‘আরও সাহসী’ গণমাধ্যম চাই? by মশিউল আলম

গত মঙ্গলবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে গণমাধ্যমের অক্সিজেন। দেশে গণতন্ত্র থাকলে গণমাধ্যম আরও সাহসী হবে।

তথ্যমন্ত্রীর এই অভিমত সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত পেশাজীবীদের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ‘গণমাধ্যম’ বলতে আমরা সাধারণভাবে সংবাদমাধ্যম বুঝি; তথ্যমন্ত্রী আমাদের প্রাণধারণের প্রাথমিক উপাদান অক্সিজেনের কথা বলেছেন। আমাদের জন্য সেই অক্সিজেন হচ্ছে গণতন্ত্র। তাঁর কথা অনুযায়ী, দেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে তাহলে অক্সিজেনের অভাবে আমরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাব। কিন্তু ইতিহাস বলে, দেশে যখন গণতন্ত্রের নামগন্ধ ছিল না, সংবাদমাধ্যম তখনো ছিল। এমনকি ভারত উপমহাদেশ যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের জাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট ছিল, তখনো সংবাদমাধ্যম ছিল। ছিল পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের জবরদস্ত শাসনামলেও। আর ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত এ দেশীয় সামরিক স্বৈরশাসকদের আমলের সংবাদমাধ্যমের প্রাণস্পন্দনের স্মৃতি তো একদম জ্বলজ্বলে।
অর্থাৎ গণতন্ত্র না থাকলে সংবাদমাধ্যম থাকবে না কিংবা মারা পড়বে—এ রকম আশঙ্কা অমূলক। তবে এ কথা সত্য যে গণতন্ত্র না থাকলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ব্যাপকভাবে খর্ব হয়। তখন সংবাদমাধ্যমের টিকে থাকা নির্ভর করে কিছুটা নিজেদের কৌশল ও সাহসের ওপর, বাকিটা অগণতান্ত্রিক শাসকদের মর্জির ওপর। গণতন্ত্র থাকলে সংবাদমাধ্যমের কাজে অবশ্যই সুবিধা হয়। গণতন্ত্রের জোরে সংবাদমাধ্যম আরও স্বাধীনতা, আরও সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটা বেশ বোঝা যায় যে তিনি গণতন্ত্রকে বিশেষ মূল্যবান মনে করেন এবং মনে করেন যে দেশে গণতন্ত্র থাকা জরুরি।
কিন্তু দেশে গণতন্ত্রের অটুট থাকা নিশ্চিত করবে কে? কার দায়িত্ব এটা? সংবাদমাধ্যমের? গণতন্ত্রের প্রতি সংবাদমাধ্যমের অঙ্গীকারের কোনো ঘাটতি নেই। বরং পেশাদারি সংবাদমাধ্যম সব সময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে রয়েছে। যখনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়, যখনই গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তখনই সংবাদমাধ্যম সবার আগে দাঁড়িয়ে পড়ে গণতন্ত্রকে রক্ষা করার পক্ষে। তাই সব কালে স্বৈরশাসকদের প্রধান শত্রু হিসেবে পরিগণিত হয় স্বাধীন সংবাদমাধ্যম। প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্যমন্ত্রী কী কারণে গণতন্ত্রের প্রতি সংবাদমাধ্যমকে প্রলুব্ধ করার কিংবা গণতন্ত্রহীনতার ব্যাপারে সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করলেন? তিনি কি গণতন্ত্রের সামনে কোনো বিপদ দেখতে পাচ্ছেন?
গণতন্ত্র বলতে যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার পরিচালনা বোঝায়, তাহলে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে গণতন্ত্রের জন্য কোনো বিপদ দেখা যাচ্ছে না। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই দেশ পরিচালনা করছেন। অবশ্য যদি কেউ প্রশ্ন তোলে, কী গুণগত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত সরকার দেশ চালাচ্ছে, তাহলে এই গণতন্ত্রের সারবত্তা নিয়ে আপত্তি উঠবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দেশের সব পূর্ণবয়স্ক নাগরিকের মতের প্রতিফলন ঘটেনি। সেটা ঘটার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি; কারণ জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টিতেই কোনো ভোট গ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন ওই সব আসনের প্রার্থীরা। ওই নির্বাচনী এলাকাগুলোর ভোটাররা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করাই সুযোগ পাননি। তাঁদের সংখ্যা দেশের মোট নিবন্ধিত ভোটারসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। প্রধান বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জনের ফলে বস্তুত একপক্ষীয়ভাবে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয়েছে, জনগণ তাকে মেনে নিয়েছে নিরুপায় হয়ে। চলমান ব্যবস্থা সম্পর্কে দেশের প্রধান বিরোধী দলের বক্তব্য যদি আমলে নেওয়া হয়, তাহলে এই গণতন্ত্রকে একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের নামান্তর বলে মনে হবে। আর সংবাদমাধ্যমের সাহসিকতার নিরিখে যদি গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য পরিমাপ করা হয়, তাহলেও চলমান গণতন্ত্রকে যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান বলা যাবে না। কারণ, সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একধরনের আত্মনিবারণের (সেলফসেন্সর) পরিবেশ বিরাজ করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করে ন্যূনতম শাস্তির বিধান অত্যন্ত কঠোর করার পর ইন্টারনেটভিত্তিক সংবাদমাধ্যমেও অস্বস্তি, একটা চাপা শঙ্কার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে বিরুদ্ধ মত ও সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণুতা বেড়েছে বলে সংবাদমাধ্যমের ধারণা।
গণতন্ত্র থাকলে সংবাদমাধ্যম ‘আরও সাহসী’ হবে—তথ্যমন্ত্রীর এমন মন্তব্যের অর্থ এ রকমও হতে পারে যে তাঁর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখন যথেষ্ট সাহসী নয়; কিংবা সংবাদমাধ্যমের আরও সাহসী হওয়ার সুযোগ আছে। জনসাধারণেরও একটা বড় অংশ মনে করে, পর্যাপ্ত সাহসের অভাবে সংবাদপ্রতিষ্ঠানগুলো সব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথেষ্ট লেখালেখি করে না। আমাদের তথ্যমন্ত্রী যদি আন্তরিকভাবেই মনে করেন যে সংবাদমাধ্যমের আরও সাহসী ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে এবং সেটা করা দরকার, তবে তা সংবাদমাধ্যমের জন্য অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক ব্যাপার। সংবাদমাধ্যমকে আরও সাহসী হতে উৎসাহিত করছেন—এমন তথ্যমন্ত্রীর দেখা আমরা খুবই কম পেয়েছি।
কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে এমন উৎসাহ প্রদানের আগে রাষ্ট্র ও সরকারের পরিচালকদের পরিষ্কার করতে হবে ‘আরও সাহসী’ সংবাদমাধ্যমের প্রবল ভূমিকা তাঁরা কীভাবে গ্রহণ করবেন। ক্ষমতার বিভিন্ন অংশ থেকে মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা হয়; কোনো কোনো সংবাদপ্রতিষ্ঠান সরকারের রোষানলে পড়ে। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতায় ঘাটতির বিষয়টি সাধারণভাবে মেনে নিয়েও বলা যায়, বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো একটি বা দুটি সংবাদপ্রতিষ্ঠান বা সাংবাদিক পেশাগত নৈতিকতার ব্যত্যয় ঘটালে তার আইনি প্রতিকারের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সেদিকে না গিয়ে বাঁকা পথে হয়রানি করার ঝোঁক লক্ষ করা যায়। দেশে একটি প্রেস কাউন্সিল আছে; কিন্তু সেখানে কেউ যেতে চান না; বরং সোজা আদালতের দিকে দৌড়ান। সরাসরি আদালতে গিয়ে মামলা করা অবশ্যই যায়; কিন্তু তা করার আগে প্রেস কাউন্সিলে প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এই ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহীদের সংখ্যা অত্যন্ত বিরল। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর সাংবাদিকদের ওপর ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালীদের শারীরিক আক্রমণ চলে। সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য কোনো আইন নেই। দেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো চলে সরকারের নির্বাহী আদেশের বলে। তাদের কেউ কোনো কারণে সরকারের বিরাগভাজন হলে সম্প্রচার বন্ধ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা তাদের মাথার ওপর ঝুলে থাকে সব সময়। দু-একটি উদাহরণ ইতিমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রচারমাধ্যমের জন্য একটি আইন প্রয়োজন, যার বলে কথায় কথায় কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ করা যাবে না। কিন্তু জোর গলায় এ রকম দাবি তুলতেও সম্প্রচারমাধ্যমের কর্মী-ব্যবস্থাপকেরা কুণ্ঠিত বলে মনে হয়।
গণতন্ত্র সংবাদমাধ্যমের অক্সিজেন—তথ্যমন্ত্রীর এই অভিমত আমরা সদর্থক বলেই মনে করি। বিপরীতক্রমে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমও গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি বাড়ায়। বস্তুত, কোন দেশে কতটা গণতন্ত্র আছে, তা পরিমাপ করতে গিয়ে দেখা হয় সেই দেশের সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীন। আমরা সব সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের গর্বের সঙ্গে বলতে শুনি, দেশে সংবাদমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তো একবার এমন কথাও বলেছিলেন যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বেশি হয়ে গেছে। সেটা কমানোর জন্য প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করে আরও কঠোর করার কথাও উঠেছিল। সেদিক থেকে বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর কণ্ঠে সংবাদমাধ্যমের আরও সাহসী ভূমিকার ওপর গুরুত্বারোপ নিঃসন্দেহে উৎসাহব্যঞ্জক।
তবে দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও মানসিকতার অভাব থাকলে তার কিছু না কিছু প্রভাব সংবাদমাধ্যমের ওপরেও পড়তে বাধ্য। আর গণতন্ত্রের বিপন্নতা শুধু অরাজনৈতিক কিংবা সংবিধানবহির্ভূত ক্ষেত্র থেকেই আসে না, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাবেও সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা দুরূহ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে জরুরি কথা, গণতন্ত্র একান্তভাবেই একটি বহুপক্ষীয় ব্যাপার। যে দেশের গণতন্ত্র যত বেশি বহুপক্ষীয় ও উদার, সে দেশের সংবাদমাধ্যমও তত বেশি স্বাধীন, সাহসী ও বৈচিত্র্যপূর্ণ।

মশিউল আলম: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.