আওয়ামী লীগ কোন পথে by ফারুক ওয়াসিফ

ওয়ান্ডারল্যান্ডে ভয়-উত্তেজনা আর আনন্দের বিপরীত দশায় এলিসের যে অবস্থা হয়েছিল, সেই অবস্থা বুঝি এখন বাংলাদেশের। আমরা এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখে অর্ধমুগ্ধ, অর্ধবিধ্বস্ত। একরকম শান্ত রক্তক্ষরণ চলছে ভেতরে ভেতরে। দুর্নীতি ও সহিংসতার চাকা আবার আগের নিয়মে ঘুরছে। সপ্তাহে এক হালি গুম-খুন, ছাত্রলীগের দেশকাঁপানো হুজ্জত-মারামারি, মন্ত্রী-এমপিদের শনৈঃ শনৈঃ বাক্যবর্ষণ আর মাঝেমধ্যে লন্ডনপ্রবাসী সাবেক রাজপুত্রের পিলে চমকানো বাণী। নাগরদোলায় উঠলে যেমন মাথা ঘোরায় আবার মজাও লাগে; আমাদের অনেকেরও তেমনি হালচাল দেখে মাথা ঘোরাচ্ছে আবার দুঃখে হাসিও পাচ্ছে। এই অবস্থারই নাম দিয়েছি অর্ধমুগ্ধ অর্ধবিধ্বস্ত দশা। মুগ্ধতাটা সাময়িক কিন্তু বিপর্যয়ের রেশ থাকবে অনেক দিন। হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন, যতই ওপরে উঠি ততই নীল, যতই নিচে নামি ততই মধু। সরকারের ওপর মহলের যতই আত্মবিশ্বাসের হাসি দেখা যাক, নিচতলার কর্মীরা ততই হতাশ।
ভোটারবিহীন নির্বাচনের রেকর্ড গড়ে আওয়ামী লীগ দিব্যি বিএনপিকে জব্দ করেছে। দলের নেতা-কর্মীদের লাগামছাড়া কথা আর মাঠে ছাত্রলীগের মাত্রাছাড়া দাপট দেখেও মনে হয়, নিজেদের কীর্তিতে তারা নিজেরা দারুণ মুগ্ধ। দেশ কোথায় চলেছে সেই হিসাব বাদই থাক, দলের ভবিষ্যৎটাও মনে হয় তারা আর দেখতে পারছে না। এটা একধরনের নিশিচলন। নিশিতে পেলে যেমন মানুষ ঘুমের মধ্যে হাঁটে, দলটি সে রকম ঘুমের ঘোরে খাদের দিকে চলছে। থামানোর কেউ নেই।

আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের মধ্যে অন্তত দুজন এই বাস্তবতা উপলব্ধি করেছেন। গত বছরের ২৪ জুলাই যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক সভায় বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অস্তিত্বের ভিত্তিমূলে আঘাত এসেছে। এই মুহূর্তে কোন্দল পরিহার করে একটি এজেন্ডা নিয়ে তৃণমূল নেতাদের এখন থেকে কাজ শুরু করতে হবে। আর এটি হচ্ছে জনগণের সঙ্গে ভালো আচরণ করা। আমাদের কৃতকর্মের জন্য ভুল স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাঁচটি সিটি নির্বাচনে পরাজিত না হলে আমাদের নিদ্রাভঙ্গ হতো না।’ বছর খানেক আগে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ (তখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন না) বলেছিলেন, ‘নেতা এখন বানিয়ে দেওয়া হয়’। এ ধরনের নেতাদের হাইব্রিড বলার চল হয়েছে।
এ অবস্থায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরাও ওই অর্ধমুগ্ধ ও অর্ধবিধ্বস্ত দশা পার করছেন। বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করায় তাঁরা মুগ্ধ। তাঁরা বিধ্বস্ত, কারণ, এলাকায় দলের অবস্থা খুবই বাজে। একদিকে জনগণকে তাঁদের বলার কিছু নেই, অন্যদিকে নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে তাঁরা পর্যুদস্ত। নেতা বনাম কর্মী, এমপি বনাম নেতা, কেন্দ্র বনাম প্রান্তবিরোধে সাংগঠনিক শক্তি কতটা ক্ষয়িত, তা বোঝা গেল উপজেলা নির্বাচনে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের ছড়াছড়ি। সংগঠনের অগোছালো অবস্থা আরও খোলাসা হয়ে পড়ল। পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় উপজেলা নির্বাচনেও ধসে গেল জনপ্রিয়তার বড়াই। খালি মাঠেই যদি এই হাল হয়, তাহলে সত্যিকার চ্যালেঞ্জ এলে কী হবে?
বাংলাদেশে একটি স্লোগান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল: ক্ষমতা না জনতা/ জনতা জনতা। আওয়ামী লীগ গণ-আন্দোলনের দল। জনসমাজে দলটির আদর্শিক আকর্ষণ ছিল। তাই ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তারা আবার ক্ষমতায় আসে। জনসমর্থনের জোরেই জরুরি অবস্থার চাপতাপও যে তারা উতরাতে পেরেছিল। কিন্তু গত সাড়ে পাঁচ বছরে সমীকরণ বদলে গেছে। জনতা ছেড়ে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভিসন্ধিমূলক ব্যবহার আর প্রহসনের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের বিচ্ছেদ ঘটছে। জনসমর্থন পড়তির দিকে, আদর্শের ভাবমূর্তি মলিন, কর্মীরা দিশাহীন। শামুক নাকি আমৃত্যু হাঁটে, শেষ সময় যতই চলে ততই তার ক্ষয় হয়। একচেটিয়া ক্ষমতা আর দুর্নীতির বিষে দলটির অভ্যন্তরীণ ক্ষয় এমন জায়গায় গেছে যে এখন প্রশাসনই তার প্রধান ভরসা।
মঙ্গলবারের প্রথম আলোর প্রধান সংবাদে এই পরিস্থিতির সারাংশ এককথায় বলা হয়েছে: প্রশাসননির্ভর আ.লীগ। ওই সংবাদে আরও বলা হয়, ‘দলের এ রকম সাংগঠনিক পরিস্থিতি থাকায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের আন্দোলন ও সহিংসতার বিরুদ্ধে মাঠপর্যায়ে আওয়ামী লীগ দলগতভাবে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি; বরং বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সংখ্যালঘুদের প্রশাসনকে নিরাপত্তা দিতে হয়েছে। এমনকি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রেও সরকারের একটি বিশেষ সংস্থাকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এরশাদ শেষ মুহূর্তে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর তাঁকে বশে রাখাসহ রওশনের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে আনা এবং আসন বণ্টনের ক্ষেত্রেও ওই সংস্থাটির বড় ভূমিকা ছিল। কোন আসনে আওয়ামী লীগের কোন প্রার্থী থাকবেন বা প্রত্যাহার হবেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের সে সিদ্ধান্তও কার্যকর করেন ওই সংস্থার কর্মকর্তারা।’
ক্ষমতানির্ভর হতে গিয়ে দেশের অন্যতম প্রাচীন দলের এমন অবস্থা দেশের জন্য সুখবর নয়। কারণ, অন্য বিকল্প নেই। বিএনপি-জামায়াত ভোটে জিততে পারে, কিন্তু এখনো মূলধারার বাংলাদেশের আস্থা তারা অর্জন করতে পারেনি। এভাবে মানুষ যদি সব ভরসা হারিয়ে ফেলে, তাহলে রাষ্ট্র সংহত হতে পারে না। জনগণবর্জিত এ ধরনের রাষ্ট্র দেশি-বিদেশি অপশক্তির খেলার পুতুল হয়ে পড়ে। দেশ হয়ে পড়ে প্রতিরোধশক্তিহীন।
মানুষ নাকি তিন প্রকারের: মনস্থ, তটস্থ ও ঘোরগ্রস্ত। সরকার যখন এভাবে ঘোরগ্রস্ত তখন বিএনপি তটস্থ। মনস্থ কেবল জামায়াত। বিএনপির নেতা-কর্মীরা আন্দোলন সংগ্রামের চেয়ে মাতৃদত্ত প্রাণ আর ক্ষমতাদত্ত সম্পদ বাঁচানোতেই ব্যস্ত। অন্যদিকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ব্যস্ত সম্পদ বাড়াতে।
উভয় দলই যখন এভাবে রাজনৈতিকভাবে অবক্ষয়িত হচ্ছে, তখন মাঠে-ময়দানে সবচেয়ে বেশি তৎপর জামায়াতে ইসলামী। এরাই মানুষের কাছে যাচ্ছে। অন্যান্য দলের বড় নেতা ও সাংসদেরা ঢাকাভিত্তিক বলে এলাকায় তাঁদের যোগাযোগ কমজোরি হয়ে পড়ছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা যেখানে মানুষকে ভোট দিতে উৎসাহিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে জামায়াতে ইসলামী সর্বশক্তি দিয়ে ভোট বয়কটের কাজ করেছে, জ্বালাও-পোড়াও চালিয়েছে। সরকারি নেতারা জনরোষের ভয়ে এলাকা ত্যাগ করলেও, এরা মাটি কামড়ে পড়ে থেকে সংগঠনকে বাঁচিয়েছে। কোথাও আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে, কোথাও লীগের নেতাদের সার্টিফিকেট ক্রয় করে, কোথাও পুলিশকে হাত করে সাংগঠনিক ভিত টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন। নিজেদের নিপীড়িত হিসেবে দেখিয়ে মানুষের সহানুভূতি কাড়ার চেষ্টাও বাদ যায়নি। ফলাফল, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি ভোট অর্জন। এই পরিস্থিতি তৈরির দায় কি আওয়ামী লীগের নয়?
আওয়ামী লীগ নিজেকে শুধু নয়, তার মিত্রদেরও বেকায়দায় ফেলেছে। সংসদে জাতীয় পার্টির নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, সরকারের জন্য তাঁরা বাইরে মুখ দেখাতে পারেন না। প্রায় একই ধরনের আক্ষেপ লীগের তৃণমূল প্রতিনিধিদের সভায়ও শোনা গেছে। দেশে এমন অনেক সৎ ও ত্যাগী মানুষ আছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার সুখী-সুন্দর বাংলাদেশ চান, যাঁরা আজীবন গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছেন; আজ তাঁরা মনের মধ্যে গুমরে মরছেন। বিএনপি-জামায়াত সুবিধা পাবে বলে মুখ খুলছেন না। কিন্তু নীরবতা প্রলয় থামাতে পারে না।
আকাশকুসুম মনে হতে পারে; তবু উপায় আছে। যে সমস্যা শাসকেরা তৈরি করেছেন, তার সমাধানের প্রধান দায়িত্ব তাঁদেরই। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, সব দল, শ্রেণী ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় সংলাপ করতে হবে। সেখানে অবাধ নির্বাচনের উপায়, যুদ্ধাপরাধীদের টেকসই বিচার নিষ্পন্ন এবং দেশ পরিচালনার বনিয়াদি কিছু নীতিমালা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। পরস্পরকে বিনাশের মাধ্যমে দেশের সর্বনাশ করার রাজনীতি বাদ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন, দুদক, গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহির বিষয়ে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ তার হারানো মনোবল আর সংহতি ফিরে পাবে না।
নইলে যেভাবে দেশ খাড়াখাড়িভাবে দুভাগে ভাগ হয়ে আছে, যেভাবে দুই পক্ষের মাঝখানে গহ্বর ক্রমেই গভীর হচ্ছে, সেই গহ্বরে জনগণসুদ্ধ রাজনীতিবিদেরাও পতিত হবেন। মাছির মৃত্যু হয় রসে ডুবে। রাজনীতি বদলাক ক্ষতি নেই। কিন্তু ক্ষমতার রসাতলে তার অপমৃত্যু হোক, তা আমরা চাইতে পারি না।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.