বিমানের গুম, মানুষের গুম

মানুষের ক্ষমতার সীমা আমরা জানছি, যখন আস্ত একটা বিমান স্রেফ নাই হয়ে গেল। এতটা দিন পার হয়ে গেল, আমরা তার কোনো হদিসই করতে পারলাম না! মানুষ নাকি মঙ্গলে যাবে। লুলু ফেরদৌস নামের এক বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণীও সেই দলে এখন পর্যন্ত আছেন। সেই যাত্রা নাকি হবে একমুখী। ফেরার পথ এখনো জানা যায়নি। ওখানে গিয়ে চাল-ডাল, পানি-অক্সিজেন জোগাড় করে নিজের মতো করে থাকতে হবে। তবু এঁরা যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। অন্যদিকে, স্টিফেন হকিং ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, চাঁদে মানুষ বসতি গড়বে ৫০ বছর পরে। সে ক্ষেত্রে আমাদের পত্রপত্রিকাগুলোয় বিজ্ঞাপন ছাপা শুরু হতে পারে: চাঁদে নিষ্কণ্টক জমি। রাজউক অনুমোদিত। নগদ দামে ৭০ শতাংশ ছাড়। সত্যি কথা বলতে কি, চাঁদে জমি বিক্রি শুরুও হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের ঠকবাজদের আগেই বিদেশের ঠকবাজেরা চাঁদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া শুরু করেছিল। এবার হয়তো মঙ্গলের জমি বিক্রিতে আমরা বাংলাদেশিরা এগিয়ে আসতে পারি সবার আগে। ড্যাপের আওতামুক্ত বন্যামুক্ত এলাকা। কৃষিজমি নয়। এখনই বাড়ি করার উপযোগী। প্রবাসীদের জন্য অগ্রাধিকার। তিন কাঠা, পাঁচ কাঠা ও ১০ কাঠার প্লটের জন্য আবেদন করুন।
মানুষ চাঁদে বসত করবে, মঙ্গলে বাড়িঘর বানাবে, তবু মানুষের ক্ষমতার সীমাটাও আমরা নতুন করে জানলাম, যখন মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের একটা বিমান স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল। হাওয়া হয়ে যাওয়াটাও কথার কথা। ওটা হাওয়া হয়ে গেছে, নাকি সমুদ্রে পানির নিচে গেছে, আকাশেই ছাই হয়ে গেছে, নাকি কোনো গোষ্ঠী বা দেশ সেটাকে কোথাও নামিয়ে গোপন করে রেখেছে, আমরা কেউ জানি না। লুলু ফেরদৌসেরা যখন মঙ্গলে পাড়ি জমানোর জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন, এবং প্রস্তুতির দলে যোগ দিয়েছেন, তখন আমি কিন্তু সেটা ভাবতে গিয়েই দম বন্ধ হওয়ার অস্বস্তি বোধ করছি। আমি উঁচু স্থান ভয় পাই। বদ্ধ স্থানও ভয় পাই। বিমানে চড়তে হবে শুনলেই আমার ভয় লাগতে থাকে। মালয়েশিয়ান বিমানটা নিখোঁজ হওয়ার পর আমি কলম্বো যাত্রা করেছি। বস্তুত এই লেখাটা কলম্বোর হোটেলে বসে লিখছি। আমি জানি না, ২০ মার্চ আমার বিমানটা গুম হয়ে যাবে কি না। আমি অবশ্য লেখাটা মেইল করে দেব। আশা করি, বিমান হারিয়ে গেলেও লেখা হারাবে না। বিমানে ওঠার আগে ঢাকায় দেখা একজন পাইলটের সঙ্গে। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে বিমান চলাচলের জন্য খারাপ আবহাওয়া শুরু হয় ১৫ মার্চ থেকে, চলে জুন পর্যন্ত। আমি তাঁকে বললাম, ‘ভাই, আমি ১৬ মার্চ ফ্লাই করব, ২০ মার্চ ফিরব। আপনি কি খারাপ আবহাওয়াটা ২১ মার্চ থেকে শুরু করতে পারেন?’ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা যান, আপনার জন্য এটা ২২ মার্চ করে দেওয়া হলো।’ শুনে স্বস্তি পেলাম। শুধু একটাই প্রশ্ন, খারাপ সময়টা পিছিয়ে দেওয়ার খবর আমি না-হয় জানলাম, আবহাওয়া নিজে জানে তো? উঁচু ভবনও আমি খুব ভয় পাই।
এফ আর খান সাহেবের নকশা করা সিয়ারস টাওয়ারের ওপরে ১০৫ থেকে ১০৬ তলার ছাদে একটা জায়গায় একটা কাচ আছে। সেটার ওপরে চড়লে নিচের মাটি দেখা যায়। আমি সেই কাচের আশপাশেও যাইনি। এ থেকে বুঝতে পারছেন, আমার উচ্চাভিলাষ কম। আমি বেশি ওপরে উঠতে পারব না। সড়কপথেও তো খুব দুর্ঘটনা ঘটে। লঞ্চ ডুবে যায়। তবু মনে হয়, সড়কপথের দুর্ঘটনা বা লঞ্চের ডুবে যাওয়াও মেনে নিতে পারব। কিন্তু বিমান যদি দুর্ঘটনায় পড়ে?... আল্লাহ না করুন... কথা হচ্ছিল বিমান হারিয়ে যাওয়া নিয়ে। আমেরিকানরা গবেষণা করছেন, প্রধানত যুদ্ধের প্রয়োজনে, শত্রুর যেকোনো যান বা সদস্যের অবস্থান তাঁরা সব সময় নিরূপণ করবেন। কত বিচিত্র বিষয়েই না গবেষণা হচ্ছে। শুধু মালয়েশিয়ার বিমানের খবর আমরা পাই না। একটা বিমান যখন গুম হয়ে যায়, পৃথিবীর মানুষ তা নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। আজও দেখলাম, বিবিসি ও সিএনএন মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলন সরাসরি দেখাচ্ছে। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন গুম হয়ে যায়, তখন? একজন ব্যক্তিকেও বাঁচিয়ে রাখা কত কঠিন, যখন ক্যানসারে আক্রান্ত কোনো তরুণের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার কাজে যুক্ত হয়ে পড়ি, তখন কিছুটা বুঝি। কিন্তু কী অবলীলায় আমরা মানুষেরা মানুষকে গুম করে ফেলছি। ক্রসফায়ারে ফেলছি। মনে রাখতে হবে, মালয়েশিয়ান ওই বিমানের যাত্রীদের প্রত্যেকের আত্মীয়স্বজনের মনে যে উদ্বেগ, বাংলাদেশেও যেকোনো পরিবারের যেকোনো হারিয়ে যাওয়া ব্যক্তির স্বজনদের বুকেও একই উদ্বেগ। মানুষের সীমাবদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে রুশ সাবমেরিনের কথাটা আমি ভুলতে পারি না। একটা সাবমেরিনে ক্রুরা আটকা পড়লেন, তাঁরা বললেন, ‘আমরা বিপদে পড়েছি, আমাদের উদ্ধার করো।’ সারাটা পৃথিবী তা জানল, কিন্তু সেই উত্তাল সমুদ্রে তাঁদের কাছে উদ্ধারকারী ব্যক্তিরা পৌঁছাতেই পারলেন না।
লোকগুলো আস্তে আস্তে নিশ্চিত মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হলেন। মানুষ মানুষকে ধ্বংস করার জন্য যত গবেষণা করেছে, যত বিনিয়োগ করেছে, যত মারণাস্ত্র বানিয়েছে, তার একাংশ যদি মানুষকে বাঁচানোর জন্যও করত, পৃথিবীটা সত্যি একটা মনোরম স্থানে পরিণত হতো। মানুষের মৃত্যুও হয়তো মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু একজন ব্যক্তি নিখোঁজ হয়ে যাবে, এটা তার আত্মীয়স্বজন মেনে নিতে পারে না। তারা সারা জীবন অপেক্ষা করে, একটা ক্ষীণ আশা থাকে—হয়তো ছেলে বা মেয়ে ফিরে আসবে। আর গুম নিয়ে আমি তো একটা উপন্যাসই লিখেছি বছর দুয়েক আগে। ‘সেই গুমের পর’। প্রথম আলোতেই প্রকাশিত হয়েছিল গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি, এর চেয়ে ক্রসফায়ার ভালো ছিল। অন্তত লাশটা পাওয়া যায়। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা কতগুলো বাস্তব সমস্যায়ও পড়ে। গুম হওয়া ব্যক্তির স্ত্রী বিয়ে করতে পারবেন না, তাঁর সম্পত্তির বিষয়েও সহজে ফয়সালা হবে না! কারণ, স্বামী তো মারা যাননি। যদি এখনই এসে হাজির হন! গদ্যকার্টুন আসলে মন খারাপ করা বিষয় নিয়ে লিখতে চাই না। হাস্য-কৌতুক করতে চাই এই কলামে। কাজেই পুরোনো কৌতুকটাই আবার করি। একটা বিমান দুর্ঘটনায় পড়েছে। সব যাত্রী মারা গেছে। শুধু এই বিমানের যাত্রী একটা বাঁদর বেঁচে আছে। তাকে বলা হলো, ‘বিমানটা যখন অ্যাক্সিডেন্ট করে, যাত্রীরা কী করছিল?’
বাঁদর দুই হাত বাঁ কানের কাছে জোড় করে ধরে মাথাটা কাত করে চোখ বন্ধ করে দেখাল: ঘুমাচ্ছিল।
‘তখন বিমানসেবকেরা কী করছিলেন?’
বাঁদর আবার দুই হাত বাঁ কানের কাছে জোড় করে ধরে মাথাটা কাত করে চোখ বন্ধ করে দেখাল: ঘুমাচ্ছিল।
‘চালকেরা কী করছিলেন?’
বাঁদর দেখাল: ঘুমাচ্ছিলেন।
‘তাহলে তুই বাঁদর কী করছিলি?’
বাঁদর ককপিটে বসে বিমানের যন্ত্রগুলো টেপাটেপি করল। অর্থাৎ সে বিমান চালাচ্ছিল! আমরা সব সময় প্রার্থনা করব, আমাদের চালকেরা যেন ঘুমিয়ে না পড়েন। এবং যাঁদের ওপর দায়িত্ব, যাঁরা যে কাজের জন্য যোগ্য ও প্রশিক্ষিত, তাঁদের বদলে যেন বাঁদরেরা স্টিয়ারিং না ধরে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.