লাল দাগ অতিক্রম কোরো না by ফারুক ওয়াসিফ

গুলি বর্ষিত হলো একজনের প্রতি, অথচ আহত হলো তিন শক্তি৷ পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মিরের শরীরে রয়ে যাওয়া তিনটি গুলি যেন পাকিস্তানের তিন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আহত হওয়ার প্রতীক৷ পরিণতিতে পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার, সেনাবাহিনী এবং গণমাধ্যমই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ তবে সরকার ও সেনাবাহিনী তাড়াতাড়ি সমঝোতা করে নিলেও গণমাধ্যমের অবস্থা শোচনীয়৷ তারা বিভক্ত, কোন্দলরত এবং ভীত৷

গত ১৯ এপ্রিল পাকিস্তানের করাচি শহরে অজ্ঞাত আততায়ীদের গুলিতে আহত হন দেশটির জনপ্রিয় জিয়ো চ্যানেলের উপস্থাপক আলোচিত সাংবাদিক হামিদ মির৷ এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর ছোট ভাই সাংবাদিক আমির মির পাকিস্তানের বিপুল ক্ষমতাশালী সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে এর জন্য দায়ী করেন৷ এর কিছু পরে হামিদ মির সরাসরি আইএসআইয়ের প্রধান লে. জেনারেল জহির-উল ইসলামকে এই হত্যাচেষ্টার জন্য অভিযুক্ত করেন৷ জিয়ো টিভিতে পরের আট ঘণ্টা এই অভিযোগের সংবাদের সঙ্গে জহির-উল ইসলামের ছবিও দেখানো হয়৷ পাকিস্তানে আইএসআই ও তার প্রধানকে এভাবে চ্যালেঞ্জ করা অভূতপূর্ব ঘটনা৷
পাকিস্তানে নিয়মিতভাবেই সাংবাদিক হত্যা হয়ে থাকে৷ গত তিন মাসেই খুন হয়েছেন তিনজন সাংবাদিক। গত বছর খুন হন সাতজন। তার আগের বছর নয়জন। গত এপ্রিলে দেশটির আরেক প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক রাজা রুমিকেও একইভাবে হত্যার চেষ্টা হয়৷ রিপোর্টার্স সান ফ্রন্টিয়ার্সের হিসাবে, পাকিস্তান সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে দ্বিতীয়, এক নম্বরে আছে যুদ্ধপীড়িত সিরিয়া। কমিটি ফর প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৭৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন সেখানে৷ হামিদ মিরের ওপর আক্রমণ আচানক না হলেও তাঁর মতো জনপ্রিয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিকে হত্যার চেষ্টা থমকে যাওয়ার মতোই ব্যাপার৷
এসব ঘটনায় দেশটির সিভিল-মিলিটারি এবং মিলিটারি-মিডিয়া সম্পর্কে গভীর ফাটল বেরিয়ে পড়ে৷ নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ আমলে গণতন্ত্রের কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে যে ধারণা করা হচ্ছিল, সেই উন্নতির গুমরও ফাঁস হয়ে যায়৷ ফলে সামরিক–বেসামরিক দাগের এপার-ওপারে ভাগ গভীরতর হয়৷
জিয়ো টিভির তরফে আইএসআই ও তার প্রধানকে অভিযুক্ত করে সংবাদ প্রচারের প্রতিক্রিয়ায় আইএসআইও তার মিডিয়া-পেশি ছড়ানো শুরু করে৷ প্রথমে সংস্থার মুখপাত্র সমস্ত অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘আবেগাক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দেন৷ এর পরপরই কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র তুমুল উৎসাহে হামিদ মির ও জিয়ো টিভি এবং এদের মূল প্রতিষ্ঠান জং গ্রুপকে দেশবিরোধী, ভারতের দালাল, সিআইয়ের এজেন্ট বলে দোষারোপ করতে থাকে৷ কাকের মাংস কাকই খাওয়া শুরু করে৷ মিডিয়ার মধ্যে থেকেই উঠতে থাকে জিয়ো টিভি বন্ধের দাবি৷ দেশব্যাপী আইএসআইয়ের সঙ্গে জড়িত সংগঠন ও ব্যক্তিরা জিয়ো ও হামিদ মিরের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চালান৷ জিয়ো টিভি নিষিদ্ধের দাবিতে আদালতে মামলা হয়৷ কেবল অপারেটরদের চাপে ফেলে জিয়ো টিভির সম্প্রচার অনেক কমিয়ে আনা হয়৷ বিভিন্নমুখী চাপে জিয়ো টিভি পিছু হটে এবং সরকার সেনাবাহিনীকে খুশি রাখতে ব্যতিব্যস্ত হয়৷ একপর্যায়ে জিয়ো টিভিসহ জং গ্রুপের দুটি দৈনিক পত্রিকা ডেইলি জং ও দ্য নিউজ প্রথম পৃষ্ঠায় সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থনা করে বলে, ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘আবেগাক্রান্ত’ সংবাদ প্রচার করে ভুল করেছে৷ আইএসআইয়ের ভাষার সঙ্গে ক্ষমাপ্রার্থনার ভাষার মিল লক্ষণীয়৷ অথচ হামিদ মিরের হামলাকারীদের চিহ্নিত করায় আইএসআইয়ের ব্যর্থতাও চোখে পড়ে৷ অতীতে কোনো কোনো সাংবাদিক হত্যায় তাদের সংশ্লিষ্টতার আলামতও দুর্লভ নয়৷
পাকিস্তানে সাংবাদিকদের জীবননাশ ও গণমাধ্যমকে লাইসেন্স বাতিলের মুখে কাজ করতে হয়৷ স্পষ্টভাবে আইএসআইয়ের চাপে দি এক্সপ্রেস ও এআরআই চ্যানেল সাংবাদিকতার নৈতিকতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে৷ প্রচার ও প্রভাবের প্রতিযোগিতা এভাবে পরস্পরের বিনাশে ধাবিত হলে লাভ হয় আরও বড় অপশক্তির৷ তাই এরা যেভাবে সহযোগী সংবাদমাধ্যমকে ধ্বংস করায় জোগালি খেটেছে, তা গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অধিকারকে স্বার্থের তুিড়তে উড়িয়ে দেওয়ার নজির৷ এ ঘটনায় পাকিস্তানের গণমাধ্যম জগতে সেনাবাহিনীর হাত যে কতটা ভেতর পর্যন্ত প্রসারিত, তার পরিমাপ পাওয়া গেল৷ পাকিস্তানে সেনা গোয়েন্দা সংস্থাকে লোকে ‘স্ট্যাবলিশমেন্ট’ নামে ডাকে৷ স্ট্যাবলিশমেন্টের পক্ষে থাকলে সবই ভালো, বিরুদ্ধে গেলেই বিপদ৷
যে সমাজে সেনা কর্তৃত্ব ক্যান্টনমেন্ট ছাপিয়ে সমাজে, ব্যবসা–বাণিজ্যে, সিভিল প্রতিষ্ঠান ও জনমত গঠনকারী বলয় পর্যন্ত ঢুকে পড়ে, সেই সমাজ হয় বনসাই করা গাছের মতো, ব্যবসা–বাণিজ্য নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না, বেসামরিক প্রতিষ্ঠান কার্যকারিতা হারিয়ে ভবনসর্বস্ব হয়ে পড়ে৷ পরিণামে জনগণের আত্মবিশ্বাস কমজোরি হয়ে যায়৷ অহেতুক সেনা–বিরোধিতা যেমন অকাজের, তেমনি সেনা-স্ট্যাবলিশমেন্টের প্রতি ভয়াবশ তোষণও ক্ষতিকর৷
একটি সমাজে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের অধিকার পরস্পরের পরিপূরক৷ একটি না থাকলে অন্যটি বিকশিত হয়, এমন নজির নেই৷ কোনো গণমাধ্যম যদি চূড়ান্ত পক্ষপাতপূর্ণও হয়, তাহলে দর্শক-পাঠকদের বড় অংশের কোনো কারণ নেই তাকে বিশ্বাস করার৷ ওই সংবাদমাধ্যম তখন মঞ্চের আলো হারিয়ে ফেলে৷ সেটাই তাদের জন্য বড় শাস্তি৷ কিন্তু যখনই গোপন শক্তির চাপে, সন্ত্রাসী হামলা ও হুমকিতে, কিংবা আইনের বাইরে গিয়ে গণমাধ্যমকে শাস্তি দেওয়া হয়, তখন তা গণতন্ত্রের প্রাণভোমরাকেই আঘাত করে৷ যে সমাজে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না, সেখানেই গোয়েন্দা সংস্থার নিয়ন্ত্রণ, মাফিয়া দস্যুতন্ত্রের দাপট কিংবা সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ন্ত্রণ পাকা হয়৷ পরিণামে তা গণতন্ত্রের রক্তনালি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অথর্ব বানিয়ে ফেলে৷ এ অবস্থায় মিডিয়ার বৈরী প্রতিযোগিতা কেবল সাংবাদিকতার জন্যই নয়, দেশের জন্যই আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়ায়৷ পাকিস্তানের মতো দেশে, যার ইতিহাস সামরিক বাহিনীর শাসনে-শোষণে জর্জরিত, সেখানে এ ধরনের পরিস্থিতি খুবই বিপজ্জনক৷ পাকিস্তান তার খেসারত অতীতেরও িদয়েছে, এখনো দিচ্ছে৷
হামিদ মিরের জীবননাশের চেষ্টার পটভূমিতে আরও কিছু ঘটনা ঘটছিল পাকিস্তানে৷ নওয়াজ শরিফের সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে সেনাবাহিনী ও আইএসআইয়ের দাপটকে সংযত করার চেষ্টা করে৷ সাবেক স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের বিচারকে কেন্দ্র করে সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব ঘনীভূত হচ্ছিল৷ পারভেজের শাস্তি মানে সেনা–স্ট্যাবলিশমেন্টের ক্ষমতা হ্রাস এবং ভবিষ্যতে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি৷ একই সঙ্গে তালেবানদের সঙ্গে শান্তি আলোচনাও চলছিল৷ অন্যদিকে চলছিল ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা কমিয়ে বাণিজ্য বাড়ানোর চুক্তি সম্পাদনের প্রস্তুতি৷
আইএসআই-জিয়ো টিভি লড়াইয়ের একপর্যায়ে নওয়াজ শরিফকে অ্যাবোটাবাদের মিলিটারি একাডেমিতে গিয়ে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানের প্রতি পরিপূর্ণ আস্থার কথা জানিয়ে আসতে হয়েছে৷ পারভেজ মোশাররফের বিচারের ইস্যুটা পেছনে পড়ে গেছে৷ এমনকি এও শোনা যাচ্ছে, সরকার তাঁকে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যেতে বাধা দেবে না৷ তালেবানদের দৌরাত্ম্যও বেড়ে গেছে৷ এরই মধ্যে আরেক সাংবাদিক সালিম শাহজাদের হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যাকারীদের নাম–নিশানার কিছুই মিলল না৷ পাশাপাশি সামরিক বাহিনী ও আইএসআইয়ের ওপর তৈরি হওয়া জবাবদিহির চাপ উল্টে গিয়ে সরকার ও গণমাধ্যমকেই বেকায়দায় ফেলতে পারল৷ মিডিয়া যদি বিভক্ত ও ব্যবহৃত না হতো, তাহলে হয়তো আইএসআই এমন অশুভ প্রভাব ফেলতে পারত না৷
আইএসআইয়ের পক্ষাবলম্বনকারীদের ধারণা, হামিদ মির ও জিয়ো টিভি আইএসআইকে অভিযুক্ত করেছে নওয়াজ সরকারের ইন্ধনে৷ তারা হামিদ মিরকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চর বলেও প্রচার করেছে৷ অন্য পক্ষ মনে করে, হামিদ মির তালেবানদের মিত্র৷ অথচ এরাই একসময় হামিদ মিরের প্রতি খুই প্রীত ছিল৷
সালিম শাহজাদের অপরাধ, তিনি পাকিস্তানের নৌবাহিনীতে আল–কায়েদার অনুপ্রবেশ নিয়ে সংবাদ করেছিলেন৷ আর হামিদ মির কিছুদিন ধরে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের গণহারে গুম হওয়ার বিষয়ে ব্যাপক সোচ্চার ছিলেন৷ মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের এ রকম বিপন্ন হওয়ার ঘটনা জানিয়ে দেয়, লাল দাগ অতিক্রম কোরো না৷
সব মিলিয়ে ক্ষতি হলো গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের৷ আর আইএসআই ও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে যে বিতর্ক পাকিস্তানি সমাজে চলছে, তাতে করে দেশটি আরও অসহনশীল ও বিভক্তই হয়ে পড়ল৷ পুরোনো প্রবাদও আবার সত্য হলো যে, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান সাফল্য একটি দেশ দখল করতে পারা, আর সেটি হলো পাকিস্তান৷
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.