দ্বিজেন দা: ৮৫ বছরের যুবক by হায়াৎ মামুদ

এই লেখা লিখতে বসার আগে কখনো হিসাবের তোয়াক্কাই রাখিনি যে দ্বিজেন দা-র বয়স কত হলো৷ যাঁর তাগিদে লিখছি, আমার সেই পুত্রতুল্য মশিউল আলম ববিই মনে করিয়ে দিল—পঁচাশিতে পা দিয়েছেন দ্বিজেন কাকা, তাঁকে নিয়ে কিছু করণীয় কি আমাদের নেই?
আলবত আছে, লক্ষবার আছে৷ কে বলেছে, নেই!
দ্বিজেন দা মানে দ্বিজেন শর্মা৷ তিনি সকলেরই দ্বিজেন দা৷ শুধু ‘দ্বিজেন’ বলে ডাকার লোক দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ এই সেদিন আনোয়ার ভাইও চলে গেলেন৷ ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ও খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক আলী আনোয়ার (১৯৩৫-২০১৪)৷ আমাদের সৌভাগ্য ও অপরিসীম খুশির কারণ যে তিনি চলে যাওয়ার আগে তাঁর সাহিত্য-সংস্কৃতি নানা ভাবনা (জুলাই ২০১৩: বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড) প্রবন্ধ-সংকলনটি দেখে যেতে পেরেছেন৷ দ্বিজেন দা ও আনোয়ার ভাই প্রায় সমবয়সী ছিলেন, বছর ছয়-সাতের পার্থক্য ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না৷
দ্বিজেন দা আর দেবী বৌদিকে চিনি, সে কি আজ থেকে? মনে হয় যেন অনন্তকাল৷ তেজগাঁও তেজকুনিপাড়ায় যখন তাঁরা থাকতেন, গত শতকের ষাটের দশকে, আলাপ-পরিচয় হয় আনোয়ার ভাইয়ের বদৌলতে৷ সে আমলে দ্বিজেন দা-র একটি মোটরসাইকেল ছিল৷ উদ্ভিদবিজ্ঞান পড়াতেন নটর ডেম কলেজে আর সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে৷ মেয়েদের কলেজটি তখন ছিল পুরান ঢাকার লালকুঠিতে, ফরাশগঞ্জ এলাকায়৷ গেন্ডারিয়ায় আমাদের বাড়ি থেকে তেমন দূরে নয়৷ যেদিনই ক্লাস থাকত, সেদিন দুপুরে আমার কাছে চলে আসতেন৷ অতঃপর একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ, গল্পগুজব ও দিবানিদ্রা৷
দেবী বৌদি বেশির ভাগ সময় থাকতেন তাঁর বাপের বাড়ি, বরিশাল শহরের বগুড়া রোডে; তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাইনাল পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছেন৷ পরে দ্বিজেন দা যখন মস্কোয় প্রগতি প্রকাশনে অনুবাদকের চাকরি করছেন, বৌদি তখন এম.গে.উ (অর্থাৎ মস্কো রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি করেন৷

দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় তাঁর লেখার মাধ্যমে৷ তখনো ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি৷ আমি বিশ শতকের ষাটের দশকের কথা বলছি৷ আবদুল্লাহ আল মুতী আর দ্বিজেন শর্মা ব্যতীত বিজ্ঞানে প্রশিক্ষিত আর কেউ প্রবন্ধ লিখতেন না সম্ভবত৷ অধ্যাপক আলী আসগর তখনো লিখতে শুরু করেননি৷
আরও একজন লিখতেন বটে—এবনে গোলাম সামাদ; পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দেন এবং প্রগতিপন্থা ছেড়ে ক্রমশ প্রতিক্রিয়াশীলতার হাত অাঁকড়ে ধরেন, কেন জানি না৷
বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ঈর্ষণীয় বাংলা লেখায় পারঙ্গমতা, আমার বিবেচনায়, দ্বিজেন শর্মা ছাড়া বাংলাদেশে আর কেউ দেখাতে পারেননি৷ তাঁর বাংলা লেখার বাগ্বৈদগ্ধ্য, যথাযথ শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাসের শিল্পিতা, বক্তব্যের স্পষ্টতা পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে৷ তাঁর রচনার প্রসাদগুণ এমনই যে শুরু করলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া যায় না৷ মস্কোয় প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন দীর্ঘ দুই দশক৷ সে-জীবন নিয়েও তাঁর স্মৃতিচারণিক গ্রন্থ রয়েছে৷
কিন্তু ইত্যাকার কৃতি ও কৃতিত্বের বাইরেও একজন রয়েছেন: ব্যক্তিমানুষ দ্বিজেন শর্মা৷ শ্রীহট্টের মানুষ হওয়ায় মৌখিক আলাপচারিতায় সিলেটি টান টুকটাক এখনো আছে বটে৷ তবু, গল্প যখন করেন স্নিগ্ধতা ভরে থাকে৷
কারও বিরুদ্ধে কোনো বিদ্বেষ পুষে রাখতে তাঁকে দেখিনি৷ কায়িক পরিশ্রম করা খুবই পছন্দ করেন, আলসে স্বভাবের বিন্দুমাত্র নন৷ এসব অবশ্য বোঝা যায় তাঁর ধড়ের কাঠামো দেখলে৷ পঁচাশি বছরের যুবক বললে কেউ দোষ ধরবে না৷
আমরা এ রকমই যুবক দেখতে চাই দ্বিজেন দা-কে৷ সব সময়৷
হায়াৎ মামুদ: সাহিত্যিক৷

No comments

Powered by Blogger.