নতুন লক্ষ্যে ভারত

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবারই প্রথম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করল। এ নির্বাচনে আগের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল কংগ্রেস নিম্নকক্ষে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছে, ফলে তারা অতীতের ছায়ায় পরিণত হয়েছে। এ নির্বাচনে ভারতের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতিই নির্বাচনী প্রচারণায় বিজেপির তুরুপের তাস হিসেবে কাজ করেছে, আগামী দিনে ভারতের বিদেশনীতিতেও তা একটি বড় পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মোদ্দা কথা, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের সন্দিগ্ধ ও ভীরুতাপূর্ণ নীতির যুগ শেষ হলো, যা প্রায় পক্ষাঘাতগ্রস্ততার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ভারতের নতুন সরকারের সামনে বহিঃস্থ চ্যালেঞ্জের কমতি নেই। ইউপিএ সরকার ২০০৪ সালে ক্ষমতায় এসে জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতিতে আগের বিজেপি সরকারের গৃহীত ইতিবাচক অবস্থানকে লক্ষ্যহীনভাবে বিনষ্ট করেছে। বিজেপি সরকার যে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা করেছিল, সেগুলোকে তারা অবহেলা করেছে। ইউপিএ জোটের ভেতরে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে এটা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্টের বিরোধিতার কারণে ইউপিএ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়ন করেনি। অথচ এই চুক্তির বাস্তবায়ন যথেষ্ট দ্রুত গতিতেই চলছিল। একই সঙ্গে তাঁরা ‘নিউক্লিয়ার লায়াবিলিটি বিল’কেও ক্রমাগতভাবে খাটো করেছে। বাস্তবে এই বিল এখনো নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে আছে। মোদিকে শিগগিরই তা শোধরাতে হবে।
সাহসী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে মোদির বেশ সুবিধাই হবে, কারণ সংসদে বিজেপি বড় ধরনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে (বিজেপি নিজেই পেয়েছে ২৮২টি আসন, জোটভুক্ত অন্য দলগুলো পেয়েছে আরও ৫০টি আসন)। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কি তাঁর রাজনৈতিক পুঁজি কাজে লাগিয়ে ভারতের স্বার্থ এগিয়ে নিয়ে যাবেন? মোদির সরকার একটি জোরালো আন্তর্জাতিক অবস্থান নিলেও তা যেন ঘুণাক্ষরেও কোনো নিরপেক্ষ জায়গায় না যায়, সে বিষয়ে তাঁর সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। এমনকি ‘কৌশলগত নিজস্বতা’র নীতিও নেওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঐক্যের ক্ষেত্রেও তাঁকে বৈশ্বিক ধারা অনুসরণ করতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতি মোদির কার্যক্রমের একটি বড় অংশ দখল করে থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। সর্বোপরি, ভারতের আন্তর্জাতিক বিশিষ্টতা অর্জিত হয়েছে দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে। ভারতের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পাশের বাড়ির প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। মোদি ইতিমধ্যে বলেছেন, তিনি সার্ককে একটি ‘ক্রিয়াশীল সংস্থা’ হিসেবে দেখতে চান, কংগ্রেস সরকারের আমলে যেটা অনেকাংশেই ঝিমিয়ে পড়েছিল। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অকারণে তলোয়ার ঘোরানো বন্ধ করতে হবে, আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এ যুক্তিতেই তিনি হয়তো তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফসহ সার্ক নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেটা করতে হলে মোদিকে আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করতে হবে, ব্যক্তিপর্যায়ে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ছাড়া নিশ্চিত করা যাবে না। এ অঞ্চলে এটা কঠিনই বটে, কারণ ভারত-পাকিস্তানসহ পুরো অঞ্চলেই বহুদিনের বিরাজমান উত্তেজনা ও রাষ্ট্রীয় মদদে পরিচালিত সন্ত্রাস এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। ভারত-চীনের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধের কারণে বিষয়টি আরও খারাপের দিকে যাবে।
কাছাকাছি মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে চলমান ডামাডোলও এতে তেল-জল জোগাবে। ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাত গুটিয়ে নেওয়ায় পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। সে কারণে ভারতের নিরাপত্তা পরিস্থিতি এ মুহূর্তে সহযোগিতা ও ঐক্যের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। আরও উজ্জ্বল ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য মোদিকে কৌশলের দিক থেকে একটি সুচারু ও বিশ্বাসযোগ্য জায়গায় যেতে হবে। সন্ত্রাসী ও তাঁদের মদদদাতাদের প্রতি কোনো সহনশীলতা দেখানো চলবে না, যাকে বলে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে হাত গুটিয়ে নেওয়ার ফলে ভারতকে তার নিজ স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে—যেমন ‘ব্লু ওয়াটার’৷ নৌসক্ষমতা গড়ে তুলে ভারতের জ্বালানি বাণিজ্যের নৌপথের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আসিয়ানের সদস্যভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়ন করতে হবে, কংগ্রেস সরকার যেটা করতে বরাবরই অনাগ্রহী ছিল। আঞ্চলিক সম্পর্ক সুস্থিত জায়গায় আনতে গেলে এর বিকল্প নেই। আসিয়ান ও এর সদস্য দেশগুলোসহ আরও ছয়টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত ‘রিজিয়নাল কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ’-এ ভারতের অন্তর্ভুক্তি সঠিক লক্ষ্যেই হয়েছে, তবে আরও বহুদূর যেতে হবে। কিন্তু ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব হচ্ছে মর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। সমস্যা হচ্ছে, ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বিষয়টি ধরতে পারেননি, ফলে সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টিসহ ভারতকে এর জন্য কঠিন মূল্য দিতে হয়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোদির সম্পর্কও ভালো নয়, কারণ, ওই দেশটির কর্তারা গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক মুসলমান মারা যাওয়ার ঘটনায় মোদিকে ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। মোদি সে সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
এ দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রাখলে, মোদিকে অবশ্যই সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করতে হবে, যত শিগগির সম্ভব। ভারত-মার্কিন বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক তাঁকে চাঙা করতে হবে। বিশেষত ভারতের দুর্বল বুদ্ধিবৃত্তিক-সম্পদ সুরক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ও ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির দুনিয়ায় মার্কিন অভিবাসন আইন সংস্কার নিয়ে যে ভীতি কাজ করছে, এ দুটো বিষয়ের ওপর তাঁকে কাজ করতে হবে। উভয় পক্ষের ধৈর্য ও আপসকামী মনোভাবের ওপর সফলতা নির্ভর করছে। আস্থা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা আরও জোরদার হবে। ভারত কিছু কাজ করতে পারে, যেমন কর ব্যবস্থার বাস্তব সংস্কার সাধন ও ‘ট্রান্সফার প্রাইসিং’ এবং অতীতের জন্য আরোপিত করের বিধান বাতিল করা। মোদির পররাষ্টনীতির ক্ষেত্রে শেষ বাধা হচ্ছে রাশিয়া। এ দেশটিকেও মনমোহন সিং সরকার উপেক্ষা করেছে। পুতিনের প্রশাসন ক্রমেই ভীষণ আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠছে৷ এ প্রক্ষাপটে সেই দেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হবে তা নিরূপণ করতে হবে। আর পুতিন যে এশিয়ায় চীনকে একমাত্র কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখছেন তা মোটেও ভারতের জন্য সুবিধাজনক নয়, এটা মোদিকে বুঝতে হবে। রাশিয়া, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হলে অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা শিল্পে বিদেশি বিনিয়োগ হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে, আরও বেশি হারে যৌথ উৎপাদনের সুযোগ রেখে এটা করা যেতে পারে। আর সেটা হলে, জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও জাপানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও একই নীতি কেন নেওয়া হবে না? নিঃসন্দেহে পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে মোদির সামনে অনেক বড় বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু একটি স্বচ্ছ, আত্মবিশ্বাসী ও আস্থা বৃদ্ধিকারী নীতির মাধ্যমে তিনি ভারতকে শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে বহুদূর নিয়ে যেতে পারেন—তাঁর সামনে এটা এক বিরল সুযোগই বটে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০১৪, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
যশোবন্ত সিং: ভারতের সাবেক অর্থ, পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.