যে পথে আমেরিকা সে পথেই রাশিয়া! by কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

পুতিন সর্বশেষ পেরেকটি বসিয়েছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এর খবর অনুযায়ী ক্রিমিয়া দখলের সব আয়োজনই সমাপ্তির পথে। প্রেসিডেন্ট পুতিন ডিক্রি জারি করেছেন। ক্রিমিয়ার জনগণের স্বাধীনতার পক্ষের রায়কে পুতিন রাশিয়ার রাষ্ট্র দখলের লক্ষ্যে ব্যবহার করেছেন। রাশিয়ার পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে ক্রিমিয়ার জনগণের শেষ ট্র্যাজেডি স্পষ্ট।
শুক্রবার ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করার আইনে পুতিন স্বাক্ষর করেছেন। আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারক সোভিয়েত রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের পর রাশিয়ায় পরিণত হয়ে এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের ধারকে পরিণত হয়েছে। প্রায় ৫৯ শতাংশ রুশদের রক্ষায় প্রায় ৪১ শতাংশ তাতার ও ইউক্রেনিয়ানদের স্বাধীনতাকে বিসর্জন। আমেরিকা মিত্রদের নিয়ে স্বৈরশাসক ও উগ্রবাদীদের উৎখাতের লক্ষ্যে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার (ক্ষুদ্র রাষ্ট্র) সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে। অন্যদিকে রাশিয়া স্বভাষীদের রক্ষায় শত্রু-মিত্রের তোয়াক্কা করেনি। নিজেই শক্তির পরীক্ষা দিয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধের পরে যৌথ নিরাপত্তার উপায়গুলো (জাতিসংঘ) চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফলে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোও তার প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্র ও পরাশক্তির ছোবলের আশঙ্কা করছে।
স্নায়ুযুদ্ধের পরে ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে কম বাক্যবিনিময় হয়নি। অনেকে তো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে সুপরা ন্যাশনালিজম হিসেবে স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী ক্ষমতার ভারসাম্যের নতুন কৌশল হিসেবে কল্পনা করেছে। কিন্তু নানা কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মার্কিন মিত্রই থেকেছে, ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরিতে মার্কিন ইচ্ছার বাইরে অবস্থান নিতে পারেনি। স্নায়ুযুদ্ধের পরে অল্প পরিসরে হলেও বর্তমানে রাশিয়াই আমেরিকার সঙ্গে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার লড়াই করছে। এই লড়াই এত দিন ছিল মার্কিন ইচ্ছার বিরোধিতা করা; আর এখন তা রাশিয়ার স্বার্থ রক্ষায় এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়েছে। দুজনের স্বার্থ দুই রকম; কিন্তু লক্ষ্য এক—সব আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে হলেও নিজের স্বার্থ রক্ষা করা।
স্নায়ুযুদ্ধের অল্প কয়েক দিন পর ক্রিস্টোফার লেইন লিখেছেন, এককেন্দ্রিক বিশ্বের অলীকতা। এত দিন এটা এতটা প্রচ্ছন্ন না হলেও এখন তা বাস্তব। রাশিয়াই আবার যুক্তরাষ্ট্রের দরজায় কড়া নাড়ছে। বলছে—আমেরিকানরাই নয়; রুশরাও আছে। মার্কিনের ক্ষুদ্র মিত্ররা এত দিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয়ে নিজেকে নিরাপদ ভাবত। এখন সে নিরাপত্তা কোথাও কোথাও উবে গেছে। আমেরিকার সর্ববৃহৎ মিত্র শক্তি (ন্যাটো জোট হিসেবে) খোদ ইউরোপেই রাশিয়া তার নতুন অবস্থানের জানান দিচ্ছে এবং আমেরিকার ক্ষুদ্র-বৃহৎ মিত্রদের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ করছে। সুতরাং, ওবামা তাঁর এককেন্দ্রিক বিশ্বের নেতৃত্ব কীভাবে রক্ষা করবেন?
ডেভিড সেনজার ১৬ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমস-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ লিখেছেন। সেনজার লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুরা ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য পরীক্ষা করছে। সিরিয়া সরকার গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে। উত্তর কোরিয়া ও ইরান তাদের সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হয়নি। উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অনেকেই মার্কিন কূটনীতিকে আমলে নিচ্ছে না। ভেনেজুয়েলাকেও যুক্তরাষ্ট্র তার ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। মিসরে যুক্তরাষ্ট্র মিসরীয় সেনাবাহিনীর জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলার সাহায্য হ্রাস করেছে। তাতেও মিসরের সামরিক জান্তা লক্ষ্য থেকে পিছপা হয়নি। এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তেই যুক্তরাষ্ট্র চ্যালেঞ্জের মুখে। যুক্তরাষ্ট্র এখন যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
ওবামা ক্ষমতায় এসে নতুন কৌশল গ্রহণ করেছেন। এটাকে ‘ননকমব্যাটেন্ট কমান্ড’ বলে। এই কৌশলের অধীনে ওবামা প্রশাসন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ ও সাইবার আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারীকে নিঃসঙ্গ করে শাস্তি প্রদান করে। এই কারণে, লিবিয়া যুদ্ধেও ওবামার নীতি ছিল পেছন থেকে নেতৃত্ব দেওয়া। তাই লিবিয়া যুদ্ধে আরব ও ইউরোপীয় শক্তিকে সামনে নিয়ে আসা হয়। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষক পৃথিবীব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রবিরোধীদের ঔদ্ধত্যের পেছনে এই নীতিকে দায়ী করেন। তা ছাড়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সামরিক বাজেট এখন সবচেয়ে কম। অন্যদিকে চীন ১২ শতাংশ সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। তাই অনেকের মনে হতে পারে ক্রিস্টফার লেইন ঠিক বলেছেন, ‘এককেন্দ্রিক বিশ্ব এখন অলীকতা মাত্র।’
ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার ছোবল নতুন নয়। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে পৃথিবীর অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তথা গ্রিক, রোমান, বাইজান্টাইন, মঙ্গল, অটোমান ও রাশিয়ানরা এই উপদ্বীপটিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ক্রিমিয়ান যুদ্ধ বর্তমান সংকটকে ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ক্রিমিয়ান ক্রিশ্চিয়ানদের রক্ষার জন্য রাশিয়ান সম্রাট অটোমানদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং এই যুদ্ধে রাশিয়ান সম্রাট জয়লাভ করেন। এর পর থেকেই ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯২০ সালের শেষের দিকে রাশিয়ান গৃহযুদ্ধের সময় প্রায় ৫০ হাজার সাদা যুদ্ধবন্দীর মৃত্যুদণ্ড প্রকাশ্যে গুলি করে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখানকার তাতারদের নির্বাসন দেওয়া হয়। অভিযোগ করা হয় যে তাতারদের ৪৬ শতাংশ ক্ষুধা ও রোগে মারা যায়। একই বছর আর্মেনীয়, বুলগেরীয় ও গ্রিকদেরও মধ্য এশিয়ায় নির্বাসন দেওয়া হয়। স্নায়ুযুদ্ধের পর ক্রিমিয়াকে একটি ব্যতিক্রম স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হয়; যার পার্লামেন্ট ও সংবিধান আছে।
১৯৯৭ সালে এক আন্তর্জাতিক চুক্তির ফলে ক্রিমিয়াকেন্দ্রিক উত্তেজনা হ্রাস পেলেও ২০০৮ সাল থেকে ক্রিমিয়ার রুশ জনগণকে রাশিয়া পাসপোর্ট দিতে থাকলে অস্থিরতা আবার তৈরি হয়। ২০০৯ সালে ইউক্রেনবিরোধী বিরাট বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং এই সময়ে রাশিয়াপন্থী ক্রিমিয়া পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পিকার রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার ব্যাপারে আবখাজিয়া ও সাউথ ওশেতিয়ার মতো আচরণ করতে অনুরোধ করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রাশিয়াপন্থী ও ইউক্রেনপন্থী বিক্ষোভকারীদের মধ্যে মারাত্মক সংঘাত হয়। এরই সূত্র ধরে একপর্যায়ে রুশ নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার ক্রিমিয়ায় প্রবেশ।
শুরু হয় নতুন ইতিহাস। উগ্র জাতীয়তাবাদের নতুন কলঙ্ক। প্রতিবেশী দেশের সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার মধ্যে একটি সার্বভৌম দেশের একটি অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীকে রক্ষায় ৫৯ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী পার্লামেন্ট প্রতিবেশী দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং চূড়ান্তভাবে গণভোটেও সেই অভিপ্রায়ই প্রতিফলিত হয়। ৫৯ শতাংশ উগ্র জাতীয়তাবাদী রুশদের অধীনে চলে যায় বাকি ৪১ শতাংশ তাতার মুসলিম, ইউক্রেনিয়ান ও অন্যরা। একটি আন্তর্জাতিক আইনের পরস্পরবিরোধী দুটি অংশের একটি অংশের দোহাই দিয়ে তথা গণভোটের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়ে স্বজাতিকে রক্ষায় ‘অন্য দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন’ (আইনটির দ্বিতীয় অংশ) একটি নতুন মডেল। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে গণভোটের রায় রাশিয়াসহ আন্তর্জাতিক মহল দীর্ঘদিন যাবৎ উপেক্ষা করছে, অথচ এই রাশিয়াই একই আইনের দোহাই দিয়ে ক্রিমিয়া দখল করল।
তালুকদার মনিরুজ্জামানের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তা-বিষয়ক গবেষণাকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তিনি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার নানা কৌশলের কথা বলেছেন। তিনি তাঁর দ্য সিকিউরিটি অব স্মল স্টেট ইন দ্য থার্ড ওয়ার্ল্ড গ্রন্থে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের মতো কৌশলের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি যৌথ নিরাপত্তাকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের নিরাপত্তার চাবিকাঠি বলেছেন। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মডেল হলেও ভেটোর কারণে এটি কাজ করছে না।
স্নায়ুযুদ্ধের পর জাতিসংঘ টিকে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় মার্কিন মিত্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো নিরাপত্তা বোধ করেছে। অনেক সময় ক্ষমতার ভারসাম্যের বিভিন্ন জোটেও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলো বৃহৎ প্রতিবেশীর দ্বারাই আক্রান্ত হচ্ছে। এ ঘটনাই ঘটেছে ক্রিমিয়ায়। রাশিয়া তার প্রতিবেশী ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ন্যাটোসহ যুক্তরাষ্ট্র সেই চ্যালেঞ্জকে নিয়ন্ত্রণ করতে হাঁকডাকও দিতে পারছে না।

কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান: শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
kazipoliticalscience@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.