ভোটের রাজনীতিতে তারকারা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য রাজনীতিতে চিত্রতারকা ও খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ নতুন নয়। ইদানীং মনে হয় বেড়েছে। এটা রাজনীতির সুস্থ লক্ষণ নয়। এবার ভারতের লোকসভা নির্বাচনে চিত্রতারকা ও অন্যান্য সেক্টরের তারকাদের অংশগ্রহণ বেশ বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও নির্বাচনে তারকাদের অংশগ্রহণ বেশ চোখে পড়ার মতো। এর ইতি-নেতি দুটো দিকই আছে৷ আমাদের আশঙ্কা, পশ্চিমবঙ্গের এই প্রবণতা ভবিষ্যতে বাংলাদেশেও আসতে পারে। নানা কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির ও নেতাদের মানও নেমে গেছে। ৪০ বছর আগে ‘রাজনীতিবিদ’ বা ‘এমপি’ বলতে যাঁদের বোঝাত, এখন সে রকম লোক প্রায় নেই বললেই চলে। রাজনীতি বা এমপি পদ এখন ব্যবসায়ী, গডফাদার, কালোটাকার মালিক ও নেতাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে তা পুরোপুরি নয়। হয়তো এখনো বড় দলগুলোর একটা ক্ষুদ্র অংশ দেশের স্বার্থে রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন, বাকিরা ব্যক্তিস্বার্থে।

আগেই বলেছি, তারকাদের রাজনীতিতে আসার দুটো দিক রয়েছে। ইতিবাচক দিক হচ্ছে: চিত্রতারকা বা অন্য জগতের তারকারা জীবনের একটা পর্যায়ে ‘দেশের সেবা’ করার জন্য মন স্থির করেছেন। অন্য দশজন সাধারণ নেতার চেয়ে তারকারা অনেক কার্যকরভাবে দেশের সেবা করতে পারবেন। কারণ, তাঁদের কথা মানুষ শুনবে। তাঁরা সাধারণ মানুষকে অনেক বেশি প্রভাবিত করতে পারেন। রাজনীতি বা নির্বাচনে যুক্ত না হলে তাঁরা শুধু অবসর সময়ে তারকা খ্যাতির রোদ পোহাতেন, অথবা ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতেন (যদি থাকে)। অভিনয় বা খেলোয়ািড় পেশার মধ্য সময়ে কেউ রাজনীতি বা নির্বাচনে যুক্ত হন না। সাধারণত অবসর নেওয়ার পরে তাঁরা রাজনীতি ও নির্বাচনে যুক্ত হন।
নেতিবাচক দিকটাই আমাদের প্রধান আলোচ্য। রাজনীতি করাকে আমরা দেশসেবা বলে বিবেচনা করি। আশা করি, ভারত বা পশ্চিমবঙ্গেও সেভাবেই বিবেচনা করা হয়। রাজনীতি একটা প্রক্রিয়া ও শৃঙ্খলা। একটা দলের ভেতর থেকে রাজনীতি করতে হয়। কিন্তু দেশসেবা বা সমাজসেবার জন্য কোনো দলের প্রয়োজন হয় না। একটা ছোট ক্লাব করেও সমাজসেবা করা যায়। এমনকি একক উদ্যোগেও তা করা যায়।
এবার ভারতের লোকসভার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের অনেক তারকা বিভিন্ন দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। অনেকে জয়লাভও করেছেন। যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন: জাদুকর পিসি সরকার (জুনিয়র), অভিনয়শিল্পী মুনমুন সেন, সন্ধ্যা রায়, শতাব্দী রায়, তাপস পাল, দেব, জর্জ বেকার, কণ্ঠশিল্পী ইন্দ্রনীল সেন, বাপ্পী লাহিড়ী, বাবুল সুপ্রিয়, ফুটবল তারকা বাইচুং ভুটিয়া, নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ প্রমুখ। এর আগে অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়, কণ্ঠশিল্পী কবীর সুমনও নির্বাচন করেছিলেন। কবীর সুমন নির্বাচিতও হয়েছিলেন। এবারও অনেকে নির্বাচিত হয়েছেন। ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও কয়েকজন জনপ্রিয় তারকা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
রাজনীতিতে যোগ দেওয়া, দল করা আর পার্লামেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক কথা নয়। হাজার হাজার ব্যক্তি প্রতিবছর রাজনীতিতে যোগ দিচ্ছেন। বড় দলগুলোর রয়েছে লাখ লাখ সমর্থক ও সদস্য। সেখানে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন মাত্র কয়েক শ ব্যক্তি। নির্বাচনে মনোনয়নদানের ব্যাপারটি নানা কারণে এখন কলুষিত হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশে যেমন তেমনি ভারতবর্ষেও। ভারতের বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনেক খুনি, সন্ত্রাসী, গডফাদারও নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। এমনকি অনেকে নির্বাচিতও হয়েছেন।
চিত্রতারকা বা অন্য জগতের তারকারা যদি রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে না দিতেই নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে যান, তাহলে ত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের মনোনয়ন পাওয়া সামনে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। একজন রাজনৈতিক নেতার লক্ষ্য থাকে তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। সেই লক্ষ্যে তিনি বহু বছর ধরে দলের জন্য কাজ করে যান। সেখানে হঠাৎ মুনমুন সেন বা দেব যদি নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে যান, তাহলে ত্যাগী নেতাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। আমাদের দেশেও এই প্রবণতা জেঁকে বসতে পারে।
চিত্রতারকা বা অন্য জগতের তারকাদের রাজনীতি করা বা নির্বাচনে দাঁড়ানো দোষের নয়। যাঁরা রাজনীতি করতে চান বা নির্বাচন করতে চান, তাঁদের উচিত সমাজের জন্য কাজ করা। দলের জন্য কাজ করা। বিশেষ করে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করা। বছরের পর বছর সেই কাজ করা উচিত। নির্বাচনী এলাকার জনগণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ গড়ে তোলা উচিত। অন্তত ১০ বছর এ রকম কাজ করলে তিনি নির্বাচন করার যোগ্য বিবেচিত হতে পারেন। নির্বাচন কমিশনের আইনে নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেক তারকা নির্বাচন করার সুযোগ পাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের এ রকম একটা আইন থাকা উচিত ছিল: ‘প্রার্থীকে নির্বাচনী এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।’ শহরের নেতা যেন গ্রামে গিয়ে প্রার্থী হতে না পারেন। এ রকম একটা আইন থাকলেই আমাদের নির্বাচন, পার্লামেন্ট ও রাজনীতিতে অনেক গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব হতো।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে এবার অনেক ‘তারকা’ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এ ব্যাপারে পশ্চিম বাংলার মানুষ সবাই খুশি হননি। অনেকে এতে বিরক্ত হয়েছেন। তারই প্রকাশ দেখি পাক্ষিক দেশ পত্রিকার চিঠিপত্র বিভাগে (১৭ এপ্রিল ২০১৪)। কয়েকটি উদ্ধৃতি: পাঠকেরা লিখেছেন: ১. ভোটের রাজনীতিতে যেসব সেলিব্রিটি অবতীর্ণ হয়েছেন, তাঁরা রাজনীতির চর্চা বা শিক্ষানবিশি, কোনোটাই গুরুত্বসহকারে করেননি। এ যেন ক্রিকেট আইপিএলের রাজনৈতিক সংস্করণ। ২. যদি রাজনীতিজ্ঞানশূন্য প্রার্থীরা নির্বাচকমণ্ডলীর আবেগ ব্যবহার করে বাজিমাত করে ফেলেন, তা কি গণতন্ত্র বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে? সাংসদ ও বিধায়কেরা যদি ‘দিদি নম্বর ওয়ান’ আর ‘ডান্স বাংলা ডান্স’ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে রাজনীতিটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সিরিয়াস পলিটিকস বলে আর কিছু থাকে না। ৩. এদিকে যাঁরা বছরভর মানুষের আপদে-বিপদে শামিল হয়ে মানুষের জন্য কাজ করেন, মানুষের সুখ-দুঃখের ভাগী হয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাতদিন এক করে ফেলেছেন, তাঁরা দলে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েছেন। তাঁদের ফলানো ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছেন বসন্তের কোকিলেরা।
এই কয়েকটি মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় পশ্চিম বাংলার মানুষ তারকাদের নির্বাচন করাকে কীভাবে দেখেছেন।
আমাদের দেশের সংসদে ৪৫টি ‘সংরক্ষিত মহিলা আসন’ রাজনীতিকে আরও দূষিত করেছে বলে মনে করি। এই আসনগুলোতে মনোনয়ন দেওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। দলের নেতা বা নেত্রীর ইচ্ছায় বা দলের নীতিনির্ধারকদের ইচ্ছায় এই আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়। সাংবাদিক শফিক রেহমান তাঁর যায়যায়দিন সাপ্তাহিকে (অধুনালুপ্ত) একদা একে অভিহিত করেছিলেন: ‘ত্রিশ সেট অলংকার’ নামে। (তখন আসনসংখ্যা ৩০ ছিল।) এই সংরক্ষিত মহিলা আসন আমাদের সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করেছে। এ ব্যাপারে প্রধান দলগুলো নির্বিকার।
আমাদের দেশেও আজকাল বড় দুই-তিনটি দলে টাকার বিনিময়ে ও আত্মীয়তার জোরে অনেকে নির্বাচনে মনোনয়ন পান। এটা ‘মনোনয়ন–বাণিজ্য’ নামে অধিক পরিচিত। এই প্রবণতার কারণে অনেক ‘তারকা’ দলের জন্য কাজ না করে বা নির্বাচনী এলাকায় কাজ না করে মনোনয়ন পেতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এটা সুস্থ প্রবণতা নয়। এই প্রবণতা পরিহার করা উচিত।
আমাদের দেশে চিত্রতারকাসহ নানা ক্ষেত্রে অনেক তারকা রয়েছেন। তাঁরা যদি সমাজসেবায় এগিয়ে আসতেন, দেশের অনেক উপকার হতো। কণ্ঠশিল্পী মমতাজ, চিত্রনায়িকা ববিতা, চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন এ ব্যাপারে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁদের কাজের কথা আমরা অনেক দিন থেকে জানি। হয়তো আরও অনেক তারকা নীরবে-নিভৃতে কাজ করছেন, আমরা জানি না। গ্রামে আত্মীয়দের মধ্যে দান-খয়রাত করাকে এখানে আমরা ‘বড় কাজ’ হিসেবে দেখছি না। বড় কাজ হলো সেটাই, যা বহু মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনে। ব্যাপক মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। অনেক চিত্রতারকা সমাজসেবা করার কথা ভাবেন। কিন্তু জুতমতো কাজের সন্ধান পান না। তাঁদের বুদ্ধি দিয়ে সহযোগিতা করা উচিত।
বহু পথ আছে সমাজসেবার। সব সমাজসেবার লক্ষ্য রাজনীতি বা নির্বাচন নয়। তবে যাঁরা দীর্ঘদিন যাবৎ বড় মাপের সমাজসেবা করছেন, রাজনীতি বা নির্বাচন করার অধিকার তাঁদের রয়েছে। তাঁরাই রাজনীতি ও নির্বাচনের যোগ্য। ‘উড়ে এসে জুড়ে বসার’ নির্বাচনী সংস্কৃতির আমরা বিরোধিতা করি। এবারের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ একটা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই কুদৃষ্টান্ত দ্বারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল ও তারকারা যেন প্রভাবিত না হন।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী৷

No comments

Powered by Blogger.