আওয়ামী লীগ নীরব কেন?

সাত খুনের প্রতিবাদে সিদ্ধিরগঞ্জে মানববন্ধন
বিরোধী দল যে গণতন্ত্রের অপরিহার্য পূর্বশর্ত, এই সরল সত্যটি আমাদের গণতান্ত্রিক নেতা-নেত্রীদের অনেকেই মানেন না৷ অন্তত ক্ষমতায় থাকলে বিরোধী দলকে তাঁরা গণতন্ত্রের প্রধান শত্রু বলেই গণ্য করে থাকেন৷ পাকিস্তান আমলের কথা বাদ দিলেও স্বাধীনতার পর গত ৪৩ বছরে কোনো সরকারই বিরোধী দলকে কাজে লাগানোর প্রয়োজন বোধ করেনি৷ আমাদের রাজনীতির এই অপসংস্কৃতি ঝেড় ফেলতে না পারলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷ সরদার ফজলুল করিমের কোনো এক লেখায় পড়েছিলাম, স্বাধীনতার পর একবার জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, ‘আপনি দেশ চালানোর দায়িত্ব নিয়েছেন৷ এখন আপনার কাজ হবে দেশে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে তোলা৷’ জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, বিরোধী দলের তো জনসমর্থন নেই, শক্তিশালী বিরোধী দল কী করে হবে৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনের নিরিখে দেখলে হয়তো তাঁর বক্তব্যটি ঠিক ছিল৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর কোনোভাবেই বলা যায় না যে বিরোধী দলের জনসমর্থন ছিল না৷ ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত ডাকসুর (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ) নির্বাচনে বিরোধী দলের সমর্থক ছাত্র ইউনিয়নই জয়ী হয়েছিল৷ ১৯৭২-৭৩ সালে বিভিন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন, কিংবা জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগই জয়ের ধারা অব্যাহত রেখেছিল৷ কিন্তু ১৯৭৩ সালের ডাকসু নির্বাচনে সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগ (ছাত্র ইউনিয়নও তার সহযোগী হয়েছিল) ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে ছাত্ররাজনীতির বুকে প্রথম কুঠারাঘাত হানে৷ এই ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের কয়েক মাসের ব্যবধানে মুহসীন হলে সাত হত্যাকাণ্ড ঘটায় ছাত্রলীগেরই একটি অংশ, যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন শফিউল আলম প্রধান৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রশাসন ও সরকারি দল জবরদস্তি না করলে বিরোধী দল ২৫ থেকে ৩০টি আসন পেত এবং তাতে ক্ষমতাসীন দলটির ইতরবিশেষ ক্ষতি হতো না, বরং জোর করে জিতিয়ে আনা খন্দকার মোশতাক আহমদরা আওয়ামী লীগের ভেতরে থেকে পরবর্তীকালে অন্তর্ঘাতের সুযোগ না-ও পেতে পারতেন৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিরোধী দলের সরব ও সজাগ উপস্থিতি প্রয়োজন এ কারণে যে তাতে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে, সরকারি দল যা খুশি তা করতে পারে না৷ ৫ জানুয়ারির আগে বিরোধী দল বিএনপি অযৌক্তিকভাবে সংসদ বর্জন করলেও দলের নেতারা বিভিন্ন ইস্যুতে কথা বলতেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে কিছুটা হলেও সচেতন থাকতেন৷ অন্তত সংসদীয় কমিটিগুলোতে তাদের উপস্থিতি সরকারি দলকে কিছুটা হলেও জবাবদিহি করতে বাধ্য করত৷ কিন্তু ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর সরকারি দলের সামনে আর কোনো বাধাই থাকল না৷ নেতা-কর্মীরা ভাবতে লাগলেন, ‘আমরা সবাই রাজা এই রাজার রাজত্বে৷’
সবাই রাজা হলে যা হয়, সেটাই দেশবাসী গভীর বেদনা ও বিস্ময়ের সঙ্গে এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে৷ দেশের বিভন্ন স্থানে সরকারি দলের নেতা-কর্মী ও ক্যাডাররা যেসব কাণ্ড করছে, তার সঙ্গে ২০০১ সালের অক্টোবর-পরবর্তী সময়ের তুলনা করা যেতে পারে৷ সে সময়ে বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা বিরোধী দল ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে তাদের ‘নৈতিক কর্তব্য’ বলে মনে করেছিলেন, যার ফলে পুলিশ তথা প্রথাগত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে খালেদা জিয়ার পক্ষে দেশ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে তিনি এলিট ফোর্স হিসেবে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‌্যাব গঠন করতে বাধ্য হন৷ অতীতের রেকর্ড ঘাঁটলে দেখা যাবে, সেই র‌্যাবের হাতে বিএনপির যত নেতা-কর্মী ক্রসফায়ারে মারা গেছেন, তত্কালীন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা তত মারা যাননি৷ আর এখন তো নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যা ঘটছে, তাকে কেবল আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা বললে ভুল হবে৷ এটি হলো ক্ষমতাকেন্দ্রিক অসুস্থ রাজনীতির অনিবার্য পরিণাম৷ রাজনীতি যখন অবৈধ সম্পদ রক্ষা এবং সন্ত্রাসের পাহারাদারে রূপ নেয়, তখন প্রচলিত আইন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অকেজো হয়ে পড়ে৷ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা দেশবাসীর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল যে নূর হোসেন নামের দানবকে রোখার শক্তি ও সাহস ক্ষমতাসীন দলটির নেই৷ এর চাক্ষুষ প্রমাণ, ঘটনার দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও দলীয়ভাবে কেন্দ্র বা স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি৷ ২০০৯-১৩ সালে সংসদে আসনসংখ্যা যত কমই হোক না কেন, সংসদে একটি বিরোধী দল ছিল৷ এমনকি বিরোধী দলের  অনুপস্থিতিতে স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম একাই সরকারি দলের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতেন৷ এখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে প্রতিবাদ করার কেউ নেই৷ ফলে গত জানুয়ারি থেকে ক্ষমতাসীন দলটির নেতা-কর্মীদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে, প্রশাসন ও সরকারি দলের মধ্যে অশুভ আঁতাত রচিত হয়েছে৷ মাস খানেক আগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতা সায়াদকে যখন একই সংগঠনের একদল কর্মী পিটিয়ে হত্যা করেন, তখন কেউই ভাবতে পারেননি যে সেই হত্যার রেশ না কাটতেই নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটবে৷ আর সেই হত্যাকাণ্ডে যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তিনি আওয়ামী লীগেরই একজন নেতা ও নির্বাচিত কাউন্সিলর৷
যিনি হত্যার শিকার হেলন, তিনিও কাউন্সিলর এবং একই দলের নেতা৷ খুনের দায়ে অভিযুক্ত কাউন্সিলর নূর হোসেন যে এ রকম একজন দুধর্র্ষ অপরাধী, তা অন্যরা না জানলেও আওয়ামী লীগের নেতাদের ভালো জানার কথা৷ যে রাজনীতির কাছে খুিন ও খুনের শিকার্তউভয়ই আশ্রয় পায়, সেই রাজনীতি কখনোই জনগণের কল্যাণ আনতে পারে না৷ এমনকি খুনের শিকার নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও একাধিক খুন ও সন্ত্রাসের অভিযোগ ছিল৷ নূর হোসেন ছিলেন বাসের হেলপার৷ হেলপার থেকে ধনকুবের হওয়ার নজির বহু আছে৷ পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি কপর্দকশূন্য অবস্থা থেকে ধনকুবের হয়েছেন৷ প্রশ্ন হলো, নূর হোসেনের ধনী হওয়ার উপায়টা কী ছিল৷ হত্যা, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, বালুমহাল দখল ও নদী দখল থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তিনি করেননি৷ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা কি তাঁর এসব অপকর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতেন না? প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন নীরব ছিল? অভিযোগ আছে, নূর হোসেন যে কোটি কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে অর্জন করেছেন, তার ভাগ পেয়েছেন সবাই৷ আর এসব কারণেই তিনি সাত খুনের মেতা ঘটনা ঘটাতে পেরেছেন৷ পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে তাঁর অপকমের্র ফিরিস্তি প্রকাশ ও প্রচারের পরও নারায়ণগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ার অর্থ আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে তাঁর পাপের বোঝা স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়েছে৷ শোনা যায়, কেবল নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতারা নন, কেন্দ্রীয় অনেক নেতাও তাঁর কাছ থেকে মাসোহারা পেতেন৷ ঘটনার দুই সপ্তাহ পর আহূত সংবাদ সম্মেলনেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নূর হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সুসংবাদ আমাদের জানাতে পারেননি৷ স্থানীয় আওয়ামী লীগও নীরব৷ ‘খুনের সঙ্গে যাঁরাই জড়িত, তাঁদের অবস্থান যা-ই হোক, ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে সৈয়দ আশরাফ সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন; দলের নয়৷ নারায়ণগঞ্জের ঘটনা নিয়ে ঘোলা পানিতে বিরোধী দলকে মাছ শিকার করতে দেওয়া হবে না বলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও তাঁর দলের কোন কোন নেতা-কর্মী পানি ঘোলা করলেন, তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলেননি৷
নারায়ণগঞ্জের খুদে মাফিয়া ডন নূর হোসেনের যেসব অপকর্ম ও অপরাধের খবর আসছে, তার পরও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আওয়ামী লীগ কেন ভয় পাচ্ছে, সেটাই এখন মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন৷ সিদ্ধিরগঞ্জ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কী বলেন? কী বলেন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতারা? সাত খুনের আগে যাঁরা বলতেন, তাঁদের হুকুম ছাড়া নারায়ণগঞ্জে গাছের পাতাটিও নড়বে না, তাঁরা হঠাৎ খামোশ হয়ে গেলেন কেন?  ১ মে গাজীপুরের সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, হত্যা ও গুমের সঙ্গে বিএনপি জড়িত৷ নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর তা প্রমাণিত হয়নি৷ আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন একাই সাত খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে আলামত পাওয়া যাচ্ছে৷ এটাই হলো আওয়ামী লীগের বিএনপি ও জামায়াতমুক্ত শাসনের নমুনা৷ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী যে দেশের ও গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বেড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতারা হরহামেশা জনগণকে সজাগ থাকতে বলছেন৷ কিন্তু নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের সঙ্গে বিএনপির কারও নাম আসেনি৷ সব নামই আওয়ামী লীগের, যুবলীগের ও ছাত্রলীগের৷ তাহলে গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে আসল ষড়যন্ত্র কারা করছেন, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ কেবল নারায়ণগঞ্জ বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বাংলাদেশের যেখানেই হত্যা, গুম, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে, সেখানে অনিবার্যভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নাম আসছে৷ তাঁরা নিজেরা মারামারি-হানাহানিতে লিপ্ত৷ নিজের ক্ষমতায় না কুলালে টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করে আনছে৷ এভাবে চলতে থাকলে বিএনপি বা অন্য কোনো বিরোধী দলের প্রয়োজন হবে না, আওয়ামী লীগ িনজের ভারেই ভেঙে পড়বে৷ আগে যেকোনো ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাদের অতি মাত্রায় সরব দেখা যেত৷ কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় আওয়ামী লীগের বাকপটু নেতা-মন্ত্রীরাও নিশ্চুপ৷ এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি মানববন্ধন বা শোকসভাও করা হয়নি৷ না নারায়ণগঞ্জে, না ঢাকায়৷ তাদের এ নীরবতা কিসের ইঙ্গিত দেয়?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabo3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.