যে জগতে আমি বিরাজ করি কবিতার জন্য তাকে বোঝাই যথেষ্ট মনে হয়েছে by নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

শিমুল সালাহ্উদ্দিন : আমি কি আপনাকে নীরেনদা বলতে পারি?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : কবিতা লেখো তুমি?
শিমুল : চেষ্টা করি।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তাহলে অবশ্যই বলতে পারও। আরে দাদা তো আমাদের কথার, সম্বোধনের একটি ভিন্ন মাত্রাও দেয়। আর সামনের অক্টোবরে নব্বইয়ে পড়ব, শরীরটাও খুব সায় দেয় না, মনের বয়স কিন্তু আমার এখনও তোমারই মতোন।
শিমুল : নীরেনদা, বাংলাদেশ তো আপনাকে স্বাগত জানাল প্রাণ খুলে। আপনি কালি ও কলমের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে কবিতা শুনিয়ে বলছিলেন মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন সেই পথে নতুন লেখকরা যেন না যায়। নতুন পথ যেন তারা তৈরি করে। তারপর কবিতা বিষয়ে বক্তৃতা দিলেন। বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিক, সাহিত্য সম্পাদকরাও দেখলাম আপনার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন, এই যে এলেন, কেমন লাগছে?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : এটা আমার দেশ। আমার ট্রাজেডি এই যে আমার দেশ আমার মাতৃভূমি বটে কিন্তু জন্মভূমি নয়। আমার জন্ম ফরিদপুরে। মানে তো বাংলাদেশে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমার দেশ ভারতবর্ষ। বাংলাদেশও আমার দেশ, জন্মভূমি অর্থে। আর আমি যখন জন্মেছি তখন তো পুরোটাই ভারতবর্ষ। তো আমার দেশে আমি এসেছি, স্বাগত জানানোর তো আপাতপক্ষে কিছু নেই। যেটুকু তোমরা হইচই করছ, আমার মনে হয় সে আমার কবিতাকে তোমরা গ্রহণ করেছ সেজন্য করেছ।
শিমুল : আপনি জন্মেছেন ১৯২৪ সালে, এখন ২০১৪ সাল। জীবনের দিকে ফিরে তাকালে কোন কোন ঘটনাগুলো সবার আগে চোখে ভেসে ওঠে?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তুমি তো আমার পুরো আত্মজীবনী জানতে চাইছ। সেটার একটা অংশ আমি লিখেছি। তবে জীবনের দিকে তাকালে সবার আগে নিজের বিষাদগুলোর কথা মনে পড়ে। ব্রিটিশরাজ দেখেছি, ভারতবর্ষের খণ্ড খণ্ড হয়ে যাওয়া, আমাদের স্বাধীনতা লাভ, স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখা, পশ্চিমবঙ্গের এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির দিকে যাওয়া এসবই আমার জীবনের বড় ঘটনা। ব্যক্তি হিসেবে বড় ঘটনা বলতে হবে, ধরো আমার প্রথম কবিতার বইটা যখন বেরুলো সেটা। এর চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত পারসোনালাইজড ঘটনাগুলোর কথা নাই বা বলি।
শিমুল : আপনার ইন্টারভিউর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, তো আনন্দবাজারের রবিবাসরীকে দেয়া একটা সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয় কবিতাই আমার মাতৃভাষা।’ সারা জীবনে তো গদ্যও লিখেছেন প্রচুর। খবরের কাগজে কাজ করেছেন।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : আমি মনেই করি কবিতা আমার মাতৃভাষা। গদ্য নয়। গদ্য আমি বাধ্য হয়ে লিখি। খবরের কাগজে কাজ করার কারণে লিখতে হয়েছেও প্রচুর। কিন্তু কেবলই মনে হয়, কবিতাকে ফাঁকি দিয়ে, তার থেকে সময় চুরি করে নিয়ে আমি গদ্যকে দিচ্ছি। গদ্য লিখতে আমার ভালো লাগে না।
শিমুল : অর্থাৎ এই নব্বইতে এসেও আপনি এত কবিতা লেখার পর আরও কবিতা লিখতে চান। আপনার মনে হয়, যে সময়টুকু জীবনের কবিতাকে দিলেন, আরও বেশি দেয়া উচিত ছিল? বাংলাভাষার কবি হিসেবে নিজেকে কত নম্বর দেন আপনি?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : অবশ্যই। আরও অনেক বেশি দেয়া উচিত ছিল। যত সময় দেয়ার দরকার ছিল তা দিতে পারিনি। তবে আমার মনে হয় না আমি কম লিখেছি। নম্বরপ্রথায় আমার আস্থা নেই। যা করেছি, তা পাঠকেরাই, অনুজ কবিরাই বলবে।
শিমুল : আপনার প্রায় সব কবিতাই একটা না একটা গল্প বলে। অথচ যখন শুরু করেছিলেন, বাংলা ভাষায় তখনও সেভাবে কবিতায় গল্প বলার প্রচলন ছিল না। যদি না আমরা রবিঠাকুরের ‘দুই বিঘে জমি’ কিংবা ‘ক্যামেলিয়া’র মতো কিছু কবিতাকে আলাদা রাখি। নিজের কবিতায় গল্প বলবেন এটা কবে ঠিক করলেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তবে কবিতায় গল্প বলার বিষয়ে কি জানো, সম্পূর্ণ গল্পটা তো আর আমি কবিতায় ধরে দিতে পারব না। গল্পের একটা আভাস আছে, একটা ইঙ্গিত আছে আমার কবিতায়। একটা আন্দাজ দিতে পারব। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি, আমাদের বাংলা সাহিত্যের কবিতা সেই গোড়া থেকেই গল্প বলে। মহাভারত পুরোটা জুড়েই গল্প আর গল্প। একগাদা গল্পের সমষ্টি। আমাদের মঙ্গলকাব্য গল্প ছাড়া আর কি! আর সেগুলো তো পদ্যেই লেখা। ছন্দে লেখা গল্প।
শিমুল : আমাদের ময়মনসিংহ গীতিকা কিংবা পাঁচালি?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : হ্যাঁ, পাঁচালি গল্প ছাড়া আর কি! দেখ পাঁচালিতে কি রয়েছে! আসলে মানুষ হচ্ছে ভোগবাদী। তকমাপ্রিয়। আমি তকমা চাই না। কবিতায় গল্প বলার ব্যাপারটা নতুন নয়।
শিমুল : তাহলে দাদা আপনার স্বাতন্ত্রটা কোথায়?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : দাঁড়াও পাঁচালির গল্পটা বলে নিই। বলছি আমি যা করেছি তা-ও। পাঁচালিতে কি রয়েছে! একটা পরিবার খুব অশান্তিতে ভুগছে, পরিবারের যিনি শ্মশ্রুমাতা, শাশুড়ি ঠাকরুন, তিনি বনে গেছেন আত্মহত্যা করতে। তারপর সেখানে বনলক্ষ্ণীর সঙ্গে দেখা। বনলক্ষ্ণী জিজ্ঞেস করছে, বনে এসছো কেন? শাশুড়ি ঠাকরুন বলছে, আমি আত্মহত্যা করতে এসেছি। কেন? বলছে যে আমার সাতটা ছেলে, সাতপুত্র, কর্তা হয়ে, সাতপুত্র সাত হাঁড়ি হয়েছে এখন, সতত বঁধুরা মোরে করে জ্বালাতন। কেমন! বনলক্ষ্ণী বললেন তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বুড়িবারে সন্ধ্যাকালে মিলি বামাগণ, বুড়িবার মানে বৃহস্পতিবার, বামাগণ মানে নারীগণ, সকলে লক্ষ্ণীর পূজা করো আয়োজন। তাহলে দেখবে সংসারে আবার শান্তি ফিরে আসবে। এটা গল্প ছাড়া আর কি! গল্প পুরনো ব্যাপার আর কবিতার মধ্যে গল্প বলাটা নতুন কিছু না।
শিমুল : কিন্তু আপনার কথনভঙ্গি! গদ্যের চলনে অন্তমিলের মৌলিক খেলা!
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : আসল কথাটা তা নয়। আসল কথাটা হচ্ছে, লিরিক কবিতা, লিরিক কবিতায় গল্প বলার চলনটা ছিল না। লিরিক কবিতার আমরা একটা ভুল ব্যাখ্যা করি। লিরিক কবিতাকে আমরা বলি গীতি কবিতা। না গীতি কবিতা নয়, এটা পারসোনালাইজড পয়েট্রি।
শিমুল : পারসোনালাইজড মানে কি কাস্টোমাইজড দাদা?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : একেবারে ব্যক্তিগত উচ্চারণ বলতে যা বোঝায়। নিজের মতো। এখানে গদ্যের মধ্যেও কবিতার সেই গীতসুধাটা থাকে। তো সে অর্থে আমি কোনো নতুন কাজ করিনি। যেটা করেছি, সেটা হল আমি আমার ভাষায় করেছি, এবং আমি মনে করি, আমি যদি গল্প ঢুকিয়েও থাকি কবিতার মধ্যে সেটা কোনো অন্যায় করিনি।
শিমুল : তা অন্যায় করেননি মোটেও। আপনাকে প্রথম চিনেছিলেন আপনার বন্ধু কবি অরুণকুমার সরকার। আপনার প্রথম বই নীলনির্জনে বেরুবার গল্পটা শুনতে চাই। প্রথম বই তো সব কবির কাছেই মহাআরাধ্য হীরকমণিমুক্তার মতো, স্পেশাল
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : কবিতা না লিখে তো আমার উপায় ছিল না। কিন্তু নিজের পয়সা দিয়ে বই আমার বের করার কোনো ইচ্ছা কোনোকালেই ছিল না।
শিমুল : অরুণকুমার সরকার আপনার বই বের করে দিয়ে বলেছিলেন, কবিতা না লিখলে তুই তো মরেই যাবি!
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : এক দিন হঠাৎ আমার কাছে অরুণ সরকার এসে বলেন, আমার বন্ধু, যে, তোমার কাছে সিগনেট প্রেসের দিলীপ গুপ্ত মশায়, সিগনেট তখনকার কালে ভীষণ নামকরা পুস্তক প্রকাশন প্রতিষ্ঠান, তারা তখন নেহরুর ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বের করেছে, এবং বড় কবিদের, বড় লেখকদের বই বের করে যাচ্ছে, তার মধ্যে অরুণ এসে বলল, তোমার একটি বই দিলীপবাবু চেয়েছেন। তুমি একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরি করে দাও। আমি সত্যি বলছি, আমি বিশ্বাস করিনি, উনি বললেন যে, সত্যিকথা বলছি, তৈরি করে দাও, তোমার নাম করে চেয়েছেন দিলীপবাবু। তো ওর জোরাজুরিতে বিশ্বাস করতে হল, একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিলাম, অরুণকুমারের হাতেই দিয়ে দিলাম, তিনি গিয়ে দিলীপবাবুর হাতে দিলেন, বই বেরিয়ে গেল। বই বেরুবার পর কিন্তু আমি জানতে পারলাম দিলীপবাবু আমার বই চাননি। তিনি অরুণের বই চেয়েছিলেন। তিনি অরুণকুমার সরকারের বই চেয়েছিলেন, বই বেরিয়ে গেছে আমার।
শিমুল : এটা কি ইচ্ছে করেই করেছেন তিনি?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : একদম ইচ্ছে করেই করেছে। আমি জেনে তো রেগেমেগে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা তুমি কেন করলে। তোমার বই উনি চেয়েছেন আর তুমি আমাকে বললে আমার বই চেয়েছেন, এটা তুমি কেন করলে? আমার বই বেরুনো দরকার ঠিকই কিন্তু তোমার বইও তো বেরুনো দরকার! তুমি আমার কাছে চাইলে কেন? আমি চার্জ করলাম।
শিমুল : অরুণকুমার সরকার কি বললেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : অরুণ হেসে বলল, তুমি আমার চেয়ে বড় কবি এমন কথা ভেবে কিন্তু বলিনি। তুমি ভেবো না তুমি আমার চাইতে ভালো লেখ। কিন্তু তোমার বই বেরুনো দরকার আমার চাইতে বেশি। এ জন্য আমি নিজের বই না করে তোমার বই দিয়েছি।
শিমুল : নীরেনদা আপনি উলঙ্গ রাজার জন্য পেয়েছেন আকাদেমি পুরস্কার, সেই কবিতায় যে সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশুকে খুঁজছিলেন, যে বলবে, ‘রাজা, তোমার কাপড় কোথায়?’ তাকে কি দেখেছেন আপনি আপনার জীবনে? পেয়েছেন তার দেখা?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : বাচ্চারা তো এত সব ধান্দাবাজি বোঝে না আমাদের মতো। আমরা বড় যত হই তত ধান্দাবাজ হই। কার প্রশংসা করব, তার কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়ার আছে কি না এসব ভেবে কাজ করি, চারদিক কতগুলো চাটুকারের দ্বারা পরিবৃত হয়ে গেছে, এরা আমাদের মন রেখে কথা বলে। বাচ্চারা এসবের ধার ধারে না, এই কারণে সত্য বলতে তাদের কোনো বাধা নেই, সত্য কথাটা একমাত্র তারাই বলে। তো, এটা যেমন হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের গল্পে এটা আছে, এই যে একই গল্পের নানান ভার্সন নানান ভাষায় ছড়িয়ে আছে, চালাক জোলা আর বোকা রাজার গল্প, আসলে কোনো রকম কাপড় নেই, সে কাপড় পরানোর একটা ভঙ্গি করে। হাওয়ায় হাত ঘুরিয়ে, রাজাকে বোকা বানিয়ে টাকা নিয়ে চম্পট দেয়।
শিমুল : আহা রাজসত্র, চোখে দেখা যায় না!
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : হ্যাঁ, এত পাতলা সুতো যে চোখে দেখা যায় না। এ গল্পটা ঠাকুমার কাছে ছেলেবেলায় শুনেছিলাম। তারপর মনে হয়েছে চারদিকের অবস্থা দেখে, যে কেউ সত্য কথাটা বলছে না। সবাই যে শাসক তার মন রেখে কথা বলছেন।
শিমুল : নীরেনদা, এই কবিতার নির্যাস আপনি যেখান থেকে নিয়েছেন সে সোর্সটা আপনি বললেন, আপনার সব থেকে জনশ্র“ত যে কবিতা অমলকান্তি, সেটি ওপার বাংলায় যেমন এখানেও আবৃত্তিশিল্পীরা বহুবার আবৃত্তি করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমিও মঞ্চে পড়েছি বহুবার, এমনকি অমলকান্তি তো বাংলাদেশে চলচ্চিত্রেও রূপায়িত হয়েছে, পারভেজ চৌধুরী অমলকান্তি চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন, সে কবিতার সোর্স বা নির্যাসটি কীভাবে পেয়েছিলেন? অমলকান্তি কি আপনি?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : না, আমি নামটা পাল্টানোর কোনো দরকার বোধ করিনি। অমলকান্তি আমার বন্ধু। ইশকুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম। এভাবেই তো কবিতাটা শুরু, এর প্রত্যেকটি কথা সত্য। আমার স্কুলের যে বন্ধু তার নাম অমলকান্তিই বটে। গরিব ঘরের ছেলে। এক দিন, খেলার মাঠে বসে ময়দানে কথা বলছিলাম, নিজেদের মধ্যে, কে কি হতে চায়! কেউ মাস্টার হতে চায়, কেউ ডাক্তার হতে চায়।
শিমুল : অমলকান্তি রোদ্দুরই হতে চেয়েছিল? বড় বেশি কাব্যিক না চাওয়াটা?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : বটে! কিন্তু ও যে রোদ্দুরই হতে চেয়েছিল। গরিব ঘরের ছেলে, বস্তিতে থাকত। এমন একটা বস্তিতে থাকে যেখানে রোদ্দুর ঢুকত না। ফলে ওর কাছে রোদ্দুর একটা প্রিয় জিনিস। কিন্তু সেই রোদ্দুরটা সে পাচ্ছে না। সে নিজেই রোদ্দুর হয়ে যেতে চাইছে।
শিমুল : আপনার কবিতা সম্পর্কে একটা উক্তি তো বহুল আলোচিত, আপনি বলেন, কবিতা কল্পনালতা নয়, এই কথা কেন? কবিতা ক্ষেত্রে তো সব সময়ই কল্পনার অবকাশ থেকে যায়। কয়েক দশকে তো আমরা এমন অনেক কবিদের দেখছি তারা তাদের কল্পনার অন্য এক জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান। কিন্তু আপনার কবিতা অনেকাংশেই সমাজবাস্তবতানির্ভর। সেখানে তেমন করে কল্পনার সুযোগ নেননি কেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : আমার কল্পনা অত্যন্ত দরিদ্র। অত্যন্ত দরিদ্র। যে জগতে আমি বসবাস করি, বিরাজ করি কবিতার জন্য তাকে জানা বোঝাই আমার যথেষ্ট মনে হয়েছে। কল্পনার প্রয়োজন হয়নি আমার। কিংবা বলতে পারও, কল্পনার ধার আমি ধারিনি।
শিমুল : কিন্তু যারা কল্পনালতায় ভেসে কবিতা লেখেন তাদের কবিতা কি আপনি পছন্দ করেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তা করি। সব ধরনের কবিতাই আমি পছন্দ করি। সেটা কোনো কথা নয়। কিন্তু আমার কল্পনা এত দরিদ্র আমি কিছু কল্পনা করতে পারি না, আমি চারপাশের মানুষদের দেখি, তাদের সুখ-দুঃখের খবর রাখি। হাটে-বাজারে যাই, তাদের কথা শুনি। বাসে-ট্রামে চলাফেরা করি, মানুষ দেখি, আমার হালে একটা গাড়ি হয়েছে, আমার গাড়িও ছিল না, আর গাড়ি আমি পছন্দও করিনি, সারাজীবন ট্রামে বাসে যাতায়াত করেছি, লোকের কথা শুনেছি, যা শুনেছি, যা নিয়েছি তা থেকেই আমার কবিতা হয়ে যায়। আমার কিছু কল্পনা করতে হয় না।
শিমুল : আপনার কবিতা এত নিখুঁত ছন্দে ঢালা কীভাবে হয়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার নামে আপনার একটা কবিতা আছে। প্রিয়তমাসু। আমি নিজেও প্রচুর পড়েছি সেটি মঞ্চে। (আমি পড়তে শুরু করি স্মৃতি থেকে)
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : বাহ! খুব সুন্দর পড়েছ কবিতাটি, ছন্দটা ধরতে পেরেছ।
শিমুল : দাদা এই যে এ কবিতায় আপনি বলছেন, ‘এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,/ এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,/ এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।/ দ্যাখো, কোনোখানে কোনো বিচ্ছেদ নেই। //’’ আপনার কবিতা এত নিখুঁত ছন্দময়, অথচ আপনি যেন পাঠককে সেটা বুঝতে দিতে চান না, গদ্যছলনার মুখোশে ঢেকে দেন যেন, এটা কেন করেন? সচেতনভাবেই করেন? নাকি লিখতে লিখতে আপনার সেই প্যাটার্নটা দাঁড়িয়ে গেছে?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : দীর্ঘ সময় ধরে লিখছি, একটা ব্যাপার তো তৈরি হয়েছেই। যাতে আমি বলি আমিত্ব, তুমি হয়তো স্বতঃস্ফূর্ততা বলছ। আমি যেভাবে মানুষ কথা বলে সেটা ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি কবিতায়।
শিমুল : নীরেনদা, আপনি কি মুখের ভাষার কথা মানে প্রাত্যহিক ব্যবহারিক ভাষার কথা বলছেন? কতটা নিলেন মুখের ভাষা থেকে?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : হুম, যাপিত জীবনে মানুষের ব্যবহার করা ভাষা। মুখের ভাষা। আমি মনে করি, তার থেকে কবিতার অনেক কিছু নেয়ার আছে। আমি সবটা এখনও নিয়ে উঠতে পারিনি। খামতি থেকে গেছে। কিন্তু মানুষ মুখের ভাষায় যেভাবে কথা বলে, এর চেয়ে ভালো কবিতার উপাদান আর হয় না। আমার কবিতার ভাষা একটা বানিয়ে তোলা নয়। গদ্যটা মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটানোর জন্য বলে যায়, নির্মাণ করে। কিন্তু মুখের ভাষার মতো অথেনটিক, অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ এবং অত্যন্ত জেনুইন ভাষা আর কিছু হতে পারে না, নির্মিত গদ্যের ভঙ্গি স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে না।
শিমুল : নীরেনদা, আমাদের এখানেও তো, মানে ঢাকায়, যদিও আপনার অনেক পরে, মুখের ভাষায় লেখা হচ্ছে কবিতা, আপনি কি পড়েছেন সেগুলো?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তোমাদের এখানে বা আমাদের ওখানে বলে কিছু আমি বিশ্বাস করি না, পুরোটাই আমার, একই ভাষায় আমরা লিখি। মুখের ভাষায় যারাই লিখেছে তারা ভালো করেছে বলে আমার মনে হয়। ঢাকার কিছু পত্রপত্রিকা পাই, অনেকের সংলাপনির্ভর লেখা, বা আঞ্চলিক কবিতা আমি আগ্রহ করে পড়ি। ভালো লাগে।
শিমুল : বাংলাদেশের কাদের কবিতা পড়েছেন বা ভালো লেগেছে নাম করতে পারেন?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : নাম করতে চাই না, অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে।
শিমুল : ছেলেবেলায় তো ওস্তাদ রেখে গান শিখেছিলেন, গান ছেড়ে দিয়ে কবিতায় কেন মনোনিবেশ করলেন? কবিতায় যে এলেন সেটা কি কোনো একটা মিরাকলের কারণে? কোনো একটা গোধূলির কারণে?
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : তালিম করে গান শিখতে হয়েছে। সেটা আমার কান তৈরি করে দিয়েছিল সেই ছোটবেলাতেই। গান নিয়ে চাওয়াটা বোধহয় ছিল না। গান আমি এখনও ভীষণ ভালোবাসি। কিন্তু কবিতা আমাকে নিজের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়েছে। গান খুব ভালোবাসি, কালকেই যেখানে গেলাম, একটি মেয়ে, কৃষ্ণকলি বলে নাম, কি গাইল, ভগবান কি গলা ওকে দিয়েছেন! ওর গলাটা, ওখানে সুর নিয়ে ও যে খেলা করছে, অসাধারণ, আমার, আমার তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা মনে পড়ে গেল, গাইছে কাশিনাথ, নবীন যুবা, ধ্বনিত সভাগৃহ আজি, ডানা মেলিতেছে সাতটা সুর, সাতটা যেন পোষা পাখি, এই মেয়েটির কালকে গান শুনছিলাম, গলায় খেলা করছে যেন পোষা পাখির মতো, গানের কথাও খুব চমৎকার।
শিমুল : কৃষ্ণকলি শুনলে খুবই আপ্লুত হবে নীরেনদা! সহোদরা কবিতায় আপনি বলছেন,
‘না, সে নয়। অন্য কেউ এসেছিল। ঘুমো তুই ঘুমো।
এখনও রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরে চুমো
লাগেনি শিশিরে। ওরে বোকা,
আকাশে ফোটেনি আলো, দরজায় এখনো তার টোকা
পড়েনি। টগর-বেলা-গন্ধরাজ-জুঁই
সবাই ঘুমিয়ে আছে, তুই
জাগিসনে আর। তোর বরণডালার মালাগাছি
দে আমাকে, আমি জেগে আছি।
না রে মেয়ে, না রে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না। আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত,
এমন অনেক ব্যথা-আকাক্সক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে। তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হ’য়ে ঘুমো।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে ওঠেনি তার গান।
ওরে বোকা,
এখনও রয়েছে রাত্রি, দরজায় পড়েনি তার টোকা।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী : সহোদরা, দুই বোনের দুঃখের কথোপকথন। বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে এক বোন যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, রাত জেগে জেগে, সেই কষ্টের ভেতর দিয়ে তার দিদিও এক দিন গিয়েছিল, দিদির মনে পড়ে যাচ্ছে তার নিজের জীবনের কথা, এই কষ্টটা সেও এক দিন ভোগ করেছে।
শিমুল : নমস্কার দাদা। ভালো থাকবেন।

No comments

Powered by Blogger.