ভারতের নির্বাচন- পত্রিকার ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ by এ কে এম জাকারিয়া

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের সামনে তাদের ইশতেহার তুলে ধরে। এতে দলের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন থাকলেও মূল দিকটি হচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে দলটি দেশ ও জনগণের জন্য কী কী করবে, কোন কোন ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেবে, সেসব বিষয় ও প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়। ভারতের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবার একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ আমরা লক্ষ করলাম। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াও ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ দিয়েছে; ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া মেনিফেস্টো: এন এজেন্ডা ফর দ্য নিউ গভর্নমেন্ট’।

রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহার প্রকাশের অর্থ ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ইশতেহারটি জনগণের সামনে তুলে ধরে ভোট চাওয়া, ভোটারদের মন জয় করে ক্ষমতায় যাওয়া। একটি পত্রিকার নির্বাচনী ইশতেহারের বিষয়টি তবে কী? তাদের চাওয়া বা উদ্দেশ্যটিই কী? রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারের সঙ্গে একটি পত্রিকার ইশতেহারের পার্থক্য থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা দেখলাম, প্রথাগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে নিজেদের করণীয় ও প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে, সেখানে টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের ইশতেহারে তুলে ধরতে চেয়েছে নতুন সরকারের কাছে যে ইস্যু ও দিকগুলো গুরুত্ব পাওয়া উচিত, সেই দিকগুলো। এর সঙ্গে দেশ ও জনগণের চাওয়া-পাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। পত্রিকাগুলো নিজেদের লেখালেখি বা সম্পাদকীয়র মাধ্যমে এ কাজ বরাবরই করে থাকে। কিন্তু টাইমস অব ইন্ডিয়া এই কাজটি করেছে নির্বাচন সামনে রেখে খুবই সংগঠিত এবং আনুষ্ঠানিকভাবে। পরে কয়েক দিন ধরে বিশিষ্টজনেরা যে এ সম্পর্কে নানা মত দিয়েছেন, সেগুলোও পত্রিকাটি প্রকাশ করেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার নির্বাচনী ইশতেহারের শুরুতে সম্পাদকের একটি নোট রয়েছে। সেখানে ভারতে বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অবস্থা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ সাফল্য অর্জন করতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে। ‘বছর পাঁচেক আগে ভারতজুড়ে আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছিলাম যে দেশটি প্রায় নিশ্চিতভাবে একটি “সুপার পাওয়ার” হওয়ার পথে এগোচ্ছে। চীন ও ভারতের নাম তখন এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো। সেই আশা পরিষ্কারভাবেই ব্যর্থ হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ১০ থেকে কমে ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি মহামারি আকার ধারণ করেছে, যা দেশের আত্মাকে কুরে খাচ্ছে। ফলে এটা বলা যায় যে পরবর্তী সরকারের সবচেয়ে জরুরি বিবেচনার বিষয় হচ্ছে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং তা দুই অঙ্কের যতটা সম্ভব কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। কিন্তু একমাত্র এটাই কি ভারতকে আবার সুপার পাওয়ারে পরিণত করার প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতে পারবে? যে দেশ তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারে না, যেখানে লাখ লাখ লোক প্রতিদিন পেট পুরে খেতে পারে না, সেই দেশটি নিজেদের “উন্নত” বলে দাবি করতে পারে না। আমাদের আর্থসামাজিক অগ্রগতির সূচক হতাশাজনক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও পিছিয়ে। আমরা খেলাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে আগ্রহী নয় (ক্রিকেট ছাড়া) কিন্তু অলিম্পিকে আমাদের লজ্জাজনক রেকর্ড আমাদের গভীর হতাশার দিকটিকেই তুলে ধরে।’
এত কিছু বলার পর সম্পাদক জানিয়েছেন, টাইমস অব ইন্ডিয়া যে ইশতেহারটি তৈরি করেছে, সেটি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করুক এবং প্রয়োজনে দলগুলো তাদের ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করুক, সেটাই তাদের চাওয়া। তিনি তাঁর নোটটি শেষ করেছেন এভাবে; ‘বিষয়টি এমন নয় যে আমরাই একমাত্র জ্ঞানের আধার। এমন অনেক ভারতীয় রয়েছেন যাঁরা ন্যায়নিষ্ঠ, যাঁদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোনো নীতিনির্ধারণ বা আইন তৈরি করার আগে যাঁদের কথা শোনা উচিত। কিন্তু আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব যদি আমাদের ইশতেহার একটি গভীর আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে। যেখানে স্থান পাবে জাতীয় স্বার্থ, যেখানে সংকীর্ণ বা দলীয় বিবেচনা প্রাধান্য পাবে না।’ এই সম্পাদকীয় বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা পত্রিকাটির ইশতেহার প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি ধারণা পেলাম।
ইশতেহারটি দীর্ঘ। ইশতেহারের নিচে টাইমস অব ইন্ডিয়ার নয়জন সাংবাদিকের নাম রয়েছে, যাঁরা এটি রচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতামত, পরামর্শ বা তথ্য-উপাত্ত জুগিয়েছেন। একটি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচনী ইশতেহার যেমন হয় তেমনি। বিভিন্ন খাত ধরে আলোচনা, করণীয় দিক ও পরামর্শ রয়েছে। ইশতেহার শুরুর খাতটি হচ্ছে অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্পোদ্যোগ। এরপর ধারাবাহিকভাবে রয়েছে আইন সংস্কার, বিচারব্যবস্থার সংস্কার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসনিক সংস্কার, কৃষি, জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি, নারী, বিদ্যুৎ, নগর উন্নয়ন, খেলাধুলা, পরিবেশ ও প্রতিবন্ধী নাগরিক প্রসঙ্গ। এ খাতগুলোকে বিভিন্ন উপখাতে ভাগ করে ব্যাখ্যা ও করণীয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এর কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ভারতে অনেক বিশিষ্ট নাগরিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদসহ পেশাজীবীরা একে স্বাগত জানিয়েছেন। টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে এসব প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হচ্ছে। নির্বাচন সামনে রেখে পত্রিকাটি সামনের সপ্তাহগুলোতে ‘মাই মেনিফেস্টো’ নামে বিশিষ্টজনের চিন্তাভাবনা তুলে ধরার ঘোষণা দিয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়া খেটেখুটে দেশের যে খাতগুলোতে মনোযোগ দেওয়া দরকার, তা তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছে, এই বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মনোযোগ চেয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো এতে সাড়া দেবে কি না, সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলো টাইমস অব ইন্ডিয়ার এ ধরনের একটি ইশতেহার প্রকাশের উদ্দেশ্য বা এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদক ইশতেহারের ভূমিকা বক্তব্যে ভারতের বর্তমান আর্থসামাজিক দশার যে পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন, যে সমালোচনা করেছেন, তার দায়টি অনেকটাই দৃশ্যত ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোটের ওপর গিয়ে পড়ে। এ ধরনের একটি মেনিফেস্টো প্রকাশ এবং গত পাঁচ বছরের অর্থনৈতিক দুর্দশা বা ‘দুর্নীতির মহামারি’ প্রসঙ্গ তুললেও কংগ্রেস বা দলটির নেতারা কিন্তু পত্রিকাটির বিরুদ্ধে হামলে পড়েনি। পত্রিকাটিকে ‘বিজেপির সমর্থক’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেনি। এ ধরনের একটি ইশতেহার প্রকাশের পেছনে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে যায়নি। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে যে যে যার যার কাজ করে যায়, পত্রিকাগুলো তাদের কাজ করে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো টাইমস অব ইন্ডিয়ার চাওয়া অনুযায়ী এ ইশতেহার থেকে সরাসরি কিছু গ্রহণ করতেও পারে, আবার না-ও করতে পারে। কিন্তু যে বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো নিশ্চয়ই আলোচনায় এবং নানা পর্যায় থেকে নানা মতামত আসবে। অনেক কিছু বাস্তবায়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে জনমত ও চাপ তৈরি হবে। রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো এসব থেকে নানা কিছু গ্রহণও করবে। এভাবেই পরিবর্তন আসে, দেশ এগোয়, গণতন্ত্র জোরদার হয়।
আমাদের দেশে এই প্রক্রিয়া লক্ষ করা যায় না। সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন, এমন কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেশ, রাজনীতি, কোনো ধরনের পরিবর্তন বা সংস্কার নিয়ে কথা বললে রাজনীতিবিদেরা তা সহজভাবে নেন না; বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। চরিত্রহননের চেষ্টা করেন। গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য এই পরিস্থিতি শুধু হতাশার নয়, বিপজ্জনকও বটে। রাজনৈতিক মহল থেকে এ ধরনের অসহিষ্ণুতার কারণে সমাজে স্বাধীন মত দেওয়া, চিন্তা জাগানো কোনো ধারণা দেওয়া বা নতুন কিছু করার পরিবেশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আর যা-ই হোক, গণতন্ত্র সামনের পথে হাঁটতে পারে না, আর আমাদের যে উন্নয়ন-আকাঙ্ক্ষা, সেটাও কার্যকরী ফল দিতে পারবে না।
টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি পত্রিকা হয়ে নির্বাচন সামনে রেখে যে ইশতেহার দিয়েছে, সেটা তারা তাদের দায়িত্ববোধ থেকে দিয়েছে, তাতে ভারতের জনগণের উন্নয়ন-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ পেয়েছে। কোন পথে সেটা আসবে, তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। রাজনীতির বাইরে আমাদের সমাজেও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নানা কিছু করছে এবং করে যাচ্ছে একই উন্নয়ন-আকাঙ্ক্ষা থেকে। আমাদের রাজনীতিবিদেরা যদি এসবের মধ্যে ‘উদ্দেশ্য’ আর ‘ষড়যন্ত্র’ না খুঁজে এ ধরনের উন্নয়ন-আকাঙ্ক্ষাগুলোকে বিবেচনায় নিতে শুরু করেন, তবে সামনে এগোনোর পথ খুঁজে পাওয়া সহজ হবে।

এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.