স্বেচ্ছানির্বাসিত নেতার মতবিনিময় ও কিছু প্রশ্ন by কামাল আহমেদ

নির্বাসন, তা সে স্বেচ্ছায় হোক আর অন্য কোনো বাধ্যবাধকতার কারণেই হোক, রাজনীতিকদের জন্য সেটা যে শেষ কথা নয়, তার উদাহরণ প্রচুর। আমাদের উপমহাদেশেই পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ কিংবা বেনজির ভুট্টো দুজনেই দেশান্তরি হতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার দুজনের বিরুদ্ধেই বড় বড় দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। কিন্তু সেগুলোর কোনো কিছুই রাজনীতিতে তাঁদের সফল প্রত্যাবর্তনকে ঠেকাতে পারেনি।

২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে কারাগার থেকে জামিনের পর তাঁকে যখন লন্ডনগামী বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন বাংলাদেশে একটি বৃহৎ দলের নেতৃত্বের সম্ভাব্য উত্তরাধিকার তারেক রহমানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, তাতে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিছুটা খুশিই হয়েছিলেন। ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল, কারণ পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল নাটকীয় এবং বিএনপির সমর্থকেরা অনেকেই তখন দাবি করেছিলেন যে সেনা-সমর্থিত সরকার তাঁকে জোর করে নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে পিজি হাসপাতালে তাঁর ছেলের সঙ্গে দেখা করে যেভাবে চোখের পানিতে ভিজিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলেন, সেই দৃশ্যকে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের জবরদস্তির আলামত বলেই অনেকের কাছে মনে হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্যও সে সময়ে সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হলো, যাতে তিনি বলেছিলেন, পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তারেক রাজনীতি থেকে বিরত থাকবেন। সেই রাতেই অন্য একটি বিবৃতিও আবির্ভূত হয়, যাতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে তারেক রহমানের পদত্যাগের ঘোষণাও ছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, তারেক রহমান ও হাওয়া ভবন অধ্যায়ের অবসান ঘটল। বেশ কিছুদিন পর প্রথমে পারিবারিকভাবে এবং পরে দলের তরফে বলা হলো, এটা সাময়িক নির্বাসন এবং তা অবশ্যই চিকিৎসাজনিত।
ব্রিটেনে সাড়ে পাঁচ বছরের চিকিৎসাতেও যদি তাঁর নিরাময় না হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর এই স্বেচ্ছানির্বাসন আরও দীর্ঘায়িত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। স্বেচ্ছানির্বাসিত একজন রাজনীতিক ৮ এপ্রিল প্রবাসী সুশীল সমাজের সঙ্গে প্রথমবারের মতো এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হবেন বলে যখন খবর পাওয়া গেল, তখন তাতে সবার মধ্যে আগ্রহ একটু বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। জমা হওয়া অনেক প্রশ্নের জবাব পাওয়ার আশাই ছিল ওই আগ্রহের কারণ। দেশত্যাগের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের মাথায় একটি সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরে কিছু মন্তব্য করে তিনি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, সেটাও এই ঔৎসুক্যের কারণ। এমন বিতর্ক যে মন্ত্রীদের মধ্যে মাথা গরম হিসেবে খ্যাত ব্যক্তিরা মা-ছেলেকে গালিগালাজের পাশাপাশি তাঁর প্রয়াত বাবাকে মরণোত্তর বিচারের কথাও বলেছেন।
গণতন্ত্রের তীর্থকেন্দ্র, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট যে ওয়েস্টমিনস্টার প্যালেসে প্রতিষ্ঠিত, তার থেকে ঢিল-ছোড়া দূরে বেশ জমকালো মিলনায়তন— ওয়েস্টমিনস্টার হল। যুক্তরাজ্য বিএনপির সব ধরনের আয়োজনেরই কয়েক বছর ধরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে আসছে যে পেশাদার কোম্পানি জে ফোর এস, তাদের নিরাপত্তাকর্মীদের একটি দল মিলনায়তনের দায়িত্ব পালন করছিল, আর অন্য দলটির কাজ ছিল তারেক রহমানের নিরাপত্তা। মিলনায়তনে ঢুকে তিনি সব টেবিলে গিয়ে অতিথিদের সঙ্গে (আমাদেরটি বাদে) পরিচিত হলেন এবং কুশল বিনিময় করলেন। তারপর ডজন খানেক পেশাজীবীর বক্তব্যের পর তিনি তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। ৭২-এ বঙ্গবন্ধু ‘অবৈধ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন’—ওই অনুষ্ঠানের এই বক্তব্য পরদিনের অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় তাঁকে জায়গা করে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর সংকটাপন্ন দলকে তা যেমন কোনো নতুন পথনির্দেশ করেনি, তেমনি দেশের মানুষকেও বিএনপির ব্যর্থতাগুলো ভুলে নতুন কিছুতে আকৃষ্ট করতে পারেনি। আধুনিক কালের রাজনৈতিক চর্চাগুলো অনুসরণ করে বিএনপি একটি জনমত জরিপ চালিয়েই তা যাচাই করে নিতে পারে যে দেশের কত শতাংশ মানুষ এখন মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকার উপযুক্ত স্বীকৃতিকে অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে।
কোনো প্রশ্নোত্তর নেই, কোনো সমালোচনার জবাব নেই, নেই আত্মসমালোচনা। তবু নাম তার মতবিনিময় সভা। কেউ যদি বলেন, তিনি যা শুনলেন, তা তাঁর এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে, তাহলে তা যে খুব একটা ভুল হবে, তা নয়। যেমন ধরা যাক, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট মোদাব্বের হোসেনের কথা। তিনি বলেন, আজকের বিএনপি এবং জিয়ার বিএনপির মধ্যে বিরাট পার্থক্য। আমলারা দলে ভিড় করেছেন, যাঁরা শুধু বক্তৃতা-বিবৃতি আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। মাঠে থাকেন না। যে কারণে নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাবে বললেও নির্বাচন বন্ধ করা যায়নি। মানবাধিকার সংগঠক হাসনাত এম হোসেন জানান, বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার বাসার রাস্তায় বালুভর্তি ট্রাক ফেলে এবং পুলিশ ও র‌্যাব মোতায়েন করে যখন তাঁকে অবরোধ করে রাখা হয়, তখন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বাংলাদেশবিষয়ক গ্রুপের এমপিদের কাছে ধরনা দিয়েও তাঁরা কোনো সাড়া পাননি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, সে সময়ে ঢাকায় বিএনপির নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও রাস্তায় নামার আহ্বানে সাড়া না দেওয়ার ব্যাখ্যা কী?
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির রসায়নের শিক্ষক এম এ মালেক বলেন, মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রতিপক্ষকে হারানোর কৌশলে আওয়ামী লীগ সফল হয়েছে এবং বিএনপি পিছিয়ে পড়েছে। আকারে-ইঙ্গিতে অনেকেই যে প্রশ্নটি ছুড়ে দিয়েছেন, সেটা হলো, দেশে ফিরে তিনি কবে দলের হাল ধরবেন? প্রশ্নটি সরাসরি না করেই তাঁরা বলেছেন, দলে এখন পরিবর্তন প্রয়োজন এবং তিনিই সেই পরিবর্তন আনতে পারেন। ভোটারবিহীন ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদ, সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠা এবং আইনের শাসন ও নিরাপত্তার অভাব নিয়ে উদ্বেগের কথাও উঠে আসে অধিকাংশ বক্তার কথায়। বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যেসব অমীমাংসিত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, এগুলোকে তার খণ্ডচিত্র বিবেচনা করা বোধ হয় ভুল হবে না।
নেতৃত্বে উত্তরাধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া দলে এবং দলের বাইরে সাধারণের মধ্যে আস্থা অর্জনের মতো কোনো কিছু এখনো দৃশ্যমান নয়। বরং পরিবর্তনের যে আভাসটুকু মিলছে, তা নতুন নতুন বিতর্কের জন্ম দিচ্ছে— রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক উভয় ক্ষেত্রেই। রাজনৈতিক বিতর্কে প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের উত্তেজিত করা সম্ভব হলেও তাতে বিএনপির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে, সে প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। দেশে কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি নতুন প্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচন কবে ও কীভাবে আদায় হবে, তার কোনো নির্দেশনা তাঁর সাম্প্রতিক কোনো বক্তব্যে কেউ পেয়েছেন, এমনটি তাঁর অন্ধ অনুগতরাও দাবি করতে পারবেন না। অথচ এ জন্য দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকেই নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে।
সাংগঠনিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আলামত পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী আরও গুরুতর। যুক্তরাজ্য বিএনপির কোন্দল মেটাতে বছর খানেক আগে তিনি যাঁদের নেতৃত্বের জন্য বেছে নিয়েছেন, তাঁদের কারও কারও বিরুদ্ধে দলের মধ্যেই এখন আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে; তাও আবার তাঁর এই মতবিনিময় সভার আয়োজনকে ঘিরে। ব্রিটেনের বাংলা সাপ্তাহিকগুলোয় গেল সপ্তাহে খবর বেরিয়েছে যে ওয়েস্টমিনস্টার হলের ভাড়ার মধ্যে ছয় হাজার পাউন্ড পরিশোধ করা হয়েছে জালিয়াতির মাধ্যমে। দলের যুক্তরাজ্য শাখার একজন সহসভাপতি শাহ আক্তার হোসেনের কাছ থেকে ৬০০ পাউন্ড চাঁদা নেওয়ার কথা বলে তাঁর ক্রেডিট কার্ডের নম্বর ও ব্যক্তিগত পরিচয় নিশ্চিতকারী গোপন নম্বর (পিন) ব্যবহার করে নেওয়া হয়েছে ছয় হাজার পাউন্ড। কমিটির শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওই জালিয়াতির অভিযোগ এখন পুলিশের তদন্তাধীন। জালিয়াতির বিষয়টি প্রকাশ করে দেওয়ায় তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেছেন। যেসব নেতার বিরুদ্ধে এই জালিয়াতির অভিযোগ, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা গত ১০ দিনেও জানা যায়নি।
ব্রিটেনে সাধারণ জীবনযাত্রার মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও বেশ ব্যয়বহুল। তার মধ্যে যদি আবার একটু আভিজাত্য এবং কিছুটা রাজকীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো যুক্ত হয়, তাহলে তো কথাই নেই। অতীতের দলীয় কোন্দলের পেছনেও চাঁদাবাজির বিষয়টি জড়িত ছিল বলে লন্ডনের এক বাংলা সাপ্তাহিকে খবর বেরিয়েছিল। যুক্তরাজ্য বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা দূর করায় লন্ডনে নিজের উপস্থিতি যদি কাজে না লাগে, তাহলে কয়েক হাজার মাইল দূরে দেশে সংগঠনকে তিনি কীভাবে পুনর্গঠন করে চাঙা করবেন?
সেদিনের সেই সভায় মিলনায়তন ব্যবহারের সময় শেষ হয়ে আসায় তারেক রহমানকে হঠাৎ করেই তাঁর বক্তৃতা গুটিয়ে নিতে হয়েছিল। আয়োজকেরা সম্ভবত ব্রিটিশ রীতিনীতির কথা বিবেচনায় নেননি অথবা সেগুলো সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। এ দেশে যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনে সময় বেঁধে দেওয়া হলে তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকে। এমনকি হাইড পার্কে নামীদামি তারকাদের কনসার্ট হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার নজির সাম্প্রতিক সময়েই রয়েছে। অবশ্য, চাইলে পরে এই সময় ফুরিয়ে যাওয়াকেই তিনি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সমালোচনার জবাব এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন। তবে এসব প্রশ্নের জবাব যত বেশি দিন অনুচ্চারিত থাকবে, রাজনীতিতে তাঁর দলের অবস্থা তত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকবে।

কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন।

No comments

Powered by Blogger.