সু চি কি পারবেন?

অং সান সু চি
সহযোগীদের নিয়ে দৃপ্ত পায়ে রেঙ্গুনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলেন এক দলনেত্রী। কিছুক্ষণ আগে তিনি শহরের উপকণ্ঠে এক সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন। গ্রীষ্মের গরমের রেশ তখনো কাটেনি। বাড়িতে ফেরার জন্য দ্রুত তাঁরা পা ফেলছিলেন। শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছিল। হঠাৎ একটি সামরিক যান তাঁদের সামনে এসে থামল। ঝটপট কয়েকজন সেনাসদস্য যান থেকে নেমে তাঁদের দিকে রাইফেল তাক করলেন। সেনাদলের ক্যাপ্টেন, তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াও। নইলে গুলি করব।’ দলনেত্রী চুপচাপই ছিলেন। সহযাত্রীদের পেছনে রেখে ক্যাপ্টেনের সামনে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে যাচ্ছি। তাতে তো তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।’ জবাবে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘না, রাস্তার পাশ দিয়েও তোমরা হাঁটতে পারবে না। আমাদের কথা যদি অমান্য করো, গুলি করব।’ দলনেত্রী জানতেন, সেনাবাহিনী তাঁদের ঘৃণার চোখে দেখে। দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের ক্রোধও কম নয়। তিনি শান্ত স্বরে সহযাত্রীদের রাস্তা থেকে সরে যেতে বললেন। এরপর ক্যাপ্টেনকে সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিলেন, ‘আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবই। পারলে আমাকে গুলি করো।’ তখনো সেনারা তাঁর দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ছিল। যেকোনো মুহূর্তে গুলি ছুড়তে পারে। ইতিমধ্যে দলনেত্রী মনস্থির করে ফেলেছেন। সেনারা তাঁকে হত্যা করতে চাইলে নিবৃত্ত করা যাবে না। তিনি তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সামরিক যান থেকে নেমে এলেন মেজর পদমর্যাদার এক সেনা কর্মকর্তা। তিনি অধীনদের রাইফেল নামিয়ে নিতে বললেন। আর সহযাত্রীদের নিয়ে দলনেত্রী পা বাড়ালেন বাড়ির উদ্দেশে। এই দলনেত্রী অং সান সু চি। ত্যাগে, সংগ্রামে, ধৈর্যে ও দৃঢ়তায় তাঁর তুলনা মেলা ভার। তাঁকে বলা হয় এশিয়ার নেলসন ম্যান্ডেলা। বর্তমানে সু চি মিয়ানমারের বিরোধী দলের নেতা। বিশ্লেষকদের মতে, আগামী বছরের নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে এনএলডিই জয়ী হবে। কিন্তু সামরিক বাহিনী তাঁকে ক্ষমতায় আসতে দেবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। ১৯৯০ সালেও সু চির দল ৮১ শতাংশ আসনে জিতেছিল।
২. ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি দেশে ফিরেছিলেন অসুস্থ মাকে দেখতে। ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার বইয়ের ভূমিকায় তাঁর স্বামী মাইকেল এরিস লিখেছেন, ‘সেটা ছিল অক্সফোর্ডের শান্তসন্ধ্যা। মার্কের অন্যান্য দিনের সঙ্গে সেদিনের সন্ধ্যার কোনো পার্থক্য ছিল না। টেলিফোন যখন বাজল দুই ছেলে তখন বিছানায় শুয়ে ছিল এবং আমরা পড়ছিলাম। সু রিসিভার তুলে খবর পেল তার মা গুরুতর অসুস্থ। স্ট্রোক করেছেন। ফোন রেখেই সু চি ব্যাগ গোছাতে শুরু করলেন। তখনই আমার আশঙ্কা হয়েছিল, আমাদের জীবন বোধ হয় চিরতরে বদলে গেল।’ ২৬ আগস্ট রেঙ্গুনের গ্রেট শোয়েডন প্যাগোডার পশ্চিম পাশের ময়দানে আয়োজিত বিশাল সমাবেশে অং সান সু চি যে ভাষণ দেন, তা এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সংগ্রামে নিজেকে শামিল করেছি বাবার ঐতিহ্যের পদাঙ্ক অনুসরণ করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জনগণকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এটি অত্যন্ত পরিষ্কার এবং খোলাখুলি ব্যাপার। আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে ব্যর্থ হলে কিছুই অর্জন করতে পারব না। যদি দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হতেই না পারে, তাহলে কোনো আদর্শ বা পদ্ধতির সরকারই দেশের জন্য বড় কল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না।’ ১৯৯৯ সালে অং সান সু চির স্বামী ক্যানসারে মারা যান লন্ডনে। সামরিক সরকার গৃহবন্দী সু চিকে স্বামীর লাশ দেখতে লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি দিলেও তিনি তা নাকচ করে দেন এই ভেবে যে একবার দেশের বাইরে গেলে তারা আর দেশে ফিরতে দেবে না। ত্যাগে ও সংগ্রামে তাঁর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা; যিনি একনাগাড়ে ২৭ বছর শ্বেতাঙ্গ সরকারের কারাগারে ছিলেন। আর সু চি প্রায় ২১ বছর অন্তরীণ ছিলেন। ১৯৫৬ সালে সু চির বয়স যখন ১১ বছর, ইয়াঙ্গুনের মেথোডিস্ট ইংলিশ হাইস্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে মিয়ানমারের অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়ত—যাদের মধ্যে বার্মিজ, চীনা, ভারতীয়; খ্রিষ্টান, হিন্দু ও মুসলমানও ছিল। বর্মি মুসলমানদের সঙ্গে সু চি ও তাঁর বাবা অং সানের পরিবারের রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ১২ মার্চ ইয়াঙ্গুনে সুইডিস সাংবাদিক বার্টিল লিটনারের সঙ্গে আলোচনা হয় মিয়ানমারের রাজনীতি নিয়ে। আলোচনায় আরও ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও সাংবাদিক শ্যামল দত্ত।
লিটনার রোহিঙ্গা সমস্যা ও মিয়ানমার নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন। মিয়ানমারের মুসলমান নেতারা কীভাবে দেশটির স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন, তারও ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। বললেন, তাঁরা ছিলেন সবাই জাতীয়তাবাদী নেতা। সেদিন লিটনার আমাদের যে গল্পটি শোনান, তা কৌতূহলোদ্দীপক। ১৯৮৮ সালে অং সান সু চি রাজনীতিতে আসতে আগ্রহী ছিলেন না। ভেবেছিলেন মাকে দেখে লন্ডনে ফিরে যাবেন। কিন্তু বাবার তিন বন্ধু উ উইন থিন, উ মই থু এবং মং থো কা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দেশে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই মং থো কা একজন মুসলিম লেখক ও রাজনীতিক। লিটনার আমাদের যে ছবিটি দেখালেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১৯৮৮ সালের ২৪ আগস্ট ইয়াঙ্গুন জেনারেল হাসপাতালের অস্থায়ী মঞ্চে সু চি যখন বক্তৃতা দিচ্ছেন, তাঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন মং থো কা, যার আসল নাম নূর মোহাম্মদ। আন্দোলনের একপর্যায়ে আরও অনেকের সঙ্গে মং থো কাও গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৯১ সালের ১১ জুন কারাগারেই মারা যান এবং ইয়াঙ্গুনের সুন্নি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। মিয়ানমারের মুসলমানরা এখনো অং সান সু চিকে তাঁদের শেষ ভরসা মনে করেন। তাঁদের ধারণা, গণতন্ত্রের আন্দোলনকে সু চি যেভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, রোহিঙ্গাদের রক্ষায়ও তিনি কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। অং সান সু চি সরাসরি রোহিঙ্গাদের পক্ষ না নিলেও ২০১২ সালে জাতিগত দাঙ্গার পর একে বড় ধরনের ‘আন্তর্জাতিক ট্র্যাজেডি’ বলে অভিহিত করেন এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শান্ত থাকতে বলেন। তবে সু চি এও স্বীকার করেন যে তিনি যে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেটি বৌদ্ধ সংখ্যাগুরুদের দল। তাঁকে ভোটের কথা ভাবতে হয়। সে কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, সু চি নির্বাচিত হলে কি মিয়ানমারের বর্তমান ক্ষমতাকাঠামোয় পরিবর্তন আসবে? তিনি কি জাতিগত বিদ্বেষ ও বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে সব নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করতে পারবেন? না জাতিগত সোভিনিজম এই শান্তিবাদী নেত্রীকেও আচ্ছন্ন করে রাখবে? (শেষ) সংশোধনী: গতকাল বাংলাদেশ-মিয়ানমার বাণিজ্যের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে, সেটি হবে ডলার নয়, টাকার অঙ্কে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.