সংবিধান ব্যাখ্যায় গওহর রিজভীর ভ্রান্তি

প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী প্রচলিত রাজনীতিক হলে তাঁর লেখার প্রতিক্রিয়া দেখাতাম না। ১২ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখায় তাঁর মন্তব্য: ‘আমাদের সংবিধান সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট এবং সন্দেহ করার কোনো সুযোগ এতে রাখা হয়নি।’ অথচ বাহাত্তর থেকেই এ-সংক্রান্ত বিধানাবলি অনির্দিষ্ট, অস্পষ্ট এবং ধূম্রজাল সৃষ্টি করার মতো উপাদানে ঠাসা। কয়েকটি নির্দিষ্ট উদাহরণ দিচ্ছি। ২৪ জানুয়ারির ৯০ দিন আগে নির্বাচন করতে হবে। কিন্তু কী কারণ ঘটলে ৯০ দিন পরও করা যাবে, তা সংবিধানের কোথাও বলা নেই। কোনো কারণে যদি সংসদ ভেঙে নির্বাচন করা লাভজনক মনে হতো, তাহলে প্রধানমন্ত্রী তা-ই করতেন। আবার গত ২৭ অক্টোবর বা তার পরপরই যদি সাধারণ নির্বাচনটা সারতেন, তাহলে তা-ও সংবিধানসম্মত হতো। নির্বাচন যদি ৫ অক্টোবর হতো, তাহলে ৭২(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হতো। কারণ, এটি বলেছে, যেকোনো সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে সংসদকে বসতে হবে। ৫ অক্টোবর নির্বাচনের ফল পেলে এর ৩০ দিন শেষ হতো নভেম্বরের গোড়ায়। অথচ ড. রিজভী একমত যে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম সংসদ বলবৎ থাকবে। তাহলে নভেম্বরের মধ্যে দশম সংসদ ডাকা আর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবম সংসদ বলবৎ থাকার মধ্যে অস্পষ্টতা তিনি কী করে অস্বীকার করবেন? আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে আনিসুল হকের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি মন্ত্রিসভার আগাম শপথ গ্রহণের কারণ হিসেবে ৭২(২)
অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। বললেন, এটা রীতি যে সংসদ আহ্বান থেকে বৈঠকে বসার মধ্যে ১৫ দিনের ব্যবধান থাকতে হবে। গতকাল রাষ্ট্রপতি ২৯ জানুয়ারি বৈঠক ডেকেছেন। কিন্তু আইনে ১৫ দিনের কথা বলা নেই। এমনকি কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেও সংসদ ডাকা যায়। বিধি ৩ বলেছে, স্বল্পকালের নোটিশেও ডাকা যাবে। এমনকি সদস্যদের ‘আহ্বানপত্র’ও দিতে হবে না। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়ে বা তারযোগে অবগত করালেও চলবে। সুতরাং ২৫ জানুয়ারি শপথ নিয়ে চার দিনের নোটিশেও ২৯ জানুয়ারিতে বৈঠক করা যেত। শেখ হাসিনা ও তাঁর মন্ত্রীরা নিজ নিজ পদে অনির্দিষ্টকাল ধরে বহাল থাকতেন। ড. রিজভীর কথায়, ‘এ মুহূর্তে এটা সুস্পষ্ট যে একই সঙ্গে দুটি সংসদ—নবম ও দশম সংসদ—বিরাজ করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। নবম সংসদ ২৪ জানুয়ারিতে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। দশম সংসদ ২৫ জানুয়ারি বা এর পরে যথাশীঘ্র সম্ভব কোনো দিনে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক আহূত হওয়ার পরই বহাল হবে।’ সত্য হলো, ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত নবমই একমাত্র বৈধ সংসদ। দশম সংসদের সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণকারী মন্ত্রীরা আইনিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তিনিও বলেছেন, নবম বলবৎ থাকবে। আবার বলছেন, দশম সংসদ ২৫ জানুয়ারির পর বহাল হবে। আমরাও তো তা-ই বলি। তাহলে তিনি এখন কোন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা?
নবমের, না দশমের প্রধানমন্ত্রীর? একসঙ্গে দুটি সংসদ যদি বিরাজ না-ই করে, তাহলে দশমের ২৮ সাংসদ মন্ত্রী হলেন কীভাবে? রাষ্ট্রপতি কোন সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠের আস্থাভাজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিলেন? ১৯৭৩ সালে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট বিধান যেমন ছিল, ২০১৪ সালেও অবিকল তা-ই। তাহলে তিয়াত্তরের সংসদ নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু কেন পদত্যাগ করেছিলেন? কেন সেদিনের রাষ্ট্রপতি তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছিলেন? তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে এ নিয়ে আগে কথা বলেছিলাম। তিনি সেদিন বঙ্গভবনে পদত্যাগী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই ছিলেন। তিয়াত্তরে সংবিধান বা সংসদীয় রীতি যা ছিল, আজও তাই। তাহলে কেন তার পুনরাবৃত্তি ঘটল না। শেখ হাসিনাকে কে সর্বদলীয় সরকার করতে বলেছিল? সংবিধানে এর সমর্থন ছিল না। বরং সংসদে প্রতিনিধিত্বের অনুপাতে জাতীয় পার্টিকে হালুয়ারুটি বিলিয়ে সংসদীয় রীতি তছনছ করা হয়েছে। এখন নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনেরা বলছে, এসব ভুলে যান। তর সইবে না। তাই নবম সংসদ থাকতে দশম সংসদের প্রধানমন্ত্রী দেখতে হলো। অথচ সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ বলেছে, সকল পরিস্থিতিতে দেশে একটি সংসদ থাকবে। মাহমুদুর রহমান মান্নার উপস্থাপনায় একটা টক শো হচ্ছিল। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য সেখানে ছিলেন। বললাম, সংসদ ও নির্বাচনসংক্রান্ত আধা ডজনের বেশি অনুচ্ছেদ আছে,
এমনটা বিশ্বের অন্যান্য সংবিধানে দেখা যায় না। একটি অনুচ্ছেদ অন্যটির সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করেছে। তখন ওই বিজ্ঞ আইনবিদ আমাকে নাকচ করে বলেছিলেন, এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিকল্প। তিনি যেটা খুশি বেছে নেবেন। কোনো সংঘাত নেই। তখন একজন দর্শক প্রশ্ন করেছিলেন, বিকল্পই যদি হবে, তাহলে তো ঐচ্ছিক হিসেবে থাকতে হবে। অথবা দিয়ে বলতে হবে। সংবিধানে সবই যখন ‘শ্যাল’ বা বাধ্যকর হিসেবে চিহ্নিত তখন আপনার যুক্তি টেকে কি? এর উত্তর দেননি তিনি। পরে একান্তে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ’৭২ সালে তারা ব্রিটিশ রেওয়াজকে যথাসম্ভব লিখিত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। এটা সত্যি হতে পারে। তবে এর ফলে তাঁরা সবই নষ্ট করে দিয়েছেন। একটা গোলকধাঁধা সৃষ্টি হয়েছে। সংবিধানপ্রণেতারা সম্ভবত বিবেচনায় নেননি যে সব রীতি-রেওয়াজ লিখতে গেলে ঝামেলা কমে না, বাড়ে। হাউস অব কমনস কয়েক বছর ধরে সংবিধান সংস্কার নিয়ে মহাব্যস্ত। সেখানে কয়েক পিপে কালি খরচ হলো কেবল এটা খতিয়ে দেখতে গিয়ে যে শত শত বছর ধরে অনুসরণ করা সব রীতি-রেওয়াজকে গ্রন্থনা করা ঠিক হবে কি হবে না। কতটুকুর লিখিত রূপ দেবেন, কতটুকু দেবেন না। রিজভী যুক্তি দেন যে, ‘যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, শব্দাবলি দ্ব্যর্থহীনভাবে পরিষ্কার করছে যে, নতুন এমপিদের শপথ গ্রহণ এবং নিকট ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কোনো তারিখে কার্যভার গ্রহণের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে।’ এই বাক্য প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরাও পাঠ করেছেন।
তাহলে কি তাঁরাও কার্যকর শপথ নেননি? তাঁদেরও বাস্তব কার্যভার ঘটেনি? ড. রিজভী লিখেছেন, ‘শপথ না হলে সংসদীয় নেতা নির্বাচন হয় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা রাষ্ট্রপতিকে নতুন সংসদের সভা ডাকতে অনুরোধ করতে পারেন না।’ এটা তাঁর একটি গুরুতর ভ্রম। এই যুক্তি অসাংবিধানিকও। কারণ, সংবিধানমতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে সংসদ ডাকতে অনুরোধ করা যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে যায় না। প্রয়াত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ব্রিটেনের উদাহরণ টেনে বলতেন, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হবেন দুজন আলাদা মানুষ। সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ব) বিধি বলেছে, ‘সংসদ নেতা অর্থ প্রধানমন্ত্রী বা এমন কোন মন্ত্রী যিনি সংসদের অন্যতম সদস্য এবং সংসদ নেতা রূপে কাজ করবার জন্য প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত।’ এর অর্থ হচ্ছে আমাদের আইনও কল্পনা করেছিল যে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা এক ব্যক্তি হবেন না। অথচ ড. রিজভী স্বতঃসিদ্ধ যুক্তি দিচ্ছেন যে, ‘সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যিনি সংসদের নেতা নির্বাচিত হবেন তিনি একই সাথে প্রধানমন্ত্রী পদাধিকারী। তাঁকে তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বাছাই করতে হবে, তাদের শপথ নেওয়াতে হবে এবং বিলম্ব ছাড়াই রাষ্ট্রের কার্যাবলি শুরু করতে হবে।’ এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতের মনমোহন সিং ও ব্রিটেনের ডেভিড ক্যামেরন উভয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী, কেউ সংসদ নেতা নন। সংসদ ও মন্ত্রিসভা গঠন দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। নবম সংসদ না থাকলে, এমনকি দশম সংসদ গঠন করা সম্ভব না হলেও শেখ হাসিনাসহ সব মন্ত্রী তাঁদের উত্তরাধিকারীরা শপথ গ্রহণ, মানে কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারতেন। তবে গওহর রিজভীর সঙ্গে একমত যখন তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক শুদ্ধতা এবং আইনের শাসন গণতন্ত্র সংহতকরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ।’ তবে এটা তাঁর স্বীকার না করার অপারগতা অবোধগম্য নয় যে, নবনির্বাচিত সরকার সাংবিধানিক রীতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকেনি। অবিশ্বস্ততা ও শঠতার আশ্রয় নিয়েছে। রিজভী তাঁর নিবন্ধে ‘অপ্রয়োজনীয় সংশয়, নৈরাজ্য ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে সরকারকে জনগণের জরুরি বিষয়গুলিতে কাজ করা থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে’ সরাতে সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। শুধু বলব, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.