নিরাপত্তাহীনতা ও ঘুষ সাংবাদিকতা

পাকিস্তানের গণমাধ্যমের প্রসঙ্গ এলে ডন, জং ও পিটিভি—এ নামগুলো আসে। অন্তত ২০০২ সাল পর্যন্ত তাই-ই ছিল। কোনো রাজনীতিবিদ বা গণতান্ত্রিক নেতা নন, চার তারকা জেনারেল ফৌজি শাসক পারভেজ মোশাররফ সম্প্রচার আইন উদার করলেন। শুরু হলো মিডিয়া বুম—গণমাধ্যমের নবজাগরণ। মোশাররফ যে নিয়ন্ত্রণ তুলে নিলেন, এর জন্য তাঁকে মহানুভব ভাবার কোনো কারণ নেই। পেছনে ছিল দুটো ঘটনা:১৯৯৯ সালে ভারতের সঙ্গে সৃষ্ট কার্গিল যুদ্ধ। ওই বছরই তালেবান জঙ্গিদের ভারতীয় বিমান ছিনতাই। দুটি ক্ষেত্রেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মনে করে, অন্তত প্রচার-যুদ্ধে তারা ভারতের কাছে হেরে গেছে। ভারত যেভাবে ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে, পাকিস্তান তার মোক্ষম জবাব দিতে পারেনি। কারণ তার দেশে কোনো শক্তিশালী নিউজ চ্যানেল নেই। এ অবস্থায় দেশে দরকার আধুনিক ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম, যারা দেশের স্বার্থে ভারতের বিরুদ্ধে প্রচার-যুদ্ধে নামতে পারবে। সেই শুরু।
বর্তমানে দেশটিতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা শয়ের কাছাকাছি। প্রাইভেট রেডিও অগুনতি। বড় শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম—সবখানে মিডিয়ার সরব উপস্থিতি। সাধারণ মানুষের মধ্যে উর্দুভাষী দৈনিকগুলো জনপ্রিয়। বেশির ভাগ উর্দু দৈনিকই ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে রক্ষণশীল। সে তুলনায় শহুরে এলিটদের পছন্দের ইংরেজি দৈনিকগুলো যথেষ্ট উদার ও পেশাদার। প্রয়াত মীর খলিলুর রেহমান ৬০ বছর আগে জং গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় জিয়ো টিভি ও জিয়ো নিউজ এ গ্রুপেরই টেলিভিশন। পাকিস্তানের শীর্ষ সাংবাদিকেরা রয়েছেন এ গ্রুপের সঙ্গে। এর পরেই আছে ডন নিউজ টিভি, ডেইলি ডন-এর মালিকানাও তাদের। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রতিষ্ঠিত ডন পত্রিকা কর্তৃপক্ষের দাবি, মাসে তাদের পেজ ভিউ এক কোটির ওপরে। পাকিস্তানে সংবাদপত্রের পাঠক দিন দিন বাড়ছে। দৈনিক বিক্রি ৬১ লাখ কপির কাছাকাছি।
২. কিন্তু হলে কী হবে। সে দেশে সাংবাদিকদের বিপদের শেষ নেই। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা পাকিস্তান। রিপোর্টারদের অপহরণ, নির্যাতন ও পিটিয়ে হত্যা সেখানে নিয়মিত ঘটনা। পাকিস্তানে সাংবাদিকদের সেনাবাহিনী, সামরিক গোয়েন্দা, তালেবান জঙ্গিদের মন বুঝে চলতে হয়। গত তিন বছরে অনুসন্ধানী প্রতিবেদক সৈয়দ সালিম শেহজাদসহ দুই ডজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। সালিম শেহজাদ প্রভাবশালী সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি উন্মোচনের চেষ্টা করতেন। ধারণা করা হয়, তাঁর হত্যার পেছনে আইএসআইয়ের হাত রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তানসহ উপজাতীয় অঞ্চলগুলোতে আদিবাসী সাংবাদিকদের সত্যিকারের হিরো মনে করা হয়। আল-কায়েদা নেতা, গোত্রপ্রধান, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, সশস্ত্র জঙ্গি—সবখানে তাঁরা সোর্স রাখেন। এই আদিবাসী রিপোর্টাররা ঠিকভাবে কাজ না করলে বিশ্বের কোনো গণমাধ্যম, তা সে যত প্রভাবশালী হোক না কেন, এ অঞ্চলের কোনো খবরই পেত না। কারণ মূল ধারার গণমাধ্যম ও বিদেশি সাংবাদিকেরা কেউই সেসব জায়গায় একাকী যাওয়ার সাহস পান না। মুকাররম খান আতিফের কথা আমরা কেউ ভুলতে পারি না।
২০১২ সালে পেশোয়ারের শাবকাদার শহরে নিজ বাড়ির কাছে একটি মসজিদের সামনে তালেবান জঙ্গিরা হত্যা করেছিল ভয়েস অব আমেরিকার পশতুভাষী রেডিওর এই রিপোর্টারকে। লাশের পাশে ছিল রক্তমাখা একটি চিরকুট। তাতে লেখা: বাড়াবাড়ি করার পরিণতি এ রকমই হয়। ভদ্রলোকের নাম ইমতিয়াজ আলম, সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের (সাফমা) সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিদিন সকালে সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর সময় গালে চুমু খেয়ে মনে মনে বলি, আহা! আবার এই মুখখানা দেখতে পাব তো!’ ২০০৯ সালের এক সকালে ইমতিয়াজের মুঠোফোনটি বেজে ওঠে। ওপাশ থেকে ভেসে আসে একটি কণ্ঠ, ‘আমরা জানি, আপনার মেয়ে এই পথ ধরে স্কুলে যাচ্ছে। সাবধান।’ ওই হুমকির পর থেকে তিনি মেয়েকে স্কুলে পাঠান দেহরক্ষীসহ। করাচিতে সাফমার অফিসটা যেন একটি বাঙ্কার। ইমতিয়াজ নিজে গাড়িতে অস্ত্র রাখেন। বাসা ও অফিস দুই জায়গাতেই তাঁকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
৩. পাকিস্তানে সাংবাদিকেরা তথ্য পাওয়ার অধিকার যথেষ্ট ভোগ করেন। তার পরও অনেক সময় কারও কারও বিরুদ্ধে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’কে বড় করে দেখার অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর ইংরেজি দ্য নেশন পত্রিকার প্রথম পাতায় একটি প্রতিবেদনে বলা হলো, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর প্রতিনিধি ম্যাথিও রোজেনবার্গ প্রকৃতপক্ষে সিআইএ ও মোসাদের চর। রিপোর্টে তথ্য-প্রমাণের কোনো বালাই ছিল না। কেবলই অজ্ঞাত সূত্র! তত্ক্ষণাত্ দেশ ছাড়তে হয় রোজেনবার্গকে। পরে এ বিষয়ে পশ্চিমারা চাপ দিলে দ্য নেশন-এর সম্পাদক শিরিন মিজারির সাফাই, শিরোনাম প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে শেষ হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে এটি তথ্যভিত্তিক নয়, কেবলই ধারণা! এই হলো অনেক ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার মান। পাকিস্তানে গণমাধ্যমগুলোর দ্রুত জনপ্রিয় হওয়ার অন্যতম উপায় মার্কিনবিরোধিতা। যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তান আক্রমণ করে, তবে পাকিস্তানিদের কী করতে হবে, কীভাবে জবাব দিতে হবে, তাও টেলিভিশন-রেডিওর টক শোতে আলোচনা হয়। কোনো কোনো নিউজ চ্যানেলে বাজানো হয় রণসংগীত! গুজবনির্ভর রিপোর্টিংয়ের পাশাপাশি আছে অদক্ষতা, বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়। রাষ্ট্রীয় বড় বড় অনুষ্ঠান কভার করতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আনাড়ি রিপোর্টারকে।
কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর স্বার্থে সাংবাদিকেরা ব্যবহূত হন। সাংবাদিকেরা রিপোর্ট লেখেন, আবার তাঁদের স্বার্থে রিপোর্ট প্রত্যাহার করে নেন। সাংবাদিকেরা এ জন্য দায়ী করেন তাঁদের নিম্ন বেতন, কম সুযোগ-সুবিধাকে। স্বাস্থ্যবিমার সুবিধা নেই, দুর্বল চাকরি নিরাপত্তা ও পেশাগত মানের দুর্বলতার কারণে পাকিস্তানের মিডিয়া মার্কেটে ‘ব্ল্যাকমেইল জার্নালিজম’ বা ঘুষ সাংবাদিকতা শব্দ দুটি বিশেষ জায়গা পেয়েছে। রিপোর্টার সালমান সিদ্দিকী গত বছর করাচিতে একটি সম্মেলন কভার করতে গিয়ে সৃষ্ট অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন সম্প্রতি একটি ব্লগে। সেখানে গিয়ে একটি খাতায় তিনি নাম স্বাক্ষর করেন। কিছুক্ষণ পরে তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় একটি খাম। খুলে দেখেন, ভেতরে পাঁচ হাজার রুপি। ততক্ষণে সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। সম্মেলনকেন্দ্র ত্যাগ করার আগে খামটি তিনি ওই এনজিও কর্মকর্তার মুখে ছুড়ে মারেন। সালমান লিখেছেন, ‘আমি বিস্মিত, তারা কীভাবে ঠিক করে কোনো রিপোর্টারকে কত টাকায় কেনা যাবে!’ তাঁর পরামর্শ, এসব ঘুষখোর সাংবাদিকের বুকে প্রেসকার্ড নয়, তাঁরা কত টাকায় বিক্রি হতে রাজি, সেই ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া উচিত।
৪. গণমাধ্যমের এ-সংকটের চেহারাটা পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে অনেকটাই অভিন্ন। সার্বিকভাবে ভারত হয়তো কিছুটা এগিয়ে আছে তাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে। পাকিস্তানে এখন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চলছে বটে, কিন্তু সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে হলে যেতে হবে অনেক দূর। সময় লাগবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করে। আর শক্তিশালী গণমাধ্যমই গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখে।
কাজী আলিম-উজ-জামান: সাংবাদিক।
ইমেইল: alim_zaman@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.