কঠিন সঙ্কটে ফের তাতার মুসলমানরা

শেষ পর্যন্ত ক্রিমিয়া রাশিয়ার অঙ্গরাজ্য হয়ে গেলো। ইউক্রেন ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার ও রাশিয়ায় যোগ দেয়ার পক্ষে রেফারেন্ডসে রায় দিলেন ৯৬ শতাংশ ক্রিমিয়ান। এর পরপরই একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিলেন, ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হলো। বিপাকে পড়েছেন ক্রিমিয়ার মুসলিম তাতাররা। অঞ্চলটি ইউক্রেনের অঙ্গীভূত থাকাকালে যে স্বাধীনতা তারা ভোগ করেছেন, রুশ কর্তৃত্বে ক্রিমিয়া চলে যাবার পর সে স্বাধীনতা তাদের হারাতে হবে ভেবে তাতাররা উদ্বিগ্ন। রুশ শাসনের তিক্ত ও বেদনাদায়ক স্মৃতি তাদের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। ১৯৪৪ সালে তাতারদের গণহারে নির্বাসনে পাঠানো ও হত্যার ইতিহাস তাতার মুসলিমরা কোনোদিন ভুলতে পারবেন না।
ক্রাইমিয়ান তাতারদের এক আঞ্চলিক নেতা মুস্তাফা আসাবা গত মঙ্গলবার রয়টার্সকে বলতে লাগলেন, আমাদের দমন-পীড়ন রুশরা আবার চালাতে চাইলে আমরা প্রতিরোধ গড়বো। জানি আমাদের ওপর মোকদ্দমা চলবে, আমাদের জেলে পাঠানো হবে- তবুও আমরা দমবো না। আড়াই লাখের বেশি তাতার মুসলিম বর্তমানে ক্রিমিয়ার বাসিন্দা। অঞ্চলের মোট ২০ লাখ জনসংখ্যার তারা প্রায় ১৩ শতাংশ।
১৯৪৪ সালে স্ট্যালিন ছিলেন সোভিয়েতের অধিনায়ক। তার হুকুমে তাতার মুসলিমদের সমস্ত ঘরবাড়ি তখন কেড়ে নেয়া হয়। মসজিদগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া হয় এবং পরিণত করা হয় গুদামে। নিরশ্বেরবাদী যাদুঘরে পরিণত করা হয় একটি মসজিদকে। বেলগর্স্ক-এর এক দোকান মালিক নাইয়ারা বললেন, তার একটি মাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে কি হবে ভেবে তিনি ভয় পাচ্ছেন।
বেলগর্স্কের আতঙ্কগ্রস্ত সংখ্যালঘুরা সামনে দুর্দিনের আশঙ্কায় খাদ্য জমা করতে শুরু করেছেন এবং এলাকার বাইরে থেকে প্রবেশ ঠেকাতে নিরস্ত্র পাহারার আয়োজনে নেমেছেন।
আসাবা বলতে লাগলেন, তাতার মুসলিমদের মধ্যে উদ্বেগ ও উত্তেজনা ক্রমে বাড়তে থাকলেও জন্মভূমি ছেড়ে যেতে তারা রাজি নন। যে কোনো অবস্থায় ক্রিমিয়ায় থেকে যেতে প্রস্তুত ৯৫ শতাংশ তাতার মুসলিম। তাতার মুসলমানরা কয়েকশ’ বছর ধরে ক্রিমিয়ার বাসিন্দা। নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে স্ট্যালিন ১৯৪৪ সালে তাদের দেশ ছাড়তে ও নির্বাসনে যেতে বাধ্য করেছিলেন। দুর্গম যাত্রাপথে বহু মুসলমান শাহাদৎ বরণ করেন। সে সময় তাতার মুসলমানরা সংখ্যায় ছিলেন ২ লাখের বেশি। ১৯৮০ দশকের শেষদিকে সোভিয়েতে পেরেস্ত্রইকা চালু হয়। তারপর মুসলমানরা অনুমতি পান জন্মভূমিতে ফেরার। তাদের ফেরার প্রক্রিয়া চলতে থাকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত বিলুপ্ত হওয়ার এবং ইউক্রেন স্বাধীন ঘোষিত হওয়ার সময় পর্যন্ত। হারানো জমি ও জায়গার ওপর নিজেদের স্বত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নানা আইনি বাধা-বিপত্তির মুখে পড়তে হয় তাতার মুসলিমদের। তাদের যাবতীয় জমি ও সম্পত্তি তাদের অনুপস্থিতিতে জবরদখলে নিয়েছিল জাতিগত রুশরা।
অরাজক পরিস্থিতি বর্তমানে বিরাজ করছে ক্রিমিয়ায়।
ক্রিমিয়া রাশিয়ায় যুক্ত হওয়ার পর পরই শত শত তাতার মুসলমানকে নিহত এক তাতার আন্দোলন কর্মীর জানাযায় শরিক হতে দেখা যায়।
তাতার আন্দোলনকর্মী রেশাত আমেতফের আকস্মিক গায়েব ও খুন হওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে ক্রিমিয়ায় পেছনের সপ্তাহ থেকে কেমন অরাজক আবহাওয়া চলতে শুরু করেছে। মানবাধিকার গোষ্ঠীর ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ডেপুটি ডিরেক্টর ব্যাশেল ডেনবার-এর অন ইসলামের হস্তগত এক বিবৃতিতে দাবি করা হয়, এই গুম ও হত্যাকা-ের আগাগোড়া তদন্ত চালিয়ে দোষীদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া হচ্ছে ক্রিমিয়ান কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব তারা এড়িয়ে যেতে পারে না।
দু’সপ্তাহ আগে তাদের একটি প্রতিবাদ মিছিল থেকে মুসলিম আন্দোলনকর্মী রেশাত আমেতফকে ফৌজি জ্যাকেট পরা কিছু লোক তুলে নিয়ে যায় এবং তখন থেকে তিনি লাপাত্তা। রোববার তার লাশ পাওয়া যায়। নির্যাতনের স্বাক্ষরসহ তার লাশটি ফেলে রাখা হয় কাছের একটি জঙ্গলে।
তিন সন্তানের বাবা ও পেশায় নির্মাণকর্মী ৩৯ বছর বয়সী আমেতফ ক্রিমিয়ার ইউক্রেন থেকে বেরিয়ে পড়ার ও রাশিয়ার অঙ্গীভূত হওয়ার ছিলেন বিরোধী।
আমেতফের অস্বাভাবিক বিদায়ে জানাযায় ক্রন্দনরত তার এক আত্মীয় ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘সত্যের পক্ষে লড়াই ছিল আমেতফের। তার দাদাও আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন বিশ্বযুদ্ধের সময়। আত্মীয় বলতে লাগলেন, আমেতফের প্রাপ্য ছিল সম্মানসূচক পদক। বদমাশদের হাতে তার এভাবে খুন হওয়ার কথা ছিল না।’
আমেতফের গুম হওয়ার ও পরে খুন হওয়ার ঘটনায় রুশ নিয়ন্ত্রিত ক্রিমিয়ায় নিজেদের ভবিষ্যৎ দুর্দিন নিয়ে আবার শঙ্কায় দিন কাটাতে শুরু করেছেন তাতার মুসলমানরা। রুশ নিয়ন্ত্রণে তাদের বিঘিœত ভবিষ্যতের আভাস তারা খুঁজে পাচ্ছেন আমেতফের ঘটনায়।
ক্রিমিয়ার মুসলমানরা প্রেসিডেন্ট পুতিনকে একটি সতর্কবার্তা পাঠিয়েছেন।
রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযুক্তির উল্টো পরিণাম রাশিয়াকে ভবিষ্যতে ভুগতে হবেÑ এই বলে পুতিনকে সতর্ক করেন আসাবা।
ক্রিমিয়া নিয়ে ইউক্রেনকে আজ যে পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে, সেই অভিন্ন পরিস্থিতির মুখে রাশিয়াকে পড়তে হবে আর মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই। আসাবার মতে, মাত্র এক বছর আগেও কেউ ভাবতে পারেনি যে, ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হবেন। কিন্তু তা ঘটেছে। অন-ইসলাম।

No comments

Powered by Blogger.