পঞ্চাশে মনে হল মনচাষে নেমে গেলাম by আনোয়ার সেলিম

নাসরীন জাহান একজন ব্যতিক্রমী ধারার কথাসাহিত্যিক। এ বছরই তিনি পঞ্চাশে পদার্পণ করলেন। নাসরীন জাহানের লেখালেখি ও ব্যক্তিগত অনেক বিষয় নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেন শ্যামল চন্দ্র নাথ। সেই কথোপকথনের অংশবিশেষ যুগান্তর সাময়িকীতে পত্রস্থ হল বি. স.
শ্যামল : এখন আপনার সময় কীভাবে কাটছে?
নাসরীন জাহান : গত চার-পাঁচ মাস থেকে আমি লিখতে পারছি না। আমার ডান হাতের আঙুলে ব্যথা পেয়েছি। যার ফলে আমি একটা ডিপ ডিফরেশনের মধ্যে আছি। আমি আশা করছি, আমি এটা কাটিয়ে উঠব। আঙুলটা ভালো হবে আবার। গত বছর আমার কোনো উপন্যাস বের হয়নি। খুব সিরিয়াসলি ভাবছি এবার একটা উপন্যাস লিখব। তো এর বিষয়বস্তু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি কম বেশি। আমি যদি থিমটা পেয়ে যাই তাহলে আমি উপন্যাসটা শুরু করব।
শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন..., চারটা কিশোর উপন্যাস লিখে হঠাৎ করে ছেড়ে দিলেন কেন?
: আমি একটা সময়ে ছড়া লিখতাম। ছড়া, কিশোর গল্প দিয়ে আমার উত্থান। শিশু একাডেমির প্রভাবে হোক, বা কিছু পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার প্রভাবে আমার চারটা উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে। আমি তো সিরিয়াস ধারার উপন্যাস লিখি। কিন্তু আমার মনে হল আমি যে লিখি এতে বাচ্চাদের ঠিক কমিউনিকেট করতে পারছি না। বা আমার ভাষাটা তা পারে না। আমার লেখাটা বাচ্ছাদের জন্য লিখলেও কিছু তৎসম শব্দ ঢুকে পড়ে। তখন আমার মনে হল, এটা বাচ্চাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।
আমি নিজেই এটা বিশ্লেষণ করেছি। ওই বিষয়টা লক্ষ্য করার কারণেই আমি নিজেই যেন গুটিয়ে গেলাম এর থেকে।
আপনার ‘উড়ুক্ক’ উপন্যাসটি খুবই আলোচিত- এ নিয়ে নতুন কিছু বলার আছে?
: নতুন করে যদি বলতে হয় তাহলে আমি বলব, যখন আমি পাঁচটা গল্পের বইয়ের পরে আমার প্রথম উপন্যাস উড়ুক্কু লিখি তখন আমার মনে হয়েছিল বা আমি জানছি যে এটা উপন্যাস হচ্ছে না। উপন্যাস যে লিখতে পারি এটা যাতে বলতে পারি এ কারণে লেখা। পুরস্কার পাওয়ার পরও বেশ অনেকদিন গেছে এটাকে আমার উপন্যাস মনে হয়নি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আমি যখন ওই উপন্যাসটার দিকে চোখ বুলাই তখন মনে হয় উপন্যাস হচ্ছে না। প্রতিটি লাইনে লাইনে আমার যে মমতা ছিল সে মমতা এখন আমি আমার লেখাতে দিতে পারি না। আমি যখন উড়ুক্কু লিখছিলাম তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম এটাই আমার প্রথম এবং শেষ উপন্যাস। আমি আর উপন্যাস লিখব না। এখন আমার মনে হয় উড়ুক্কুর ধরার বা ওই মানের উপন্যাস আমি আর লিখতে পারিনি আসলে।
আপনার কি আত্মজীবনী লেখার কোনো পরিকল্পনা আছে ?
: এক সময়ে আমার মনে হতো আত্মজীবনী লেখা মানে মানুষের গোপন বিষয় ফাঁস হয়ে যাওয়া। তারপর মনে হল, না; আÍজীবনীতে তো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের অনেক মজার অভিজ্ঞতা থাকে। সারা জীবন আমি ভেবেছি আমি লিখব। কিন্তু এখন আমার মনে হয় লিখলে ভালো হয়। লিখলে তা অনেকের জন্য খুবই ইন্টারেস্টিং হবে।
অবসর সময় কীভাবে কাটান।
: গান শুনি, টিভি দেখি, বই পড়ি, মুভি দেখি।
চলচ্চিত্রকে আপনি কিভাবে দেখেন? কি ধরনের চলচ্চিত্র আপনি দেখেন?
: আমি স্বাভাবিকভাবে আর্ট ফিল্মই দেখি। আমি আবার বাণিজ্যিক ধারার ছবিও দেখি। দুই ধারার ছবিই আমার দেখা। কিন্তু দেখা যেত, আমি শৈশবে আর্ট ফিল্ম ছাড়া কিছু দেখতেই পারতাম না, সহ্যও করতে পারতাম না। এখন সেটা ভিন্ন। আমার মনে হয় সব ছবি থেকে কিছু না কিছু নেয়ার আছে। কোনটা থেকে বিনোদন নেয়ার আছে, আবার কোনটা থেকে মানুষের জ্ঞান নেয়ার ব্যাপার থাকে। সবগুলোই জরুরি জীবনের জন্য।
উপন্যাসে রিয়ালিজম এবং রোমান্টিসিজম এ দুটি ধারাকে বা ভিন্নতাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
: দুটিকে আমি ভিন্নভাবে দেখি না। রোমান্টিসিজম তো একটা বাস্তবতা। এটা তো রিয়ালিজমের মধ্যেই পড়ে।
কিন্তু রোমান্টিসিজমে তো অনেক সময় আবেগটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
: হ্যাঁ, আবেগ থাকলে মানুষ বুঝতে পারে না। মানুষ মনে করে মানুষ স্বপ্নের মধ্যে আছে। মানুষ যখন মনে করে সে স্বপ্নের মধ্যে আছে আবার যখন সে ওই পর্যায়টা পার হয় তখন তো সে বাস্তবে আসে। তখন সে মনে করে সে বাস্তবের মধ্য দিয়েই গেছে। তখন ওটাই তার রিয়েলিটি। এটা চমৎকার একটা বিষয়। দ্বন্দ্ব নেই আবার মনে হয় দ্বন্দ্ব আছে। দ্বন্দ্ব মনে হয় তখন, যখন ভাসতে থাকে। ফলে মনে হয় এটা সত্য না। যখন ফিরে আসে তখন মনে হয় ও আচ্ছা আমি এটার মধ্যে গেলাম।
ছাপার অক্ষরে যখন আপনার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় তখন আপনার কেমন অনুভূতি হয়েছিল।
: এটা ভাষায় প্রকাশের বাইরে। আমার জীবনের অনেক অনেক প্রাপ্তি আছে। অনেক প্রাপ্তির মধ্যে এটা অন্যতম। আমি তখন ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল থেকে ঢাকার শিশু পত্রিকায় আমার গল্প ছাপা হয় প্রথম সংখ্যায়। স্কুলে তো সবাই জানে আমি লেখালেখি করি ক্লাস ফোর থেকে এবং গল্পটা ছাপা হয়। ছাপা হওয়ার পর স্কুলে আমার দাম বেড়ে গেল। আমি তখন নানা বাড়ি যাচ্ছিলাম বাসে। আমার মনে হয়েছিল সবাই আমাকে চিনবে এবং অভিনন্দন জানাবে। কিন্তু আমাকে তো কেউ চিনছে না। আমি সাংঘাতিক স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছিলাম।
আপনি অনেক সময় পেরিয়ে এলেন আপনার জীবনের অপ্রাপ্তি নিয়ে যদি কিছু বলতেন।
: অপ্রাপ্তি বলতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি আসলে ভালো কোনো উপন্যাস লিখতে পারিনি। আমি সারা জীবন শুনেছি যে এত ছোট মেয়েটা কি করে এত কাজ করছে! এত ছোট মেয়েটা এ বয়সে কি করে? আমি এই করতে করতে জীবনের এ বয়সে এসে যে আমি পৌঁছে যাব বুঝিনি। এ বয়সে এসে আমি দোলাচলে পড়ে গেলাম যে আমি সারা জীবনে ছোট ছিলাম। সেই আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে আমার মনে হয় আমার কিছু করাই হয়নি। আমার মনে হয় সিরিয়াস কোনো কাজই করিনি। এই নিয়ে আমি খুব হতাশার মধ্যে আছি।
৫০তম জন্মদিন নিয়ে আপনার অনুভূতি এবং ভাবনা কেমন?
: পঞ্চাশে আমার মনে হল যে আমি একটা মনচাষে নেমে গেলাম। আমি কখনও বুঝিনি আমার বয়স হয়ে গেছে। এখন আমি আমার মনচাষ করছি এবং নিজেকে খুঁজছি নিরন্তন। আমার শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে এখন এ বয়সে এই ভেবে আমি নিজেকে কিছুতেই বসাতে পারছি না। এ ৫০ বয়সটা আমার না, এটা অন্য কারও। এ নিয়ে আমার ভেতর নেগেটিভ ঘোর যাচ্ছে। জানি না এ থেকে আমি কীভাবে বেরিয়ে আসব।
কি ধরনের লেখা আপনার পছন্দ।
: যার লেখার মধ্যে বাস্তবের চেয়ে স্বপ্ন থাকে একটু বেশি। যেখানে রুঢ় বাস্তবতাকে একটা স্বপ্নের মাধমে একটু ফ্যান্টাসির মাধ্যমে আনতে পারে সেই লেখকের লেখা আমাকে তুমুলভাবে টানে।

No comments

Powered by Blogger.