দুর্নীতি প্রতিরোধে যুবকদের ভূমিকা

যুবসমাজই দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করার ক্ষেত্রে উদ্দীপনামূলক ভূমিকা নিতে পারে। একটি সুন্দর, সুশৃঙ্খল যুবসমাজের ভাবমূর্তির ওপর সমগ্র জাতির নীতি-নৈতিকতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। দেশের সব প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্ব প্রাজ্ঞ প্রবীণদের ওপর থাকে। তাঁদের অভিজ্ঞতা, সততা, দক্ষতা এবং ন্যায়নিষ্ঠার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে তরুণ ও যুবক বয়সীরা। তরুণদের মেধা, শ্রম ও দক্ষতা প্রতিষ্ঠানের সাফল্য এনে দেয়। অল্প কিছুসংখ্যক বিপথগামী বাদে সমাজের অধিকাংশ তরুণ-যুবক বিশুদ্ধ ও আদর্শবান। তাদের একত্র করা সম্ভব হলে তাদের দিয়েই দেশে বিরাজমান দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাবে। সুনাগরিকেরা এমন একটি সামাজিক পরিবেশ চায়, যেখানে তারা সবাই মিলে পরিবার-পরিজন নিয়ে নিরাপদে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারে। যেখানে দুর্নীতি হবে, সেখানেই শান্তিপূর্ণভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানাতে হবে। পবিত্র কোরআনে সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে, ‘জলে-স্থলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে, যার ফলে আল্লাহ তাদেরকে তাদের কিছু কিছু কাজের শাস্তি আস্বাদন করাতে চান, যাতে তারা ফিরে আসে।’ (সূরা আর-রুম, আয়াত: ৪১)
দেশের জাতীয় সমস্যা দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। শুধু দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম এবং তারুণ্যের অঙ্গীকার। তরুণ ও যুবকদেরই দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতীদের প্রত্যয়, দর্শন, প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে দুর্নীতির মাত্রা এবং কারণ নিয়ে দ্বিমত থাকলেও এর প্রতিরোধের বিষয়ে কারও কোনো ভিন্নমত থাকার কথা নয়। এ ছাড়া সবাইকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অবস্থান গ্রহণের মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল দেশ গড়ার আন্দোলনে অংশ নিতে হবে। যেমনভাবে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আপামর জনসাধারণকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যেকোনো অন্যায়কারী দুর্নীতিবাজকে দমনে সে যেন হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে, যদি তা করতে না পারে তবে সে যেন মুখ দিয়ে প্রতিহত করে। যদি সে মুখ দিয়েও না পারে, তাহলে যেন অন্তর দিয়ে ঘৃণা পোষণ করে; আর এটা দুর্বল ঈমানের পরিচয়।’ (বুখারি) ‘দুর্জয় তারুণ্য দুর্নীতি রুখবেই’—তরুণদের দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক মূল্যবোধ নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে এবং পরে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তরুণদের সাহসিকতা ও সংঘবদ্ধতার মাধ্যমে দুর্নীতি রোধ করা যায়। সাহসী তরুণেরা যদি একত্র হয়, তবে তাদের দলগত শক্তি দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা যাবে।
সবাইকে বলতে হবে, ‘দুর্নীতি করব না এবং সইব না’। দুর্নীতি প্রতিরোধে মন্দকে পেছনে ফেলে ভালোকে কাছে টানার অনুভূতি সৃষ্টি করতে হবে। পাহাড় সমান দুর্নীতি দূর করার জন্য আদর্শবান ও সৎ তরুণ-যুবকদের সমাজকল্যাণমূলক কাজের নেতৃত্বে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হোক, যারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ দুর্নীতিমূলক কাজে নিষেধ করবে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪) যুবসমাজের দ্বারা জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতির শিকড় উৎপাটন করা দরকার। কারা কীভাবে দুর্নীতি করছে, সে তথ্য প্রকাশ্যে ও জনসমক্ষে তুলে ধরা উচিত। নিজেদের পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে দুর্নীতি না করার এবং প্রতিরোধেরও অঙ্গীকার করতে হবে। তরুণ যুবসমাজ এ ব্যাপারে কেবল সাহায্য-সহযোগিতা করবে। দেশের যুবসমাজ অসততা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিরোধিতা শুরু করলে দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা দুর্নীতি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। এর জন্য প্রয়োজন তরুণ ও যুবকদের সম্মিলিত ঐক্যমত ও সংঘবদ্ধতা। ধর্মীয় বিধিবিধান ও নৈতিক অনুশাসনের কথা জনসাধারণের কাছে সুন্দরভাবে তুলে ধরার মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করা সম্ভব।
দুর্নীতি প্রতিরোধে নিজের ইচ্ছাশক্তি ও আত্মশুদ্ধি প্রয়োজন। মানুষের আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিবেকবোধের মাধ্যমে সমাজে দুর্নীতিকে প্রতিরোধ করতে হবে। কেউ যদি দুর্নীতিতে আকৃষ্ট হয়েও নিজের বিবেকের তাড়নায় দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকতে পারেন, তাহলে তিনি খাঁটি ধর্মপ্রাণ লোক। প্রতিরোধের মাধ্যমেই দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। দুর্নীতি দমনের জন্য সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। ‘সমৃদ্ধ দেশ আলোকিত মন, হয়ে উঠি সচেতন একজন’—এমন বাস্তবধর্মী স্লোগান সামনে রেখে তরুণ-যুবকদের সেই সুশীল সমাজ বিনির্মাণের জন্য কাজ করতে হবে, যেখানে কোনো অন্যায়-অপরাধ, প্রতারণা, অবিচার থাকবে না। আত্মশক্তি বিকাশের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্ম তথা যুবসমাজ রুখে দাঁড়ালে দেশ দুর্নীতিমুক্ত হতে বাধ্য। এ জন্য ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতিবিষয়ক সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ও বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয় প্রভৃতি স্থান থেকে সদুপদেশ ও ধর্মীয় বিধিবিধানের আলোকে তৃণমূল পর্যায় থেকে দুর্নীতি দমনের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা তৈরি করে সামাজিক আন্দোলন ও জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে আন্তধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ততা ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাই আসুন, দুর্নীতিকে ‘না’ বলার প্রত্যয়দীপ্ত অঙ্গীকার সামনে রেখে সর্বাত্মক নৈতিকতা চর্চার সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলি।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.