মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছি by নূরুজ্জামান লাবু

অপহরণকারীদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী এবি সিদ্দিক ভুলতে পারছে না সেই ৩৫ ঘণ্টার দুঃসহ স্মৃতি। এই সময়ে কখন কি ঘটেছিল তা স্মৃতি আওড়ে বলার চেষ্টা করছেন স্বজনদের কাছে। জানাচ্ছেন গণমাধ্যমকর্মীদেরও। গতকাল সেন্ট্রাল রোডের বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় এবি সিদ্দিক জানিয়েছেন অপহরণ ঘটনার আরও কিছু তথ্য। তিনি বলেন, অপহরণের পর তাকে যে বাসায় নিয়ে রাখা হয়েছিল ওই বাসার ওপর দিয়ে তিনি বেশ কয়েকবার হেলিকপ্টার উড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছেন।
অপহরণের দিন গত বুধবার সন্ধ্যার দিকে এবং এক দিন পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেও তিনি হেলিকপ্টার চলাচলের শব্দ পান। তবে তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তাকে আটকে রাখার জায়গাটি কোথায় হতে পারে। এবি সিদ্দিক জানান, তাকে আটকে রাখার জায়গাটি অনেকটা বাংলোর মতো বলে তিনি ধারণা করেছেন। একটি গেট দিয়ে ঢোকার পর কিছু সময় হাঁটিয়ে তাকে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কক্ষের পাশেই আরেকটি কক্ষ ছিল। যেটিতে কার্পেট বিছানো এবং চেয়ার টেবিল ছিল। রাতে তিনি কার্পেটের ওপরই ঘুমিয়েছিলেন। এবি সিদ্দিক জানান, তাকে যারা অপহরণ করেছিল তারা সাধারণ কেউ না। তাদের আচরণ ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড দেখে তিনি বুঝতে পারেন অপহরণকারীরা সবাই অনেক স্মার্ট। তবে কক্ষে ঢোকানোর পর অপহরণের সময় থাকা ব্যক্তিরা ছিল না। তাকে তিন ব্যক্তি পাহারা দিয়েছেন। ওই তিনজন কক্ষটি সর্বদা পাহাড়া দেয় বলে তাঁর মনে হয়েছে। ওই বাসায় আগেও আরও অনেক ব্যক্তিকে আটকে রাখা হয়েছে বলে তিন প্রহরী বলেছেন। গার্মেন্ট ব্যবসায়ী সিদ্দিক বলেন, এই তিন ব্যক্তি তাকে মামা বলে ডাকতো। এবং তারা তার প্রতি সহানুভূতিও দেখিয়েছে। তিনি বলেন, অপহরণের দিন সন্ধ্যায় তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়। এ সময় তার দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা ছিল। ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও তিনি বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। অপহরণকারীদের তিনি বলেছেন, তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এসময় তিনি কিছু ওষুধের নামও বলে দেন। কিছুক্ষণ পরই অপহরণকারীরা তার ওষুধ এনে দেয়। তবে কো-ডায়োভ্যান নামে একটি ওষুধ তারা আনতে পারেনি। এবি সিদ্দিক বলেন, এই ওষুধটি একটু দামী। এজন্য বড় কোন ফার্মেসি ছাড়া ওষুধটি পাওয়া যায় না। অপহরণকারীরা এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর ওষুধ কোথাও থেকে সংগ্রহ করে এনে দেয়। তিনি জানান, অপহরণকারীদের বস কেবল তাকে ‘তুই’ সম্বোধন করেছে। অন্য যে তিনজন সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে ছিল তারা আপনি বলেছে। অপহরণকারীরা তাকে ভাল খাবারও পরিবেশন করেছে। রাতে ও দুপুরে তাকে মাংস ও ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিয়েছে। সকালে পাউরুটি-কলা নাস্তা খাইয়েছে। একজন অপহরণকারী তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কারও জমিজমা নিয়ে বিরোধ রয়েছে কি না? উত্তরে তিনি বলেছেন, তার স্ত্রী পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন। এজন্য অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হয়তো। কিন্তু সরাসরি কোন বিরোধ নেই। এটা শুনে তারা আর কিছু বলেনি। সিদ্দিক বলেন, তাকে পাহারা দেয়া তিনজনকে তিনি নাম জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তারা কেউ নাম বলেনি। একজনের ভাষায় চিটাগাংয়ের আঞ্চলিকতার টান ছিল। পরে জিজ্ঞেস করলে সে তার বাড়ি চিটাগাং বলে স্বীকার করে।
আগের দিনের মতো গতকালও দিনভর সেন্ট্রাল রোডে ৫৭/২ নম্বর রিজওয়ানা হাসানের বাসায় আত্মীয়স্বজন, শুভানুধ্যায়ী ও সংবাদকর্মীদের ভিড় ছিল। অপহরণের পর থেকে ফিরে আসা এবং পরবর্তী দুদিন সবার ওপর দিয়ে ধকল গেছে। ধীরে ধীরে ধকল কাটিয়ে উঠছেন এবি সিদ্দিক নিজেও। অপহরণকারীদের হাত থেকে ফিরে আসা বৃহস্পতিবার রাত থেকে পরদিন বেশিরভাগ সময় তাকে পুলিশ ও আদালতে সময় দিতে হয়েছে। শুক্রবার রাতে ঘুম হয়েছে। এবি সিদ্দিক বলছিলেন, অপহরণকারীরা তাকে ঘুমানোর বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল। কিন্তু এমন সময়ে কার চোখে ঘুম আসে বলেন? তিনটি গামছা ভাঁজ করে তার মাথায় দিয়ে দেয়। এর আগে রাতে তার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়। কিন্তু চোখের বাঁধন ওরা খুলে দেয়নি।
এবি সিদ্দিক জানান, অপহরণকারীরা তাকে গাড়িতে তুলে দুটি ফেরি পার হয়েছিল। প্রথম ফেরি পার হওয়ার পর তার গাড়িটি পরিবর্তন করা হয়। এ সময় তাকে কয়েকজনে ধরে অপর একটি গাড়িতে তোলে। তার ধারণা, নতুন গাড়িতে তুলে অপহরণকারীরা তাকে আবার ফেরি পার করে ঢাকার দিকে নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ঢাকার খুব কাছে কোন এলাকাতে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল। ওই বাসায় যাওয়ার আগে নিচু থেকে উঁচুতেও উঠেছে গাড়ি।
আতঙ্ক কাটছে না: বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, যতদিন না পর্যন্ত অপহরণের সঙ্গে জড়িতরা সনাক্ত এবং গ্রেপ্তার হয়ে আইনের মুখোমুখি হচ্ছে ততদিন আমরা পরিবারের সবাই পুনরায় অপহরণ আতঙ্কে রয়েছি। তিনি বলেন, অপহরণকারীরা আমার পরিবারের বয়স্ক সদস্যকে অপহরণ করে নিয়েছিল। তারা গ্রেপ্তার বা সনাক্ত না হলে আমার তিন সন্তান বা আমাকেও অপহরণ করতে পারে। যে কোন মূল্যে তাদের সনাক্ত ও গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি। তিনি বলেন, অপহরণকারীরা যদি আমার কারণে ওকে অপহরণ করে থাকে, আমাকে ভয় দেখানোর জন্য তাহলে আবারও অপহরণের ভয় থেকে যায়। কারণ ওরা আমার কর্মকাণ্ড থেকে পিছপা হওয়ার জন্য হয়তো এটি করেছে। কিন্তু আমি আমার কর্মকাণ্ড থেকে কখনোই পিছপা হবো না। সেহেতু অনিরাপত্তার বিষয়টি থেকেই যায়। যদি এমন হতো যে কাল থেকে আমি আমার কর্মকাণ্ডগুলো বন্ধ করে রাখবো তাহলে নিজেদের অনিরাপদ বোধ করতাম না। তিনি বলেন, কাজের জন্য সারাদেশে আমাকে ঘুরতে হয়। আমার স্বামীকে তার কারখানায় যাতায়াত করতে হবে। এজন্য অপহরণ রহস্য উদ্ঘাটন করতে যে সমন্বয় কমিটি হয়েছে, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলবো। তিনি বলেন, আমরা এখনও বিশ্বাস হারাইনি যে অপহরণকারীরা সনাক্ত হবে না। কারণ একটা চাপের কারণেই সিদ্দিককে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এটা গণমাধ্যমের যেমন চাপ ছিল তেমনি রাষ্ট্রযন্ত্রেরও চাপ ছিল।
কারা এবং কেন?: এবি সিদ্দিকের অপহরণের ঘটনাটি পূর্বপরিকল্পিত বলে প্রথম দিন থেকে অভিযোগ করে আসছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। তবে গতকাল পর্যন্ত এই অপহরণের নেপথ্যে কারা এবং কেন তার রহস্য উন্মোচিত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বৃহস্পতিবার রাতে এবি সিদ্দিককে অপহরণকারীদের ছেড়ে দিলেও সবার মনে প্রশ্ন একটাই তাকে কারা অপহরণ করেছিল এবং কেন অপহরণ করেছিল। অপহরণের ঘটনায় পুলিশের সমন্বয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র ডিবির যুগ্ন কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, এবি সিদ্দিকের অপহরণের ঘটনাটি সুপরিকল্পিত। পুলিশের প্রথম কাজ ছিল অপহৃত ব্যক্তিকে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফেরত আনা। যে কোনভাবেই হোক তিনি ফেরত এসেছেন। এখন অপহরণকারী চক্র, অপহরণের কারণ ও ব্যবহৃত গাড়ি এবং অস্ত্র উদ্ধারে চেষ্টা চলছে। এই অপহরণের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে নিয়োজিত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, অপহরণের পর থেকে অপহৃত ব্যক্তির ফিরে আসা এবং তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় এটি অন্য অপহরণগুলোর মতো কোন সাধারণ অপহরণ নয়। প্রাথমিক তদন্তে এটি নিশ্চিত হওয়া গেছে যে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য এই অপহরণ করা হয়নি। এর পেছনে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে ভয় দেখানোর বিষয়টি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ওই কর্মকর্তা বলেন, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং তার স্বামী এবি সিদ্দিক যেসব সন্দেহের কথা বলেছেন তা পর্যালোচনা করে অনুসন্ধান করছে পুলিশ। রিজওয়ানা এবং তার স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক শত্রুতা রয়েছে এমন কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে খোঁজ-খবর নেয়া হচ্ছে। তবে এখনও উল্লেখযোগ্য কোন ক্লু হাতে পাওয়া যায়নি।
গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পুলিশ এখনও সেই নীল রঙের মাইক্রোবাসটি উদ্ধারের চেষ্টা করছে। এবং ঠিক কোথায় তাকে রাখা হয়েছিল সেটাও জানার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে খুলনায় নীল রঙের একটি হায়েস মাইক্রোবাস সনাক্ত করা হয়েছে যার মালিক ঢাকার ধানমন্ডির এক ব্যক্তির। ওই মাইক্রোবাসটি কবে কেন খুলনায় গিয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে।
তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সিএনজিচালকের জবানবন্দি
স্টাফ রিপোর্টার, নারায়ণগঞ্জ থেকে জানান, বেলা’র প্রধান নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর লিটুকে অপহরণের পর গঠিত ৫ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত দলটি ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিকের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ফতুল্লার দাপায় অবস্থিত হামিদ ফ্যাশনে যান এবং এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বিকালে তদন্ত দলটি ঢাকায় ফিরে যান। তদন্ত দলের প্রধানসহ ৪ সদস্য ঢাকার এবং একজন নারায়ণগঞ্জের। এদিকে অপহরণকারীদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার পর যে সিএনজি দিয়ে আবু বকর সেন্ট্রাল রোডের বাসায় ফিরছিলেন হাফিজুর রহমান নামে সিএনজির সেই চালক বিকালে নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে জবানবন্দি দেন। নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মনোয়ারা বেগম সিএনজিচালক হাফিজের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। জবানবন্দিতে হাফিজ বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ব্যবসায়ী আবু বকরকে নিয়ে যাওয়ার সময় যা ঘটেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন। ধানমন্ডি থানা থেকে সিএনজিচালক হাফিজকে ব্যবসায়ী আবু বকর অপহরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এবং ফতুল্লা মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ আদালতে নিয়ে আসেন। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম বলেন, ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক গত বুধবার দুপুরে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের দেলপাড়া ভুঁইয়া ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীদের হাতে অপহৃত হন। ওই দিন রাতেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শেখ মারুফ হাসানকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শনিবার দুপুর সোয়া ২টায় অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শেখ মারুফ হাসানের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা প্রথমে অপহরণের ঘটনাস্থল এবং পরে অপহৃতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হামিদ ফ্যাশনে যান এবং প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। তবে ওই দুজন কর্মকর্তা ঘটনার দিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখেননি বলে তদন্ত টিমকে জানান। নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার সৈয়দ নূরুল ইসলাম আরও বলেন, ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। তাই তারা সাবধানে তদন্ত করছেন। তাদের তদন্ত চলবে।

No comments

Powered by Blogger.