তুমি করো ব্যবসা, আমি দেখি প্রাণ

ওদের যা ব্যবসা, আমাদের তা অক্সিজেন
আজব সুড়ঙ্গপদ্ধতি! ব্যাংকের তলায় সুড়ঙ্গ, আর জাতীয় ক্রিকেট বোর্ডের ভেতরে বিরাট ফোকর। (দুর্বৃত্তের) মুক্তি কোন পথে? উত্তর হবে সুড়ঙ্গপথে। সুড়ঙ্গপথে কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংক লুট হয়, আর ক্রিকেট বোর্ডে বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্বার্থ চাপা দেওয়ার লোকেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়। নাকি দেশের প্রতি দরদ আর আনুগত্য কম থাকাই দেশবাসীর প্রাণের তার ছেঁড়ার দায়িত্ব পাওয়ার বড় যোগ্যতা? অর্থহানির দায়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপক ও কর্মকর্তাদের ১২ জনকে এ বাবদ আটক করা হয়েছে। সুড়ঙ্গ দেখা যায়, কিন্তু ব্ল্যাকহোল দেখা যায় না। ক্রিকেটে মর্যাদাহানির পক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা আর তাঁদের ব্ল্যাকহোল অধরা আর অদেখাই থেকে যাবে! ভারতের ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআইয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিরঞ্জন শাহ বলেছেন, ‘বেসবলের বেলায় যেমন আমেরিকা ভাবে না আর কোনো দেশ খেলল কি খেলল না।’ ২০১৫ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তারা ঠিক করেছে, সব খেলা হবে ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে। অর্থাৎ ভারতও কাউকে নিয়ে চিন্তিত নয়। বেশ, গান্ধীর ভারত তাহলে আধিপত্যবাদী অহংকারী আমেরিকার পথ ধরেছে! অথচ এই ভারতে ক্রিকেট আর জাতীয়তাবাদ হাত ধরাধরি করে এগিয়েছিল।
ভারতীয় ক্রিকেটের জন্ম আর ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত সালের হিসাবে খুবই কাছাকাছি। আর তা শুরু হয়েছিল এই বাংলা থেকেই। ১৮৮০-এর দশকে পূর্ববাংলার তরুণেরা প্রথম পেশাদার ক্রিকেট দল গঠন করে ইংরেজ টিমকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হারিয়েছিল। আমির খানের লগন ছবির ঘটনা বাংলাদেশের মাটির এক ভুলে যাওয়া গল্প (ইফতেখার মাহমুদ, প্রথম আলো ১৮-১-২০১৩)। বাংলা সিনেমার নায়কের মাথায় যেমন বাড়ি না পড়লে হারানো স্মৃতি মনে পড়ে না, তেমনি বাড়ি খেয়েই আমাদেরও মনে পড়েছে: ও হ্যাঁ, তাই তো, আমাদেরই এক মফস্বলী যুবক ছিলেন ভারতবর্ষীয় ক্রিকেটের জনক! উপমহাদেশে ক্রিকেট ও জাতীয়তাবাদের রাখিবন্ধন ঘটিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের জমিদারপুত্র সারদারঞ্জন রায়চৌধুরী—সত্যজিৎ রায়ের প্রপিতামহ, সুকুমার রায়ের বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় ভাই। সিপাহি বিদ্রোহ বা প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতাযুদ্ধের পরাজয়ের অন্ধকারে ভারতবাসী মুষড়ে পড়েছিল। গায়ের বল তো চূর্ণই, মনের বলও তলানিতে। সে সময় সারদারঞ্জন কিশোরগঞ্জে ক্রিকেট খেলছেন। সেখান থেকে পড়তে এসে ভাইদের নিয়ে বানিয়ে ফেললেন ঢাকা কলেজকেন্দ্রিক স্বদেশি পেশাদার ক্রিকেট দল ঢাকা ক্রিকেট ক্লাব। তাঁর দল বেশ কয়েকবার ব্রিটিশদের হারিয়েছিল। ১৮৫৭-এর পর প্রথম খেলার মাঠেই নতুন বাঙালি মধ্যবিত্ত জাতীয় ঐক্য অনুভব করতে পেরেছিল। ১৯২০-এর দশকে মুম্বাই শহরের পারসিরা এর কিছু পরে ক্রিকেটের প্রচলন ঘটায়। কিন্তু সেটা ছিল সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে; এক ধর্মের লোক অন্য ধর্মের বিরুদ্ধে খেলত। সারদার দল ছিল অসাম্প্রদায়িক।
তাদের একটাই দোষ, তারা পশ্চিমবঙ্গের ঘটি দলকে হারিয়ে পূর্ববঙ্গীয় বাঙ্গাল পরিচয়ের ডাঁট দেখিয়ে ছাড়ত। আরও পরে, এম এ আজিজের তৈরি করা ফুটবল দল কলকাতায় একই রকম ব্রিটিশবিরোধী জোশ চাঙা করেছিল। খেলা ও জাতীয়তাবাদের যোগাযোগ আবার দেখা গেছে ঢাকার শাহবাগে, তিন মাতব্বরের চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে। আশীষ নন্দী লিখেছিলেন, ক্রিকেট হলো ব্রিটিশদের দ্বারা দুর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কৃত ভারতীয় খেলা। বাংলাদেশের ক্রিকেটপাগল মানুষ কথাটার মানে বদলে দিয়েছে। আমরা এখন বলতে পারি, ইতিহাসের খেয়ালে হারিয়ে ফেলা বাংলাদেশি খেলা হলো ক্রিকেট, যার মালিকানা চলে গেছে অন্যদের হাতে। বেহাত হওয়া সেই মালিকানার দলিল এখন লিখেছে ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড। আইসিসির বৈঠকে তাদের প্রস্তাব পাস হলে বাংলাদেশের প্রতারিত বোধ করা উচিত। ভারত এখন নিয়েছে বর্ণবাদী অস্ট্রেলিয়া আর উপনিবেশবাদী ইংল্যান্ডের ভূমিকা। ইংল্যান্ড আর তার দুই সাবেক উপনিবেশ মিলে বিশ্ব ক্রিকেটের মালিক হতে চাইছে। এই তিন দেশের ক্রিকেট বোর্ড মিলে যে প্রস্তাব তৈরি করেছে, তাতে কেবল ক্রিকেটের আয়েই তাদের একচেটিয়াত্ব আসবে না, কে টেস্ট খেলবে, কে কার সঙ্গে খেলতে পারবে বা পারবে না, কীভাবে বিশ্ব ক্রিকেট প্রশাসন চলবে; সবকিছুই চলবে তাদের মর্জিমাফিক। ফলাফল, বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুকিয়ে মরা। এর খেসারত ভারতকেও দিতে হবে। ভারতের ক্রিকেট থেকে খেলা উঠে যাবে, বাড়বে আইপিএল,
টি-টোয়েন্টির টাকার কারবার। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আদলে ক্রিকেটের তিন পরাশক্তির হাতে ভেটো ক্ষমতা আনতে চাইছে যারা, খেলার মধ্যে রাজনীতি আনার দায়ও তাদের। জাতীয়তাবাদী ভারত যে আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে চাইছে, ক্রিকেটের আয়নায় তা স্পষ্টই ধরা পড়ে। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তিন ভিত্তি বলিউডের ছবি, ক্রিকেট আর রাজনৈতিক মতাদর্শ। ভারতীয় ক্রিকেট টিমের বিজ্ঞাপনগুলোর ভাষা ও প্রতীক দারুণ আগ্রাসী। একসময় ইংল্যান্ড আইসিসিতে মাতব্বরি করত। ভারতসহ এশীয় দেশগুলো তাদের চাপের মুখে ‘সমান’ করে ছেড়েছিল। গত শতকের শুরুর দিকে ইংল্যান্ডের অভিজাতদের দুঃখ ছিল, তাদের কেন গরিবদের সঙ্গে খেলতে হয়! ভারতের ক্রিকেট বোর্ডেরও তেমন ঘোড়ারোগে পেয়েছে। তারাও টেস্ট ম্যাচে বর্ণবাদী নিয়ম চাইছে। বিশ্ব উন্নয়ন সূচকে নামিবিয়ার চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও ভারতের ক্রিকেট বোর্ড অঢেল সম্পদের মালিক। সুতরাং বাংলাদেশ যতই উন্নয়নসূচকে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকুক, ক্রিকেটের বিচারে বাংলাদেশ গরিব। তিন মাতব্বরের বিপক্ষে বাংলাদেশি তরুণ-তরুণীদের প্রতিবাদ তাই ধনীর আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গরিবের প্রতিবাদ। বাংলাদেশিদের আশঙ্কাকে নিছক স্ট্যাটাস হারানোর আতঙ্ক বলা যাবে না। কোনো দেশ যখন রাজনৈতিক কারণে ভীত ও দিশাহীন বোধ করে, তখন তারা তাদের বাস্তবের বাইরের কোনো প্রতীকের ওপর ভর করে আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য ফিরে পেতে চায়। ক্রিকেট এখন সে রকমই এক জাতীয় প্রতীক।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোর বিচ্ছিন্ন মানসিকতাকে এক করে আত্মমর্যাদাবান করে তুলেছিল তাদের ক্রিকেটীয় আত্মবিশ্বাস। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়েরা প্রেরণা হয়েউঠেছিল। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল তাদের ক্রিকেট দল। বাংলাদেশেরও এখন এ রকম ঐক্যসূত্রের দরকার আছে। দক্ষিণ আমেরিকার বিপ্লবী লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো ফুটবলের মধ্যে সেই মহাদেশের মানুষদের সংগ্রামের মহাকাব্য দেখতে পান বলেই লেখেন ফুটবল আন্ডার দা সানের মতো অসামান্য বই। ত্রিনিদাদের বিপ্লবী তাত্ত্বিক সিএলআর জেমস বিয়ন্ড আ বাউন্ডারির মতো অবিস্মরণীয় বই লিখে জানাতে চান ক্রিকেট শিল্প, ক্রিকেট মহাকাব্য। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, তুমি যদি কেবল ক্রিকেটই জানো, তাহলে কীভাবে ক্রিকেটকে জানবে? ক্রিকেটের প্রাণ থাকে বাউন্ডারির বাইরে। আজকের বিপর্যস্ত বাংলাদেশে ক্রিকেট যে সব মত ও পথের মানুষকে এক জায়গায় এনেছে, তা থেকেই প্রমাণ হয় ঐক্যের এই জায়গাটি কত স্পর্শকাতর। তিন বর্ণবাদীর বিরুদ্ধে সাত সাধারণ ক্রিকেট বোর্ডের ঐক্য তাই বাংলাদেশের খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন একে বাণিজ্যের গ্রাস থেকে বের করা। স্বাধীন, দেশপ্রেমিক, ক্রিকেটদরদি কর্তৃপক্ষ ছাড়া সেটা সম্ভব নয়। বৃক্ষ কারও কাছে কাঠ, কারও কাছে প্রাণ। খেলা কারও কাছে ব্যবসা, কারও কাছে সম্মান। বাউন্ডারি প্রসারিত করুন, বাংলাদেশের সম্মান রক্ষা করুন।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.