অপহরণের দিনগুলোতে সাংবাদিকেরা- গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস by ফারুক ওয়াসিফ

জীবন গল্পের চাইতেও আশ্চর্যকর! একসময়কার ঝাঁ-চকচকে নায়িকা বনশ্রীর অপহূতা কিশোরী মেয়েটি সংবাদও হয়নি উদ্ধারও পায়নি। এই জীবন নিয়ে উপন্যাস রচনা বা সিনেমা বানানো কি সম্ভব? বিশ্বনন্দিত লেখক সদ্যপ্রয়াত গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে কখনো পেলে জিজ্ঞাসা করা যেত, আপনার গল্পের সেই সব বিষণ্ন মেয়েদের কথা আপনি কোথায় পেয়েছেন? উত্তরে তিনি বলতেন, বাস্তবে।
এক ক্ষমতাবান বিনোদন ব্যবসায়ী যে সত্যিই বনশ্রীর প্রজাপতির মতো মেয়েকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, সে কথা বিশ্বাস করানোর জন্য চোখের পানি ছাড়া আর কোনো প্রমাণ নেই এই মায়ের। সেটা নায়িকা মৌসুমীর কেয়ামত থেকে কেয়ামত আর শাবনূরের চাঁদনী রাতে ছবির দিন। সে রকম দিনেই বনশ্রী দর্শকপ্রিয় ব্যবসাসফল ছবি সোহরাব রুস্তম-এর নায়িকা। সেই বনশ্রীকে দেখি, কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে অসুস্থ আরেক শিশুসন্তানের জন্য মানুষের সাহায্য চাইতে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রাস্তার মোড়ে এক রুক্ষ চুলের বালিকাকে দেখে পাঁচালির দুর্গাকে পেয়েছিলেন। বনশ্রীর মধ্যে আমাদের লেখকেরা কাকে দেখতে পাবেন জানি না, তবে সাংবাদিক তৈমুর রেজা তাঁর অসাধারণ গদ্যে বনশ্রীর রোদনভরা মর্সিয়া তুলে ধরেছিলেন।
জাদুকরি ক্ষমতার লেখক মার্কেস হয়তো লিখতেন: বনশ্রীর চোখের জল গাল দিয়ে গড়াতে না-গড়াতেই চৈত্রের গরমে বাষ্প হয়ে উবে যায় আকাশে। সেই বাষ্পজমা মেঘ তারপর উড়ে উড়ে কোথায় কোন দৈত্যপুরীর জানালার কাছে গিয়ে বৃষ্টি ঝরায়। সেই জানালার পাশে বন্দিনি মেয়েটি হয়তো চিঠির কাগজ দিয়ে পাখি বানিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিল মায়ের ঠিকানায়। তখনই মায়ের অশ্রুতে ভিজে মাটির পুতুলের মতো গলতে থাকে মেয়েটি, যতক্ষণ না সেই দৈত্য তাকে প্লাস্টিকে মুড়ে দেয়, যাতে সে আর কখনো ভিজতে না পারে, গলে যেতে না পারে। মার্কেসের সরলা এরেন্দিরা বা লাভ অ্যান্ড আদার ডেমন হতভাগ্য কিশোরীরা কি বনশ্রীর মতো মায়েদের মেয়ের মতো নয়?
সাহিত্যিকেরা ডুবুরির মতো মানুষের মনের সমুদ্রে ডুব দিয়ে অন্তরাত্মার খবর বের করেন, আর সাংবাদিকেরা খনন করে বের করেন ঘটনার রহস্য। গত শতকের ষাটের দশকে কলম্বিয়ায় নিয়মিতভাবে মানুষ অপহূত হতো। ডানপন্থী খুনে, বামপন্থী গেরিলা, সরকারি মিলিশিয়া—সবাই সবাইকে অপহরণ করত। সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কেউ বাদ যেত না। এ রকম কিছু অপহরণের ঘটনা নিয়ে মার্কেস লিখলেন নিউজ অব কিডন্যাপিং। সেটা পড়ে মনে হবে রোমাঞ্চকর উপন্যাস। আমাদের দেশে যখন রহস্যময়ভাবে ইলিয়াস আলী গুম হলে পরে গুজব রটে যে তাঁকে পাচার করা হয়েছে ভিনদেশে; একদিন তিনি ফিরে আসবেন। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করে, নদী দিয়ে বেওয়ারিশ ভেসে যাওয়া লাশগুলোর কোনো একটি তিনি। আমাদের এক বাবা অপহূত সন্তানের খোঁজে ভৈরব ও মেঘনা নদীতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ান; ভেসে যাওয়া লাশ হাত দিয়ে উল্টে দেখেন তাঁর সন্তান কি না। সেই সময় হয়তো পাশ দিয়েই মাইকে হিন্দি গানের ঝামাকা তুলে কারও প্রমোদতরি যাচ্ছিল। একদিকে গুম-অপহরণ-ভয়, অন্যদিকে লাগাতার উৎসবের এই বাংলাদেশে এখনো লেখা হয়নি মার্কেসের কলেরার দিনগুলিতে প্রেমের মতো উপন্যাস, যার বঙ্গীয় নামকরণ হতে পারত ‘উৎসবের দিনগুলিতে গুম-খুন’!
এই মার্কেস ছিলেন সাংবাদিক। উঁচু মানের সাহিত্য অথচ বিশ্বজোড়া জনপ্রিয়; এই অসম্ভবকে তিনিই সম্ভব করেছেন। বিশ্বজোড়া খ্যাতি তাঁর আশ্চর্য ও জাদুকরি কল্পনাশক্তির জন্য। অথচ এক সাক্ষাৎকারে তিনিই বলেন, তাঁর সব রচনার ভিত্তি হলো নিরেট বাস্তব। সেই বাস্তবের খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন তাঁর দাদির মুখে শোনা রূপকথায়। দাদি তাঁকে ছোটবেলায় শুনিয়েছিলেন এক আশ্চর্য সুন্দর কিশোরীর গল্প। সে যখন হাঁটত, কয়েকজন দাসি তার দীর্ঘ সোনালি চুল বয়ে নিয়ে যেত। বাস্তবে পুরোনো এক ভবন ভাঙার কথা শুনে খবরের আঁচ পেয়ে মার্কেস হাজির হলেন সেখানে। এবং তাঁর চোখের সামনেই ঘটল রূপকথায় শোনা সেই গল্পের সত্যায়ন। ভবনের চত্বরের কবরগুলোর একটির কফিন ভাঙতেই নেমে এল সোনালি চুলের ঢল। সাড়ে বাইশ মিটার লম্বা ঝলমলে চুলের নিচে পড়ে আছে কচি কিশোরীর গুটি কতেক হাড়গোড়। ২০০ বছর আগের সেই কবরের মেয়েটিকে নিয়ে মার্কেস লিখলেন অব লাভ অ্যান্ড আদার ডেমনস নামের মন খারাপ করা এক উপন্যাস।
মার্কেসের সিয়েরভা মারিয়ার সমবয়সী ফেলানী সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলে রক্ত ঝরিয়ে মরে গিয়েছিল বিএসএফের গুলিতে, ইচ্ছা করে গিয়ে দেখি সেখানকার মাটিতে লাল দোপাটি ফুটেছে কি না। এটা সেই দেশ, যেখানে এক বোন ইয়াসমিনের জন্য সাত ভাই জীবন দেয় দিনাজপুরে। এটা সেই দেশ, যেখানে ফুলবাড়ীর জমি বাঁচাতে শহীদ হয় তিন কিশোর। এটা সেই দেশ, যেখানে চাঁদে মানুষ দেখতে পায় দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির মুখ। এটা সেই দেশ, যেখানে এক নিহত কিশোরের বাবা দেশের সবচেয়ে বড় দুর্বৃত্ত পরিবারের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন নিরস্ত্র ডেসপারাডোর মতো। এই দেশে এক বৃদ্ধ জেনারেল বৈশাখ এলে উত্তেজিত হন। বয়সকালে যিনি ১০টি বছর দেশকে বুটের তলায় রেখেছিলেন, জীবনসায়াহ্নে তিনি গণতন্ত্রের জন্য আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে পরিহাস করেন। এটা ট্র্যাজেডি না কমেডি, তা তুলে ধরবে কে? সাহিত্যিক না সাংবাদিক? যে দেশে জাদু আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক করা কঠিন, সেই দেশে সাংবাদিক আর কাহিনিকারের মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর।
যে দেশে অপহরণ থেকে কেউই প্রায় যখন ফেরে না, তখন আশ্চর্যভাবে এক খ্যাতনামা স্ত্রীর স্বামী অপহরণের ৩৫ ঘণ্টা পরে ফিরে আসেন। একের পর এক অপহরণ আর গুম-খুনের কোনো ব্যাখ্যাই যখন মেলে না, তখন কেউ বিশ্বাস করতেই পারে যে ভিনগ্রহবাসীরাই মানুষকে নিয়ে যায়। আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগের টেকনোলজি রপ্ত করার কারণেই পুলিশ পেরেছে হারিয়ে যাওয়া আবু বকর সিদ্দিককে ফিরিয়ে আনতে। সাংবাদিকেরা যখন সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডসহ অজস্র রহস্যময় ঘটনার গুমর ফাঁসে ব্যর্থ হন, তখন র‌্যাব প্রচার করে স্বরচিত কাহিনি।
এই দেশে রানা প্লাজার গহ্বরে আবিষ্কৃত হয় গ্রিক ভাস্কর্যের মতো সুন্দর এক আলিঙ্গনের ছবি। অথচ কী নারকীয়ভাবেই না তারা মরে যেতে যেতে পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে ছিল। সেই মৃত্যুকূপের অন্ধকার দোজখের বাস্তবতা জানতে শুধু সাংবাদিকের বস্তুনিষ্ঠতা হলে চলে না, তখন দরকার হয় দরদি শিল্পীর গভীর কল্পনাশক্তি। সে রকম কল্পনাপ্রতিভার ছাপ আমাদের সাংবাদিকতার ভাষায় দেখা যায় কি?
কল্পনা শব্দটিও অদ্ভুত। যা কল্প বা বানানো নয়, তা-ই কল্পনা। লেখকের কল্পনা তাই সত্যের মতো বিশ্বাস্য হতে হয়। সাংবাদিকের প্রতিবেদনের মধ্যেও তো বেদনা শব্দের রেশ। প্রতি শব্দের সঙ্গে বেদন যোগ হয় বলেই মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে হয় সাংবাদিককে। আমাদের সাংবাদিকতার মধ্যে বেদনার এই ছাপ কতটা?
মার্কেস বিশ্বাস করতেন, উপন্যাস যা পারে, তা সাংবাদিকতাও পারে। একবার সমুদ্রতীরে ভেসে এল জাহাজডুবির এক নাবিক। তাকে নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখলেন। তখন যা ছিল প্রতিবেদন, সাহিত্যিক খ্যাতির চূড়ান্তে পৌঁছানোর পর সবাই সেটাকে বলল কী আশ্চর্য এক উপন্যাস! সেন্ট মার্টিনের সমুদ্রসৈকতে ডুবে মরে যাওয়া ছাত্রদের নিয়ে কি আমরা লিখতে পারি ডুবন্ত দেবদূতদের মতো গল্প? কিংবা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে লিখতে পারি ‘একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর দিনপঞ্জি?’
মার্কেস সাংবাদিকতা আর উপন্যাসের মধ্যে কোনো পার্থক্যই দেখেন না। তাঁর ভাষায়, ‘উভয়ের উৎস এক, উপাদান এক, ভাষাও এক। তবে সাংবাদিকতায় একবিন্দু মিথ্যা পুরো প্রতিবেদনকে নষ্ট করতে পারে, আর উপন্যাসে একবিন্দু সত্য পুরো কাহিনিকেই বৈধতা দিতে পারে। সরকারি ভাষ্যে এরকম একবিন্দু মিথ্যার অস্তিত্ব পেলে পুরোটাই মিছা মনে হয়। আবার হুমায়ূন আহমেদের গল্পগুলোকে সত্য মনে হয় বাস্তবতার একবিন্দু তাতে দেখা যায় বলে। যা বহু মানুষকে মুগ্ধ করে, তার মধ্যে সত্যি না থেকে পারে না।
এ দেশে অপহরণ, গুম, গরম আর নৈরাজ্যের জীবনে লেখক ও সাংবাদিকেরাই এখন ভরসা। আবার তাঁরা নিজেরাও কম বিপন্ন নন। তাহলেও তাঁদের লেখনী ছাড়া আমাদের জাতীয় জীবনের শতবর্ষের নিঃসঙ্গতার গল্প বলবে কে? সময় যে পেরিয়ে যায়। দুঃসময়ে মূক জনতার কথাকে বধির ক্ষমতার সামনে ছুড়ে দেবে কে? বেদনামেশা প্রতিবেদন আর কল্পনার শক্তিতে ভরপুর কাহিনি প্রকাশের দায় তো লেখক আর সাংবাদিকেরই।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.