টেলিগ্রাফকে খালেদা জিয়া- বাংলাদেশ কখনও জঙ্গিদের অভয়াশ্রম হবে না

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ভারত। তবে বিএনপি নয়া দিল্লির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে আগ্রহী। ভারতের প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ই-মেইলের মাধ্যমে তিনি এ সাক্ষাৎকারটি দেন সোনিয়া সরকারকে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কখনও জঙ্গিদের নিরাপদ অভয়াশ্রম হবে না। গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল বাংলাদেশ শুধু আমাদের স্বার্থে নয়, আমাদের অঞ্চলের স্বার্থের জন্যও প্রয়োজন। সাক্ষাৎকারটি এখানে তুলে ধরা হলো:

প্রশ্ন: আপনি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেন কেন?
উত্তর: আমাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ছিল নীতিগত। ২০১১ সালের মে মাসে আওয়ামী লীগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার পরিকল্পিত যে পদক্ষেপ নিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়াতেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সাধারণ নির্বাচন তত্ত্বাবধানে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে যে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল, তা এক মাস পর পঞ্চদশ সংশোধনী প্রণয়ন করে প্রতিস্থাপন করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী, রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ও সংসদ সদস্যরা তাদের পূর্বের পদে বহাল থাকবেন- এতে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল পুরোপুরি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায়। তারা ৫ই জানুয়ারির ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন বর্জন করেছে। এ নির্বাচনে স্পিকার ও বিরোধীদলীয় নেতাসহ অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। বাকি আসনগুলোতে ভোটার উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত কম, নির্ভরযোগ্য সূত্রমতে এর পরিমাণ প্রায় শতকরা ৫ ভাগ।
প্রশ্ন: জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর বিএনপি কেন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে?
উত্তর: এর কারণ খুবই সাধারণ। প্রথমত, আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়েছি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন এমন ব্যবস্থার অধীনে দাবি করি নি। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় নির্বাচন নির্দলীয়, যদিও প্রার্থীরা কোন না কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থনপুষ্ট। তৃতীয়ত, যেহেতু স্থানীয় সরকার নির্বাচন ছোট পরিসরে তাই নির্বাচন খুব সহজ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, স্থানীয় নির্বাচন ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় না। 
প্রশ্ন: আপনার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ কি? আপনি কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপের পক্ষে?
উত্তর: আমাদের পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ তথা বিএনপি ও এর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও স্বাধীনভাবে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা অনুধাবন করা। শেখ হাসিনা আর কতদিন জনগণের দাবি অস্বীকার করে চলবেন আবার গণতন্ত্রের কথাও বলবেন? তাকে অবশ্যই জনগণের দাবির প্রতি সাড়া দিতে হবে, নয়তো স্বৈরতন্ত্রের আড়ালে আশ্রয় নিতে হবে।
প্রশ্ন: ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে শেখ হাসিনার সরকার পুনঃনির্বাচন করবেন বলে তো মনে হয় না। আপনি কি বাংলাদেশ পরিচালনার সুযোগটি হারিয়েছেন?
উত্তর: আওয়ামী লীগের অব্যাহত অনড় অবস্থানের মুখেও সংলাপে বসার সব ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আহ্বানে বারংবার ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে বিএনপি। বাংলাদেশের জনগণের মতো বিএনপি বিশ্বাস করে যে, অবাধ, নিরপেক্ষ, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থপূর্ণ সংলাপ হওয়া অপরিহার্য। আমি উল্লেখ করতে পারি যে, আমার দল বা আমি বাংলাদেশ ‘শাসন’ করার ধারণায় বিশ্বাসী নই। আমরা আমাদের দেশ ও জনগণের সেবায় বিশ্বাসী।
প্রশ্ন: ভারতে অনেকে বিশ্বাস করেন আপনি ‘বন্ধু’ নন। আপনার ভাবমূর্তি কেন এতটা ভারত-বিরোধী?
উত্তর: আমাদের দল ও আমি ব্যক্তিগতভাবে সব রাষ্ট্র, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখায় বিশ্বাসী। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, এ ধরনের সম্পর্ক আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পারস্পরিক কল্যাণ ও শ্রদ্ধার মূলনীতির ভিত্তিতে হওয়া উচিত। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে ২০১২ সালের নভেম্বরে নয়া দিল্লি সফরের সময় ভারতের প্রতিটি পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এ বিষয়টি আমি পুনর্ব্যক্ত করেছি। ভারত সফরে আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। বন্ধুত্ব ও পারস্পরিকভাবে হিতকর সহযোগিতার যে আশ্বাস আমি দিয়েছিলাম, তা অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছিল বলে আমার ধারণা।
প্রশ্ন: তারপরও ইউপিএ সরকার শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছে...
উত্তর: ভারতে গণতন্ত্রের দীর্ঘ ও গৌরবময় ইতিহাস আছে। তাদের উচিত বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো, ঠিক যেমনটি তারা আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ও জনগণকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা সরকারকে সমর্থন দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারে ভারত।
প্রশ্ন: বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর: বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কোন ব্যক্তি বা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়। দুই দেশের জনগণের স্বার্থের দিকে নজর দেয়ার প্রয়োজন ও পারস্পরিক উপলব্ধির প্রতি সাড়া দেয়ার ভিত্তিতেই এ সম্পর্ক হওয়া উচিত। ভারতের জনগণই নির্ধারণ করবে কে তাদের দেশ পরিচালনা করবে। আমাদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করায় বিশ্বাসী আমরা।
প্রশ্ন: হাসিনা সরকারের অভিযোগ যে, আপনার সরকার ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছে।
উত্তর: শেখ হাসিনার মন্তব্য ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ২০১২ সালে আমার বৈঠকের সময় আমি তাদের আশ্বস্ত করেছিলাম যে, ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে বা যে কোন কিছু যা ভারতের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে, এমন কাউকে বাংলাদেশের ভূখ-কে কখনওই ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। বাংলাদেশ অতীতে কখনও জঙ্গিদের নিরাপদ আস্তানা ছিল না, ভবিষ্যতেও কখনও জঙ্গিদের অভয়াশ্রম হবে না।
প্রশ্ন: কিন্তু আওয়ামী লীগ বলে যে, বিএনপি ও এর মূল মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী হলো আল কায়েদার বন্ধু। তারা বাংলাদেশে একটি বিপ্লবের হুমকি দিয়েছে।
উত্তর: কোন সন্ত্রাসী হামলার হুমকিকেই হাল্কাভাবে নেয়া উচিত নয়। সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করার জন্যও এটাকে ব্যবহার করা উচিত নয়। দোষারোপের খেলা হলো নিজেকে হার মানানো। গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে বৈশ্বিক সন্ত্রাস। এই হুমকি মোকাবিলায় প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও এর বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রস্তুতি। আমাদের বহুজাতিক সমাজে সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের কোন স্থান নেই। যে কোন অবস্থায় বিএনপি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করছে এবং এর বিরুদ্ধে নিয়মিত কাজ করছে। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি সরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যে পদক্ষেপ নিয়েছিল তা-ই এক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে দেখানো যায়। ২০০৫ ও ২০০৬ সালের মধ্যে তৎকালীন বিএনপি সরকার ১১৭৭ জন সন্ত্রাসী ও কট্টরপন্থিকে গ্রেপ্তার করেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তখন বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে একটি নতুন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উপস্থিতি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনা। বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দর্শনের মধ্যে পার্থক্য আছে। জামায়াতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক নির্বাচনী জোটে। এছাড়াও বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের রাজনৈতিক জোট গঠনের ইতিহাস আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিত্রতা ছিল আওয়ামী লীগের। এছাড়াও ২০০৬ সালে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে আওয়ামী লীগ। ওই স্মারকে ধর্মীয় ফতোয়াকে বৈধতা দেয়ার কথা বলা হয়।
প্রশ্ন: যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির জন্য একটি জনপ্রিয় আন্দোলন হয়েছে। বলাবলি হয় যে, যাদেরকে যাবজ্জীবন শাস্তি দেয়া হয়েছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাদেরকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাদের পুনর্বাসন করা হবে। এটা কতখানি সত্য?
উত্তর: আমরা বিশ্বাস করি মানবতার বিরুদ্ধে যে বা যারাই অপরাধ করে থাকুক তাদেরকে স্বচ্ছতার সঙ্গে জবাবদিহির মুখোমুখি করতে হবে এবং আইন অনুযায়ী তাদের বিচার করা উচিত। যারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে তাদের বিচার করবে বিএনপি এমন একটি প্রক্রিয়ায়- যা হবে স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করে।
প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে একটি টেলিফোন সংলাপ প্রকাশ হয়ে গেছে। এতে কি বাংলাদেশের শীর্ষ দু’নেত্রীর অহংবোধের সংঘাত প্রকাশ পায় নি কি?
উত্তর: ওই সংলাপটি ছিল বাংলাদেশের শীর্ষ রাজনৈতিক দল দু’টির নেতার যোগাযোগ। এটাকে সেভাবেই দেখা উচিত। তা সরকার প্রকাশ করে দিয়েছে। এর যথার্থতা নেই। এর পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, একই সঙ্গে আস্থায় ফাটল ধরানো।
প্রশ্ন: বিএনপি এখন কোনদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে?
উত্তর: সবশেষে আমি বলতে চাই, বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এড়াতে হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল বাংলাদেশ শুধু আমাদের স্বার্থে নয়, আমাদের অঞ্চলের স্বার্থের জন্যও প্রয়োজন।

No comments

Powered by Blogger.