স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে শামীম ওসমানকে চাই by শাহদীন মালিক

দুঃখে কপাল চাপড়াচ্ছি। ১৩ আগস্ট চ্যানেল একাত্তরে প্রচারিত শামীম ওসমান-আইভী ‘টক শো’টা মিস করেছি। সকালে উঠে দেখি সংবাদমাধ্যম সরগরম।
দুঃখ আরেকটা, কিছু পুরোনো। মাস দুয়েক—হয়তো কিছু বেশি হয়েছে। এক টক–শোর জন্য বাসায় ক্যামেরা হাজির। অধমের বসার ঘর থেকে কিছু অংশ টক শোতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। সামনে ক্যামেরা, কানে কিছু যন্ত্রপাতি লাগানো, যাতে স্টুডিওতে টক শোর অন্যান্য অংশগ্রহণকারীর কথা শোনা যায়। আমি অবশ্য দেখতে পারছি না অন্যদের। অনুষ্ঠান শুরুর দু-তিন মিনিট কিছু শুনতে পাইনি। বুঝতে পারিনি স্টুডিওতে অন্য কে কে অংশ নিচ্ছেন।
মাঝখান থেকে কানে লাগানো যন্ত্রে যখন কথাবার্তা শোনা শুরু হলো, ততক্ষণে অনুষ্ঠান চলছে। তিন-চার মিনিট লেগে গেল অনুধাবন করতে যে টক শোটিতে স্টুডিওতে আছেন খোদ শামীম ওসমান।
ওরে বাবা!
অধমের বাসায় চ্যানেলটির যে ক্যামেরাম্যান এবং আরও কর্মী এসেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলাম—বাবারে, আমি নাই। ফলে নিজের বাসাতেই ক্যামেরার সামনে থেকে দৌড়ে বাসার অন্য রুমে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। পরে শুনেছি, অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক নাকি বলেছিলেন যে অধম হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারছেন না।
আইভী সাহসী, অত্যন্ত সাহসী। অধমের মতো ভোঁ-দৌড় দেননি, নিজ বাসাতেই। দু-একটা চ্যানেল আছে, যারা খবরের নিরপেক্ষতার স্বার্থে বারবার শামীম ওসমানকে টক শোতে ডাকে। সব সময় আবার সবাইকে বলেও না যে মাননীয় সাংসদ অনুষ্ঠানটিতে থাকবেন। তাই রিস্ক এড়াতে ও রকম দু-একটা চ্যানেলের কোনো টক শোতেই যাই না। বলা তো যায় না, যদি তাঁর সামনে পড়ে যাই। আমি বরাবরই অত্যন্ত ভীতু প্রকৃতির।

২.
একাত্তর পুনঃপ্রচার করবে কি না জানি না, তবে ধারণা করছি ইউটিউবে সবাই দেখছে।
দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাই। আছেন প্রতিমন্ত্রী। অতএব, পূর্ণ মন্ত্রী তো দরকার।
মন্ত্রীর পদত্যাগ চাইবার পরিবর্তে এবার অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে করজোড়ে নিবেদন—মাননীয় সাংসদ শামীম ওসমানকে আপনার মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়ে আমাদের ধন্য করুন।
বলা বাহুল্য, কে ফুল মন্ত্রী, হাফ মন্ত্রী বা সিকি মন্ত্রী হবেন, সেটা অতি অবশ্যই অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব ব্যাপার। তাই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তবে আমরা সুশীলরা যেহেতু সর্বক্ষণ মন্ত্রীদের পদত্যাগ চাওয়ার দোষে দুষ্ট, তাই সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তের কারণেও এবার পদত্যাগের বদলে নিয়োগ চাইছি।
আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর খালি পদের জন্য শামীম ওসমান থেকে যোগ্যতর ব্যক্তি এখন আর কে-ই বা আছেন।
কারণ দর্শাই, আশা করি অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন গলবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে ওসমান পরিবারকে বিপদে-আপদে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা আমরা সবাই জানি। আওয়ামী লীগের জন্য ওসমান পরিবারের অবদান কিংবদন্তিপ্রায়। ষাটের দশকেরও বেশি সময় ধরে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের ঝান্ডা উঁচিয়ে রেখেছে এই ওসমান পরিবার। আওয়ামী লীগের জন্য প্রয়োজনে ছল, বল, কৌশল—অর্থাৎ চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, খুন, দখল, টেন্ডারবাজি সবই করতে হয়েছে এই পরিবারকে। প্রয়োজনে নির্বাচনে ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। আবার ভোটাররা ভোট না দিলেও ফলাফলে তাঁদের জয় ঠিকই হয়েছে। আওয়ামী লীগের মিটিং-সিটিংয়ে বাস-ট্রাক ভর্তি করে লোক জোগান দেওয়ার নির্ভেজাল ঐতিহ্য বহু দশকের।
দ্বিতীয় গুণ হলো, সারা দেশের লোক শামীম ওসমানকে এক নামে চেনে। প্রথম আলোর হার্ডকপি–সফটকপি মিলিয়ে প্রতিদিনের যে লাখ পঞ্চাশেক পাঠক, তাঁদের বেশির ভাগ শামীম ওসমানকে নিশ্চয় চেনেন আরও অনেক বেশি, প্রথম আলোয় বারবার তাঁর গুণকীর্তনের কারণে।
বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে বর্তমান মন্ত্রিসভার অর্ধশতাধিক মন্ত্রীর মধ্যে আধা ডজনের নামও বোধ হয় দেশের শতকরা ২০ ভাগ জনগণ বলতে পারবে না।
‘খবিশ’ বলা বা সভায় ঘুমিয়ে থাকা, স্থান-কাল না বুঝে যত্রতত্র ধূমপান করা ইত্যাদি কারণে এক সৈয়দ মন্ত্রীর নাম পুরোটা না হলেও আংশিক আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। ধারণা করছি, মুরব্বি একজন ‘রাবিশ’ বলে যে খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে ‘খবিশ’ বলে খ্যাতিমান হতে চাইছেন এই নতুন মন্ত্রী।
খাদ্যমন্ত্রীকে খাদ্য নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুনিনি। তবে ‘খ’ অক্ষরটা নিশ্চয় তাঁর অতি প্রিয়। কারণ, তাঁর সব বক্তব্যের মূলেই ‘খ’ অর্থাৎ খালেদা জিয়া।
মোদ্দাকথা, শামীম ওসমান মন্ত্রী হলে আপনার পর অন্তত একজন মন্ত্রীর নাম দেশসুদ্ধ লোক অতি সহজেই মনে রাখতে পারবে। আপনার মন্ত্রিসভার খ্যাতি বৃদ্ধি হবে।
বিএনপির আন্দোলনের হুমকি-ধমকিতে ভীত হওয়ার কোনো কারণই নেই। তবু আগে থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা-পদক্ষেপ নেওয়া বিচক্ষণতার লক্ষণ। অথবা আগে থেকেই সাবধান হওয়া শ্রেয়।
বিএনপি যদি আসলেই আন্দোলনে নামতে পারে, তাহলে তাদের ঠেঙানোর জন্য শামীম ওসমানের চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তি সারা দেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। একসময় জয়নাল হাজারী, ইদানীং নিজাম হাজারী ইত্যাদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদের জন্য দরখাস্ত করতে পারতেন। কিন্তু ইদানীংকালের কীর্তিকলাপের আলোকে শামীম ওসমানের কাছে কেউ পাত্তাই পাবেন না।
অতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! অধমের নিবেদনটা অন্তত মিনিট দুয়েক বিবেচনা করলেই অধমের যুক্তি উপেক্ষা করতে পারবেন না। শামীম ওসমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কথাটা রটে গেলেই সব বিএনপি-জামায়াত নিমেষেই উধাও হয়ে যাবে। রাজপথ তো বহু দূর, কোনো ফুটপাতেও তাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আর কুল্লে একটা উদাহরণ টেনে শেষ করব। গতবার খালেদা জিয়ার বাড়ি ঘেরাও করতে চার-পাঁচটা ট্রাক লাগানো হয়েছিল। নচ্ছার সাংবাদিকেরা সেই চার-পাঁচটা ট্রাক টপকিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথোপকথন করতে পেরেছিলেন। এখন শামীম ওসমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হলে নিমেষেই নারায়ণগঞ্জের অন্তত অর্ধেক বাস-ট্রাক দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি নয়, জামায়াত-বিএনপির যত অফিস, নেতাদের বাসা—সবই ঘিরে ফেলার জন্য একটা ওসমান পরিবারই যথেষ্ট।
শুরুতেই বলেছি, আইভী অনেক সাহসী। সাহসী বলেই বেশির ভাগ নারায়ণগঞ্জবাসী তাঁকে নেতা মানে। শামীম ওসমানের ধমকে-হুমকিতে তিনি কখনো ভীত হননি, হবেনও না। কিন্তু অধম এবং অধমের মতো অনেকেই হয়তো আইভীর মতো সাহসী না। তাই শামীম ওসমানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বানালে ভয়ে আমরাও গর্তে ঢুকে যেতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী! আপনি নিশ্চয় সমালোচকহীন দেশ চালাচ্ছেন। আপনার সেই উদ্দেশ্য সফল করতে শামীম ওসমান বড় বেশি সহায়ক হবে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আপনার প্রয়োজন শামীম ওসমানকে এবং তাঁর মতো আরও অনেক ওসমান। যুক্তির ফিরিস্তি দীর্ঘায়িত করব না। আগামী সপ্তাহে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শামীম ওসমানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দাওয়াতের অপেক্ষায় রইলাম।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট; অধ্যাপক ও পরিচালক, স্কুল অব ল, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি।

No comments

Powered by Blogger.