউন্সিলের পক্ষেই মত দেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামসহ অনেক আইনজীবী এর পক্ষে মত দিয়েছেন। আপনি কীভাবে দেখেন?
শফিক আহমেদ : আমি যেটা বলছি, তাতে কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশটাই সংসদে যাচ্ছে।
প্রথম আলো :  সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ আছে। আপনি ১৫তম সংশোধনীতে অধস্তন আদালতের বিচারক নিয়োগ ও অপসারণসংক্রান্ত ১১৬ এবং হাইকোর্টের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ, যা জিয়ার সামরিক ফরমানে ঢুকেছিল, তা কেন রেখে দিয়েছিলেন?
শফিক আহমেদ : ১১৬ অনুচ্ছেদ কি সামরিক ফরমানে ঢুকেছিল?
প্রথম আলো :  নিশ্চয়। চতুর্থ সংশোধনীতে কেবল রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা যায়। জিয়া সেটা কিছুটা উন্নত করেন, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সম্পূর্ণ ক্ষমতা, যা বাহাত্তরে ছিল, তা আর ফিরিয়ে আনলেন না কেন?
শফিক আহমেদ : এখনো এই ক্ষমতাটা কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের কাছেই ন্যস্ত।
প্রথম আলো :  তাহলে আপনি আইনমন্ত্রী থাকতেই আপিল বিভাগ তাঁদের দেওয়া দুটি রায়ে (মাসদার হোসেন মামলাতেও নির্দেশনা আছে) কেন বললেন, বাহাত্তরের ১১৬ আনতে হবে।
শফিক আহমেদ : আমার পাঁচ বছরে নিরঙ্কুশভাবে সুপ্রিম কোর্টই সব করেছেন।
প্রথম আলো :  সরকার এতটা পূতপবিত্র হলে কেন এখনো বাহাত্তরের কথা বলে অভিশংসনের ৯৬ অনুচ্ছেদ মন্ত্রিসভা খসড়া পাস করল। আর ১১৬ নিয়ে নীরবই থাকল। জিয়ার ফরমানের জোরে নিম্ন আদালতের বিচারক অপসারণে সরকারি প্রভাব ধরে রাখা হবে, আবার জিয়াকে নিন্দা করে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাটা নিয়ে নেওয়া হবে। তাই নিশ্চয় একটা অসুবিধা আছে?
শফিক আহমেদ : কোনো অসুবিধা নেই। আমার মনে হয়, বাস্তবে বাহাত্তরের ১১৬ অনুচ্ছেদেরই অনুশীলন চলছে।
প্রথম আলো :  এক-এগারোর অনেক অধ্যাদেশ শুধরে কবুল করলেন। বিচারক নিয়োগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশনটা নিলেন না। স্বচ্ছ নিয়োগ ও দায়িত্বশীল অপসারণ অবিচ্ছেদ্য বিষয় মনে করেন কি না?
শফিক আহমেদ : এটা অবিচ্ছেদ্য। আমি কিন্তু নিয়োগ নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করে এসেছি। এটা সরকারের বিবেচনাধীন আছে।
প্রথম আলো :  আইনমন্ত্রী থাকতে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নিয়ে নেবেন?
শফিক আহমেদ : প্রধান বিচারপতির লিখিত পরামর্শক্রমেই আমি এটা করে রেখে এসেছি। সুপ্রিম কোর্ট এটা গ্রহণ করেছেন। এরপর তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়।
প্রথম আলো :  এখন আপনি সরকারে নেই, এটা মানবেন কি না যে, যেসব দেশ দেখিয়ে তারা অভিশংসন আনছে, সেসব দেশে নিয়োগ কমিশন আছে। আপনি মামুলি বিধি দিয়ে করবেন বলে যে নীতিমালা চূড়ান্ত করে এসেছেন, ওটা এ যুগে অচল। আসলে নিয়োগ কমিশন গঠন এবং প্রকাশ্য শুনানি করে বিচারক নিয়োগের চল সারা বিশ্বে।
শফিক আহমেদ : আমি আপনার সঙ্গে একমত যে, একটা কমিশন গঠন করলেই ভালো হয়। ভারতে আগে কেবল কর্মরত বিচারকদের নিয়ে গঠিত কলিজিয়াম বাছাই করত। এখন কমিশন হয়েছে। আইনমন্ত্রী ও দুজন বিশিষ্ট আইনবিদকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অপসারণের বিধান পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়োগ কমিশন করলে সেটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে করি। এতে দেশের উপকার হবে।
প্রথম আলো :  কাউন্সিল গঠনের ৩৭ বছর ধরেই এটা মূলত নিষ্ক্রিয়। বিচারকের বিষয়ে দু-একবার, বাকি সাংবিধানিক সংস্থাগুলোর ব্যাপারে কখনো তারা সক্রিয় হয়নি?
শফিক আহমেদ : এটা সত্য।
প্রথম আলো :  বিচারক অপসারণে ভারতের জুডিশিয়াল কাউন্সিলে দুজন কর্মরত ও একজন বিশিষ্ট আইনবিদ নিয়ে গঠিত। বাংলাদেশে কি সুপারিশ রাখবেন?
শফিক আহমেদ : তদন্তে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পরিবর্তন আনতে মত দেব। দুজন কর্মরত বিচারকের সঙ্গে আরেকজন হবেন কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারক বা জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। পাঁচজনের কমিটিও হতে পারে। কারণ, বিচারকের অসমর্থতা রাজনীতিক বা বাইরের কেউ অধিকতর ভালো বুঝবেন না।
প্রথম আলো :  তাহলে অন্যান্য সাংবিধানিক পদধারীর ক্ষেত্রে কী বলবেন? বিচারকেরা সেটা কেন ভালো বুঝবেন বলে প্রতীয়মান হবে?
শফিক আহমেদ :না, হবে না। আইনে বলে দিতে হবে অন্যান্য ক্ষেত্রের তদন্তে উপযুক্ত বিশেষজ্ঞরা অন্তর্ভুক্ত হবেন।
প্রথম আলো :  সংসদের মাধ্যমে অপসারণের বিধানে বিচার বিভাগ ঠিক কী কারণে ভীত হতে পারে?
শফিক আহমেদ : এটা সত্যিকার অর্থে কার্যকর করা হলে বিচারকদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই; বরং তাঁদের অবস্থান আরও একটু শক্ত হবে।
প্রথম আলো :  এখন তদন্তে অসদাচরণ প্রমাণিত হলেও তা সংসদে পাস করাতে লাগবে, আবার দুই-তৃতীয়াংশের ভোট দরকার হবে। এত ভোট সব সময় পাওয়া সহজ নাও হতে পারে।
শফিক আহমেদ : একমত। আসলে অভিশংসনে তাদের সেফটিনেট আরও বাড়ছে। রক্ষাকবচ বাড়বে।
প্রথম আলো :  আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে মনে হয়েছে, তাঁরা বর্তমানের মতো কর্মরত বিচারকদের তদন্তে রাখবেন না, ভয়টা তাই সেখানে। যুক্তরাষ্ট্র ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশে রাজনীতিকেরাই তদন্ত করেন।
শফিক আহমেদ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা করা সঠিক হবে না। বিচারক ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে।
প্রথম আলো :  ক্ষুণ্ন হবে, নাকি বলবেন রাজনীতিকদের দিয়ে তদন্ত করালে বিচারকের স্বাধীনতা থাকবে না?
শফিক আহমেদ : আমি এটা অবশ্যই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারি, তদন্তে রাজনীতিকেরা থাকলে বিচারকের স্বাধীনতা থাকবে না।
প্রথম আলো :  আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিক আহমেদ : ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.