সরকার, তুমি তার by আনিসুল হক

এই গল্পটা বলেছিলেন আব্রাহাম লিংকন।
আব্রাহাম লিংকন সবে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। গৃহযুদ্ধের পরে।
দলে দলে লোকে তাঁর কাছে এসে বলতে লাগল, ‘আমরা দেশের জন্য অনেক স্বার্থ ত্যাগ করেছি। পদ চাই। আমাদের মূল্যায়ন করুন।’
তখন আব্রাহাম লিংকন এই গল্পটা করেন।
এক রাজা বেরোবেন শিকারে। তিনি মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজকের আবহাওয়া কেমন? পথে ঝড়বৃষ্টি হবে না তো?’
মন্ত্রী বললেন, ‘না না, আজ ঝড়বৃষ্টি হবে না। আবহাওয়া চমৎকার।’
কিছুদূর যাওয়ার পর এক ধোপার সঙ্গে দেখা। ধোপা বললেন, ‘রাজামশাই, বেশ তো চলেছেন, কিন্তু সামনে তো ঝড়বৃষ্টি হবে।’
রাজা এগোলেন। ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়লেন।
তখন তিনি ওই মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে সেই পদে বসালেন ধোপাকে।
ধোপা বললেন, ‘রাজামশাই, যখন ঝড়বৃষ্টি হয়, তখন আমার গাধার কান নড়ে। গাধার কান নড়া দেখে আমি বুঝেছিলাম, আজ বৃষ্টি হবে।’
রাজা তখন ধোপাকে বরখাস্ত করে গাধাটাকে মন্ত্রী বানালেন।
তখন হলো আসল বিপদ। রাজার সভাসদেরা দলে দলে এসে রাজাকে ঘিরে ধরলেন, ‘আমরাও তো গাধা। আমাদেরও মন্ত্রী বানান।’
আব্রাহাম লিংকন কেন এই গল্পটা বলেছিলেন, আমার জানা নেই, কিন্তু একটা কিছু অনুমান তো করে নিতেই পারি। এখন, এই মুহূর্তে কেন এই গল্পটাই মনে পড়ে গেল, তারও কোনো ব্যাখ্যা খঁুজে পাচ্ছি না।
একটা সূত্র খঁুজে পাওয়া যাচ্ছে অবশ্য। ‘জনগণের জন্য, জনগণের দ্বারা, জনগণের সরকার’—সেই বিখ্যাত গেটিসবার্গ ভাষণ দেওয়া আব্রাহাম লিংকনের কথা এত বছর পরেও আমাদের জন্য আলোর দিশা দেখাতে পারে বটে।
লিংকনের গল্প থেকে অন্তত এই উপদেশটা পাওয়া যায়, কোনো মন্ত্রী কাজে না লাগলে তাঁকে বরখাস্ত করো।
২৯ মে প্রথম আলোয় হাসান ফেরদৌসের কলাম ছাপা হয়েছে, ‘সরকার, তুমি কার?’ ওই লেখায় তিনি আমাদের শুনিয়েছেন ম্যাসাচুসেটস থেকে নির্বাচিত মার্কিন সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেনের গল্প, শুনিয়েছেন উদারনৈতিক এই সিনেটরের লেখা আ ফাইটিং চান্স বইয়ের কথা। এলিজাবেথ ওয়ারেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকও৷ বলেছেন, ‘সরকার হচ্ছে ফুলবাগানের মতো, সময়মতো যত্ন না নিলে তাতে আগাছা জন্মে, পরগাছা আশ্রয় নেয়।’
হাসান ফেরদৌসের লেখা পড়ে বুঝলাম, আমাদের দেশে সরকারের অবস্থা তেমনই হয়েছে; খুনি, দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজেরা সরকার নামের বটবৃেক্ষর গায়ে পরগাছার মতো জন্ম নিয়েছে। এ থেকে মুক্তির উপায় খঁুজতে হাসান ফেরদৌস এলিজাবেথ ওয়ারেনের পরামর্শেরই শরণাপন্ন হয়েছেন৷ ওয়ারেন বলছেন, সমাজ ও সরকারকে বদলাতে ক্রমাগতভাবে লড়ে যেতে হয়, সেই লড়াই দীর্ঘ, বন্ধুর; তবে শেষ পর্যন্ত বিজয় আসেও।
অগ্রজপ্রতিম লেখক হাসান ফেরদৌসের সঙ্গে দ্বিমত করছি না, তবে আমি আরও কাছের উদাহরণ দিতে চাই। একটা সরকারের বা এই সরকারের কী করা উচিত, তার একটা অপরূপ ব্যবস্থাপত্র তৈরি ও উপস্থাপন করা আছে। সেটার ৫০ ভাগও যদি মান্য করা হয়, বাংলাদেশ সোনার বাংলায় পরিণত হবে। এই ব্যবস্থাপত্রটা দিয়েছিলেন, না, আর কেউ নন, স্বয়ং শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে মহাজোট তিন-চতুর্থাংশ আসনে জয়লাভ করার পর তিনি একটা সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিয়েছিলেন। সে সময়ের বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ৩১ ডিসেম্বর ওই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর আগে-পরেও শেখ হাসিনার বিভিন্ন ভাষণে এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে এসব সুবচন উচ্চারিত হয়েছিল।
শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আমরা প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, আমরা সংঘাতের রাজনীতি বর্জন করতে চাই, দেশে একটা নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি উপহার দিতে চাই।’ তিনি বলেন, ‘এ কথা সত্য যে আমাদের অনেকেই বিএনপি-জামায়াতের প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়েছি, সর্বস্ব হারিয়েছি, কিন্তু যেহেতু আমরা জয়লাভ করেছি, আমাদের ক্ষমা করে দিতে হবে এবং সবাই মিলে একসঙ্গে দেশের ভালোর জন্য কাজ করে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এই বিশাল জয় তখনই সার্থক হবে, যখন আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সুশাসন নিশ্চিত করা যাবে এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়িত করা যাবে।’

‘আমরা বিরোধী দলকে তাদের আসনসংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করব না। সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল সরকারেরই একটা অংশ, তাদের ইতিবাচক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংসদকে কার্যকর করা যাবে।’ এক বিদেশি সাংবাদিক সাংসদদের দুর্নীতি বিষয়ে প্রশ্ন করলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমি দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, কারণ এটা আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। আমি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফল আমাকে ঘটাতেই হবে। এ জন্য সবার সহযোগিতা আমি চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর নতুন সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানো, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে একটা ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত ডিজিটাল সোনার বাংলা গড়ে তুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে কাজ করে যাবে। তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে নিয়োগ-পদোন্নতির মাপকাঠি হবে যোগ্যতা, দলীয় পরিচয় বা আনুগত্য নয়।’এর আগে-পরে তিনি বহুবার বলেছেন, ‘অপরাধী যে দলেরই হোক না, অপরাধী হলো অপরাধী, এটাই একমাত্র বিবেচ্য, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও এসব কথা সুন্দরভাবে বলা আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত রাখা হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা হবে। মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। একজন ন্যায়পাল নিয়োগ দেওয়া হবে। প্রশাসনে যোগ্যতা, জ্যেষ্ঠতা ও মেধা হবে নিয়োগ ও পদোন্নতির ভিত্তি। স্থানীয় সরকারগুলোকে কার্যকর করা হবে। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হবে।
এখন আমাদের সবার উচিত, ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া শেখ হাসিনার ভাষণটির কপি পকেটে রেখে দেওয়া ও সকাল-সন্ধ্যা একবার করে পড়ে নেওয়া। অপরাধীর কোনো দল নেই। সে অপরাধী, এটাই তার একমাত্র পরিচয়। এই সূত্র যদি আমরা মেনে চলতাম, আজ কোনো অপরাধীই কি ছাড়া পেত? তাহলে কি দেশ খুনখারাবি, গুম-অপহরণের অভয়ারণ্যে পরিণত হতে পারত?
অল পাওয়ার টেন্ডস টু করাপ্ট অ্যান্ড অ্যাবসল্যুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসল্যুটলি। সব ক্ষমতাই দুর্নীতিগ্রস্ত করতে চায়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দুর্নীতিগ্রস্ত করে নিরঙ্কুশভাবে। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ লর্ড অ্যাকটন (১৮৩৪-১৯০২) এই কথা বলেছিলেন। অ্যাকটন ইনস্টিটিউটের প্রকাশনায় বেন মরিল নামের একজন লেখক সহজ ভাষায় বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। ‘ক্ষমতা যিনি পান, তাঁর কিন্তু মানুষের খারাপ করার ইচ্ছা থাকে না। তিনি আসলে ভালোই করতে চান। এটা তাঁর দায়িত্ব। কিন্তু মানুষ তো আসলে বোঝে না, ভালো কী। কাজেই এটা তাঁর দায়িত্ব মানুষকে তাঁর ভালোটা করতে সাহায্য করা। মানুষ ভালো বোঝে না, আমি বুঝি, আমার দায়িত্ব মানুষের ভালো করা৷ কাজেই মানুষের মঙ্গলের জন্য কল্যাণের জন্য আমি একচ্ছত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করি। সেটার প্রয়োগ করি।’ এখানেই শুরু হয় বিপদটা।
বেন মরিল বলেছেন, ‘তখন এমন আইন প্রণয়ন করতে হয়, প্রয়োগ করতে হয়, যাতে মানুষের ভালো করার দায়িত্বটা বাধাহীনভাবে পালন করা যায়। যাদের ভালো করার জন্য এটা করা হচ্ছে, তাদের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা হয়। আর তখন চারপাশে এমন বন্ধু ও সহকর্মী এসে জোটে, যারা সারাক্ষণ তার প্রশংসা করে, আর নিজেরাও অন্যদের দমন করার মধ্যেই আনন্দ খঁুজে পায়। আর এসব সভাসদ পাত্রমিত্র অমাত্যকে অন্যায়ভাবে কাজ দেওয়া, ব্যবসা দেওয়া, লাভ দেওয়ার ঘটনা ঘটতেই থাকে। দীর্ঘদিন ধরে যিনি ক্ষমতায় আছেন, তিনি মনে করেন, ক্ষমতাই জ্ঞান। জনগণ তাঁকে নির্বাচিত করেছেন, এটা কেবল তাঁকে ক্ষমতা দেয়নি, জ্ঞানও দিয়েছে।’
আস্তে আস্তে সবচেয়ে ক্ষমতাবানই সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর আশপাশে সুবিধাভোগী পরামর্শকেরা তাঁর এই ধারণার গোড়ায় নিত্য জল দিতে থাকেন।
তিনি আস্তে আস্তে ভুলে যান, কোনটা ক্ষমতা আর কোনটা দুর্নীতি। এ দুটোর মধ্যে তিনি আর পার্থক্য করতে পারেন না।
আব্রাহাম লিংকন দিয়ে শুরু করেছিলাম। তাঁকে দিয়েই শেষ করা উচিত। তাঁর একটা উক্তি: আমার প্রবল ভয় তোমার বিফলতা নিয়ে নয়, আমার
সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা হলো, সেই ব্যর্থতা নিয়েও তুমি সন্তুষ্ট কি না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.