গাছ কাটা নিয়ে তদন্ত তদন্ত খেলা

যে গাছ কাটার দায় নিয়ে তদন্ত হচ্ছে
চট্টগ্রামের আমবাগান এলাকায় রেলওয়ের মালিকানাধীন ৩০টি গাছ দুই দিন ধরে কাটা হয়েছে দিনদুপুরে। ডালপালা-পত্র-পল্লবশোভিত পঁচিশ থেকে শতাধিক বছর বয়সী গাছগুলো কে কেটেছে, কেন কেটেছে বা কার অনুমতি নিয়ে কাটা হয়েছে—কিছুই জানে না রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা জানিয়েছে, রাস্তা সংস্কারের জন্য সিটি করপোরেশনের লোকজন কেটেছে এসব গাছ। সিটি করপোরেশনের ভাষ্য হলো, সড়ক সংস্কারের সঙ্গে গাছ কাটার কোনো সম্পর্ক নেই; কারণ, এসব গাছের অবস্থান ছিল সড়কের অনেক বাইরে। তাদের মতে, রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে কাটা হয়েছে এসব গাছ, এখন ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর চেষ্টা চলছে। শুধু রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন পরস্পরকে দোষারোপ করছে তা-ই নয়, খোদ রেল কর্তৃপক্ষের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আঙুল তুলছেন পরস্পরের দিকে। এতে পোয়াবারো আসল অপরাধীর। পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মকবুল আহমদ এ ঘটনার জন্য দায়ী করেছেন বিভাগীয় প্রকৌশলী তরুণকান্তি বালাকে। তঁার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠিও পাঠিয়েছেন মহাব্যবস্থাপক। বিভাগীয় প্রকৌশলী বলেছেন, গাছ কাটার ব্যাপারটি তিনি একাধিকবার মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন মহাব্যবস্থাপককে। মহাব্যবস্থাপক বলছেন, মৌখিকভাবে জানালে তো হয় না। এ ধরনের ঘটনা অঁাচ করতে পারলে লিখিতভাবে জানানো উচিত ছিল। তঁার মতে, কোনো কর্মকর্তার এলাকায় কেউ প্রবেশ করলে অবৈধভাবে সম্পদ লুটে নিলে তঁারই উচিত প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাহায্য নেওয়া। অথচ বিভাগীয় কর্মকর্তার কার্যালয়ের সামনে দুই দিন ধরে গাছ কাটা চললেও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। দুই পক্ষের যুক্তিই অকাট্য। এখন তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হবে দায়টা কার। সেই তদন্ত করবে কে? গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান কে? তদন্ত কমিটির প্রধান বিভাগীয় প্রকৌশলী তরুণকান্তি বালা। না, পাঠক ভুল বলিনি। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে যঁার বিরুদ্ধে, সেই তরুণকান্তি বালাই তদন্ত কমিটির প্রধান। তা হলে তদন্ত প্রতিবেদনের ভবিষ্যৎ সহজেই অনুমেয়। ৪ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। ছায়াশীতল আমবাগান এলাকার শিরীষ, আম, মেহগনিসহ ৩০টি গাছ নির্বিচারে নিধনের জন্য এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে দায়ী করা যায়নি কাউকে। অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের দায়ী করে দায়সারা একটি মামলা করেছে রেল কর্তৃপক্ষ। তার ভিত্তিতে কিছু ডালপালা উদ্ধার করেছে পুলিশ, আর গ্রেপ্তার করেছে দুজনকে।
একজন গাছ কাটার শ্রমিক, অন্যজন গাছ বহনকারী পিকআপের চালক। এ যেন অনেকটা রবিঠাকুরের সেই কবিতার মতো, ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা ব্যাটাই চোর।’ বিভাগীয় প্রকৌশলী তরুণকান্তি বালা, (পরবর্তীকালে তদন্ত কমিটির প্রধান) প্রথম থেকেই ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে আমাদের ধারণা। তিনি সিটি করপোরেশনকে দায়ী করতে চেয়েছেন সড়ক সংস্কারের কথা বলে। উপরন্তু তিনি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ভাঙ্গারপুল ও আমবাগান পুলিশ বিট এলাকার দুটি সেতু মেরামতের নামে লোহার পাটাতন লুটপাট করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন। এ দুটি সেতু নির্মিত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। এসব লোহার পাটাতনের মূল্য আনুমানিক ১৫ লাখ টাকারও বেশি বলে জানা গেছে। তরুণ বাবুর অভিযোগের উত্তরে সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী বলেছেন, ‘যে কর্মকর্তা এসব কথা বলেছেন তিনি নিজেই তঁার লোকজন দিয়ে এসব লোহা নিয়ে গেছেন। তিনি হয়তো এসব লোহা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা করেননি।’ এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগের কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা—তা আমরা জানি না। তবে এ থেকে রেলের সম্পদ নিয়ে যে লুটপাট চলছে তা অনুমান করা কঠিন নয়। তা ছাড়া সাধারণ জ্ঞানে এটুকু বোঝা যায়, যে কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তিনি নিজেই যদি তদন্ত কমিটির প্রধান হন, তাহলে সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন² হতে বাধ্য। দুই দিন ধরে প্রকাশ্যে গাছ কাটার জন্য সাবেক স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার ও আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ হোসেন হিরণকে দায়ী করেছেন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী। তঁার নির্দেশেই তঁার অনুগত ব্যক্তিরা গাছ কেটে নিয়ে গেছেন বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় এলাকাবাসীও। পত্রিকান্তরে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও রেল কর্তৃপক্ষ মামলায় তঁার নাম উল্লেখ করেনি। অনেকের ধারণা, সাবেক কমিশনার রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে এই অপকর্ম করেছেন বলেই পুরো বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা চলছে। শেষ পর্যন্ত একজন কাঠ চোরাইয়ের শ্রমিক ও একজন পিকআপ ভ্যানচালকের ওপর এই দিনদুপুরে ডাকাতির দায় চাপানো হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রকাশ্য দিবালোকে রেলওয়ের মালিকানাধীন বৃক্ষসম্পদ লুণ্ঠনের ঘটনায় নগরবাসী যখন বিস্মিত, ঠিক তখনই বেরিয়ে এল রেলওয়েরই আরেকটি দুর্নীতির খবর। রেলের সেতু বিভাগের গুদাম অবৈধভাবে লিজ নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ৪২টি দোকান। গুদামের সামনের খোলা মাঠটিতে নির্মাণাধীন আরও ৩০টি দোকান। অথচ রেলের সেতু বিভাগ এ সম্পর্কে কিছু জানেই না। এতে রেলের প্রায় ২০ কাঠা জমি হাতছাড়া হচ্ছে, যার আনুমানিক মূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা। এই জমিতে গড়ে ওঠা দোকান সালামির ভিত্তিতে ভাড়া দিয়ে কোটি টাকার সম্পদ আয় করে নিচ্ছেন অবৈধ দখলদারেরা। চার বছর আগে রেলওয়ের এই গুদাম নিয়মবহির্ভূত লিজ দিয়েছে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ। সেতু বিভাগের জমি লিজ দেওয়ার এখতিয়ার তাদের আছে কি না কিংবা প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের ভিত্তিতে তা লিজ দেওয়া হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন নাহয় ঊহ্যই থাকল, কিন্তু ২০১০ সালে যে গুদামটি বছরে সাত লাখ ১৮ হাজার টাকা ভাড়ায় লিজ দেওয়া হয়েছিল, গত চার বছরে তার একটি টাকাও আদায় করতে পারেনি রেলওয়ে বিভাগ। কাগজে-কলমে এটি আবুল মনসুর নামের একজন ঠিকাদারের নামে লিজ দেওয়া হলেও এর নেপথ্যে যে মানুষটির কথা এখন শোনা যাচ্ছে, তিনি সেই আওয়ামী লীগের নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোহাম্মদ হোসেন হিরণ এবং তঁার আরও দুই সহযোগী।
সহযোগীদের মধ্যে একজন আবার পূর্বাঞ্চল রেলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক নুরুল আমিনের ভাই। লিজ গ্রহীতা আবুল মনসুর পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘লিজ আমার নামে হলেও সেখানে হিরণ ভাই, রেলের জিএম (সাবেক) নুরুল আমিনের ভাই আলম ও শাহ আলম নামের একজন ব্যবসায়ী আছেন।’ রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগ জানিয়েছে, মালামাল রাখার জন্য বেশ কিছু শর্ত সাপেক্ষে গুদামটি লিজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যে ঠিকাদার চার বছর ভাড়া পরিশোধ না করেও বহাল তবিয়তে দখল অব্যাহত রেখেছেন, তিনি যে অন্যান্য শর্ত মানার ব্যাপারেও তোয়াক্কা করবেন না, সেটাই তো স্বাভাবিক। এখন বিশাল গুদামে দুই সারি করে নির্মাণ করা হয়েছে ৪২টি দোকান, এমনকি গুদামের সামনের ২০ কাঠার খালি মাঠটাতেও তৈরি হচ্ছে আরও ৩০টি দোকান। গুদামের অভ্যন্তরে ৪২টি দোকানের প্রতিটি বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দেড় লাখ টাকায়। মাঠে নির্মাণাধীন দোকানগুলো বিক্রি হবে প্রতিটি চার থেকে পঁাচ লাখ টাকায়। এসব বিষয়ে মুখ খোলার মতো রেলওয়ের কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না। যঁারা কথা বলেন তঁাদের কথায়ও কোনো দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় না। যেমন সেতু শাখার অতিরিক্ত প্রকৌশলী জাফর আহমদ পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘গোডাউনটি সেতু শাখার, তবে লিজ দেওয়ার বিষয়টি আমি কিছুই জানি না।’ প্রায় একই রকম কথা বললেন বিভাগীয় প্রকৌশলী তরুণকান্তি বালা। তিনি বলেন, ‘সেতু শাখা প্রকৌশল বিভাগেরই আওতাধীন, তবে গোডাউনটি লিজ দেওয়ার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’ অর্থাৎ কেউ কিছু জানেন না। এত অজ্ঞতা নিয়ে রেলওয়ের কর্মকর্তারা কীভাবে কর্মস্থলে বহাল আছেন জানি না। তবে এই ‘অজ্ঞতার’ কারণে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশাল লোকসানের বিনিময়ে তঁারা লাভবান হচ্ছেন কি না, সেই সন্দেহই জাগবে সাধারণ মানুষের মনে। রেলওয়ের বৃক্ষসম্পদ লুণ্ঠনের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরও তার পর্যবেক্ষণ বা প্রতিবেদন আমরা পাইনি। রেলওয়ে গুদাম অবৈধভাবে লিজ দেওয়ার বিষয়টি নিয়েও হয়তো একটি কমিটি হবে। হয়তো সেই কমিটিতেও প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হবেন এমন একজন, যঁার দিকে রয়েছে সন্দেহের তির। এভাবে তদন্ত-প্রক্রিয়াটিই হয়তো একটি হাস্যকর বিষয়ে পরিণত হবে। ঘুরেফিরে এক বা একাধিক চক্র লুটেপুটে খাবে রেলওয়ের সম্পদ।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.