লাঞ্ছিত মানবতা, রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ

৫ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি হয়ে গেল, তা নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা বিতর্ক চলছে। সরকারি দল একে ফাঁকা মাঠে গোল হিসেবে দেখছে এবং সরকার গঠনের কাজটিও শেষ করেছে। বিরোধী দল পুরো নির্বাচন-প্রক্রিয়াটিকেই অবৈধ ঘোষণা করে গতকাল পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি জারি রেখেছে। বিদেশি বন্ধুরা যত দ্রুত সম্ভব সবার অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের জন্য দুই পক্ষকে তাগিদ দিয়েছে। নাগরিক সমাজের যে অংশ নির্বাচন স্থগিত রাখার কথা বলেছিল, তারা হতাশ এবং যে অংশ সংবিধান রক্ষার ওপর জোর দিয়েছিল, তারা উল্লসিত। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদের সদস্যরা শপথ নিতে পারেন কি না, সে নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত। কিন্তু এই আশা-হতাশা এবং কূটতর্কের মধ্যে আরেকটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটল, বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ; তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, ভাঙচুর, লুটপাট করা হলো। এসবের চেয়েও ন্যক্কারজনক হলো নারীদের ওপর নির্যাতন। অভয়নগরে ঋষিপাড়ায় দুই গৃহবধূকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানালেন, তাঁর বন্ধুর ১২ বছরের মেয়েও ধর্ষিত হয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে। কেবল সনাতন ধর্মাবলম্বীরাই যে এসব আক্রমণের শিকার হচ্ছে তা-ই নয়, আক্রান্ত হচ্ছে আদিবাসীরাও। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, প্রতিটি নির্বাচনের পরে এবং আগে, প্রতিটি জাতীয় দুর্যোগে সংখ্যালঘুরাই বেশি নির্যাতনের শিকার হয়। কেন হয়, তা নিয়ে তর্কের শেষ নেই। রাজনৈতিক দলের নেতারা একে অপরকে দায়ী করেন। এনজিওগুলো এসব নির্যাতনকে পুঁজি করে নতুন প্রকল্প খোলে। নাগরিক সমাজ বুদ্ধিবৃত্তিক তর্কে মাতে।
সমাজতাত্ত্বিকেরা গবেষণার নতুন বিষয় পেয়ে যান। কিন্তু ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা যে প্রতিবার নির্যাতন ও নৃশংসতার শিকার হয়, তা থেকে তাদের উদ্ধারের কার্যকর উদ্যোগ নেই সরকার কিংবা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, রাষ্ট্র দুর্বৃত্তদের লালন করছে, সমাজ তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। না হলে গুটি কয়েক দানব কী করে মানবের ও মানবতার ওপর এ ধরনের নিষ্ঠুরতা চালানোর সাহস পায়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট তো শুধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা দেননি, ভোট দিয়েছেন সংখ্যাগুরুরাও। কিন্তু আক্রান্ত হলেন বেছে বেছে সংখ্যালঘুরাই। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের দুটি প্রধান কারণ ভোট ও জমি। জমি দখলের প্রক্রিয়া সব আমলেই চলে। যেখানে যার জোর আছে, সেখানে সে দখল করে নেয়। কিন্তু এবারের কারণ প্রধানত ভোট ও ভোটের রাজনীতি। দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা হিন্দু ও আদিবাসী পাড়ায় গিয়ে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, তাঁরা যেন ভোট দিতে না যান। কিন্তু তাঁদের সেই নিষেধাজ্ঞা না শুনে ভোট দেওয়ার কারণেই তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি ও জামায়াতকে ভোট না দেওয়ার কারণে সংখ্যালঘুরা মার খেয়েছিলেন। এবারও মার খেলেন তাঁদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ভোট দেওয়ার কারণে। নাগরিক সমাজের কেউ কেউ যুক্তি দেখাবেন, ভোটকেন্দ্রে না গেলে তো হামলার ঘটনা ঘটত না। এঁরাই অবার সভা-সেমিনারে ভোটাধিকার নিয়ে বুলন্দ আওয়াজ তোলেন। সভ্য সমাজে এভাবে ভোটকেন্দ্রে কাউকে যেতে নিষেধ করলে তাঁকে সোজাসুজি কারাগারে যেতে হতো। আমাদের সমাজটি প্রাগৈতিহাসিক, আর রাষ্ট্রটি দুর্বৃত্তের রক্ষক বলেই সবাই সবকিছু বলে ও করে পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা সুহূদহীন, নিরাপত্তাহীন। এক পক্ষ তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে,
আরেক পক্ষ সেই ভোটব্যাংক ভেঙে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ভোটব্যাংক ভেঙে দেওয়ার মোক্ষম উপায় ভয়ভীতি দেখিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর যখন সংখ্যালঘুদের ওপর যে নৃশংসতা চালানো হয়, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী সেটিকে রাজনৈতিক ঘটনা বলে সাফাই গাইতে সচেষ্ট ছিলেন। আর সে সময়ে যাঁরা বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াত আমল সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়, এখন তাঁরা কী বলবেন? বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর কর্মীর জড়িত থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এর জবাব কী? নির্বাচন শেষ হলেও নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে যে লড়াই, তা শিগগিরই শেষ হবে বলে মনে হয় না। আর এই লড়াই যত তীব্র হবে, ততই সংখ্যালঘুরা আরও বেশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এবং জাতিসংঘ বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনে হতাশা ব্যক্ত করে দ্রুত নতুন নির্বাচনের লক্ষ্যে উভয় পক্ষকে সংলাপে বসার আহ্বান জানালেও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে রুটিনমাফিক উদ্বেগ প্রকাশের বেশি কিছুই তারা করছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনোত্তর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী আছেন। কিন্তু তার আগে তাঁকে জামায়াতে ইসলামীকে ছাড়তে হবে, সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। জবাবে খালেদা জিয়া বলেছেন, তাঁর দল কাকে ছাড়বে না ছাড়বে, সেটি অন্য কেউ নির্দেশ করতে পারে না। বিএনপির নেতা তারেক রহমান লন্ডন থেকে দেওয়া বিবৃতিতে সরকারকে অবৈধ আখ্যায়িত করে আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এ অবস্থায় শিগগিরই সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নেই বলেই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন।
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজ। গণজাগরণ মঞ্চ যশোরে রোডমার্চ করেছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে। কিন্তু যারা দুর্বৃত্ত, যারা সাম্প্রদায়িকতা লালনকারী অপশক্তি, তাদের কাছে এই শান্তির ললিত বাণী কোনো কাজে দেবে না। তাদের জন্য চাই যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্র সেই কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত আছে কি? ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর বেশ কটি হামলা হয়। বর্তমান আমলেও একই ঘটনা ঘটে চলেছে। কিন্তু দায়ী ব্যক্তিরা কেউ শাস্তি পায়নি। ২০০১ সালের ঘটনায় বর্তমান সরকার ২৭টি মামলা করলেও কারও বিচার হয়নি। এই শাস্তিহীনতাই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের সাহস জোগাচ্ছে। যেকোনো গণতান্ত্রিক সমাজের জন্যই এটি লজ্জাজনক। এর আগে রামু, নোয়াখালী ও সাতক্ষীরায় যে ভয়ংকর ঘটনা ঘটল, সরকার বলল সব বিরোধী দলের কাজ। কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি হলো না কেন?
এই যে শত শত বছর ধরে পাশাপাশি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বাস করে আসছে, তাদের মধ্যে যে প্রীতি ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, দুর্বৃত্তরা সেটি ছিন্ন করে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির হাত ফুল চেনে না, রক্ত চেনে। ওদের চোখে ভালোবাসার দ্যুতি নেই, আছে জিঘাংসার আগুন। সেই আগুনে পুড়ছে দেশ। এখনই সময় রুখে দাঁড়াবার। এই বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে যেভাবে রাষ্ট্রের দাঁড়ানোর কথা, সেভাবে তা দাঁড়ায়নি। সরকার নিরাপত্তা দেয়নি। ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনে জয়ে এতটাই বেসামাল যে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার কথা ভাবার ফুরসত পাননি। অভয়নগরের সংখ্যালঘু পাড়ার মানুষগুলো যখন তাঁদের বিপদের কথা টেলিফোনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের জানান, কেউ এগিয়ে আসেননি। তাঁরা এসেছেন দুর্বৃত্তদের হাতে বাড়িঘর লুট ও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার পর। পাকিস্তান আমল থেকে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে এসেছি। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয় নব্বই সালে। এরশাদের উসকানিতে। এরপর খালেদা জিয়ার আমলে ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর। সংখ্যালঘুদের ওপর সবচেয়ে বড় দুর্যোগ নামে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর। সেবার বিএনপি-জামায়াত জোট জয়ী হয়েছিল। তাদের রাগ ছিল সংখ্যালঘুরা বিএনপি-জামায়াতকে ভোট দেননি বলে। এবারের রাগ তাদের কথা অগ্রাহ্য করে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছিলেন বলে। এভাবে ভোটের জন্য, জমির জন্য আর কত মার খাবে সংখ্যালঘুরা?
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের ঐতিহ্য হারাচ্ছে বলে যারপরনাই উদ্বেগ প্রকাশ করে থাকেন। আমরাও মনে করি, বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে নির্বাচনও গ্রহণযোগ্যতা পায় না। কিন্তু এই নাগরিক সমাজেরই একাংশ যখন বহুদলীয় গণতন্ত্রের ব্যাপারে সোচ্চার, কিন্তু বহুধর্মীয় সমাজের ব্যাপারে নীরব থাকে, তখন তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্বই প্রকাশ পায়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর কালীগঞ্জের এক আক্রান্ত গ্রামে গেলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বৃদ্ধ নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাবা, ভোটার তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দিয়ে দাও। তাহলে আমরা পৈতৃক ভিটেবাড়িতে থাকতে পারব। না হলে প্রতিটি নির্বাচনের পর আমাদের এভাবে হামলার শিকার হতে হবে।’ ১২ বছর পর একই আহাজারি শোনা গেল। যারা অভয়নগরের, দিনাজপুরের, সাতক্ষীরার সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, তারা এই সমাজ ও রাষ্ট্রেরই নাগরিক। তারা অচেনা নয়। আমাদের সমাজেরই লোক। আমরা যদি তাদের নিবৃত্ত করতে না পারি, সরকার যদি শাস্তি দিতে না পারে, তাহলে দুর্বৃত্তদের রাজত্বই কায়েম হবে, যা কখনোই কাম্য নয়। তাই আসুন, সবাই মিলে এই দুর্বৃত্তদের মোকাবিলা করি। সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।



সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.