সিইসি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আবেদন- প্লিজ, ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন বন্ধ করুন by মাহফুজ আনাম

কেন ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত নয়? কারণ তা আমাদের সংবিধানে বর্ণিত নির্বাচন ধারণার পরিপন্থি, কারণ তা এখনও পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের যে আস্থা আছে তা ধ্বংস করে দেবে। কারণ, এ নির্বাচন সামনে দিনগুলোতে আরও মৃত্যু ও সহিংসতার কারণ হবে,
তা অর্থনীতিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে, এরই মধ্যে এ নির্বাচনের কারণে অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তার বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে, বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপিত করবে। আরও সহিসংতা নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, গার্মেন্টের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে। চলমান অস্থিরতা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে এবং আইনশৃঙ্খলা আরও ভেঙে পড়বে।

আমরা এখন যেসব সঙ্কট মোকাবিলা করছি ৫ই জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন কি তার কোনটির সমাধান করবে? এ নির্বাচন কি হরতাল-অবরোধ, রাজপথের সহিসংতা বন্ধ করবে? তা কি দারিদ্র কমাবে? এ নির্বাচন কি হত্যা এবং অগ্নিসংযোগ বন্ধ করবে? আমরা সবাই জানি তা বন্ধ হবে না। সুতরাং, কেন আমরা এমন কিছু করবো যা কোন সঙ্কটরেই সুরাহা করবে না। এবং তা শুধু জনগণের দুর্ভোগই বাড়াবে। অন্য অনেকের চেয়ে শেখ হাসিনা ভালো জানেন, যখন সামাজিক অস্থিরতা দেখা দেবে তখন জনগণ সরকারকেই দায়ী করবে। সুতরাং, অস্থিরতা অব্যাহত থাকলেও তিনি আরও কিছু হারাবেন। তিনি জনসাধারণের এ ধরনের আচরণ থেকে লাভবান হয়েছিলেন যখন তিনি বিরোধী দলে ছিলেন।
নির্বাচন বিষয়টি আসলে কি? এটি শুধু আনুষ্ঠানিকতা, যা প্রতি পাঁচ বছর পরপর অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ভোটাররা অংশ নেন অথবা না নেন? এটা কি শুধু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। ভোটারদের অংশ নেয়া না নেয়ার ব্যাপারে কোন দায়িত্ব নেই। এটা কি ভোটারদের সঙ্গে খেলা শুধু লিগ্যাল গেইম, যাতে এমনকি ভোটারদের ভোটদানের সুযোগ না দিয়েও কেউ নিজেদের এমপি হিসেবে নির্বাচিত করতে পারে? যদি এগুলো সত্য হয় তাহলে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে।


অন্যদিকে, নির্বাচন যদি জনগণের অভিপ্রায়ের প্রকাশ হয়, যদি তা একটি প্রক্রিয়া হয় যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রকাশ ঘটান, যদি তা একটি ইভেন্ট হয় যার মাধ্যমে জনগণ নতুন সরকার পছন্দ করে, যদি তা একটি প্রক্রিয়া হয় যার মাধ্যমে জনগণ কিছু পলিসি অনুমোদন করেন যা তাদের নতুন সরকারের দ্বারা তারা কার্যকর দেখতে চান, যদি একটি প্রক্রিয়া হয় যার মাধ্যমে জনগণ যারা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা যারা দুর্নীতিবাজ তাদের শাস্তি দিয়ে থাকেন। তাহলে কি ৫ই জানুয়ারি একটি হাস্যকর তামাশা হতে চলছে যা গণতন্ত্র থেকে একেবারেই দূরবর্তী। এটা অর্থগত, উদ্দেশ্যগত এবং চেতনাগত দিক থেকে সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবচেয়ে বড় যুক্তি দেখান, বাংলাদেশ অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হতে পারে না। আমরা যদি প্রধানমন্ত্রীর এ যুক্তি মেনে নিই তাহলে স্বাভাবিকভাবেই নতুন সংসদ এবং সরকার গঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।
আমাদের সংবিধান অনুযায়ী নতুন সংসদ ও সরকার গঠিত হয় জনগণের রায়ের মাধ্যমে, প্রাপ্ত বয়স্করা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এ রায় দিয়ে থাকেন। এটাই আমাদের সংবিধানের মূল চেতনা।
অন্যদিকে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোন ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হবেনÑ তা কখনও আমাদের সংবিধানের চেতনা নয়। এরই মধ্যে ৩০০ আসনের বিপরীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেছেন। বাকি ১৪৬ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে নামমাত্র। শেখ হাসিনা ১৫তম সংশোধনী আনার ব্যাপারে বারবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কথা বলে থাকেন। ওই রায়েই প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। একই রায়ে বিচারপতি এস কে সিনহা বলেন, জনগণের নির্বাচিত ছাড়া অন্য যে কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থা সংবিধান ঘৃণা করে। বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা বলেন, গণতন্ত্র এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একে অপরের পরিপূরক। গণতন্ত্রের মত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনও গণতন্ত্রের অন্যতম মৌলিক কাঠামো। সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্রের প্র্যাকটিসের কোন সুযোগ নেই। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে সংসদের কোন আইনগন ভিত্তি থাকবে না। এ ধরনের সংসদ সার্বভৌমও নয় এবং এ ধরনের সংসদে জনগণের প্রতিনিধিত্বও নেই। বিচারপতি মিঞা আরও লিখেছেন, সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে উল্লিখিত নির্বাচন বলতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকেই বুঝানো হয়েছে। যদি প্রার্থীরা শক্তি, অর্থ এবং সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করে নির্বাচিত হন, তবে ওইসব সংসদ সদস্যকে জনগণের প্রতিনিধি বলা যায় না এবং সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদের আলোকে এ ধরনের সংসদকে সংসদ বলা যায় না। এ ধরনের সংসদ আমাদের পূর্বপুরুষ এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আশা-আকাক্সক্ষারও পরিপন্থি।
সুতরাং, শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নিজেদের জিজ্ঞেস করা উচিত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে কি ধরনের সরকার এবং সংসদ প্রতিষ্ঠা হবে। কত সংখ্যক মানুষের সমর্থন তাদের প্রতি রয়েছে। এর বৈধতা কি? জনগণের কি ধরনের প্রতিনিধিত্ব এতে রয়েছে। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের মাধ্যমে খুবই সামান্য কিছু অর্জন করতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ যাই বলুক না কেন ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং ১৪৬ আসনে নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী সংসদ সদস্যদের জন্য গঠিত সংসদ কখনওই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের মতো বৈধতা দাবি করতে পারে না। কথিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার শুধু তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা আর খ্যাতি হারাতে পারে। দশম সংসদ নির্বাচনের পর দ্রুত একাদশ সংসদ নির্বাচনের ফর্মুলা শুধুমাত্র সময়ের অপচয় এবং তা মানুষের দুর্ভোগ ও অর্থনীতির ক্ষতির মাত্রাই শুধু বাড়াবে। আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প হচ্ছে সত্যিকার অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা। এটা দেশ এবং দেশের বাইরে আওয়ামী লীগের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে।
সুতরাং, আমরা দু’টি প্রধান দলকে গণতন্ত্র রক্ষায়, রক্তপাত ও অর্থনীতির ধবংস এড়াতে নিম্নের প্রস্তাবগুলো দিচ্ছি:
১. নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীন দলের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন স্থগিত করা উচিত। সত্য হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার এ নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না। ১৫৪ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকাই দশম সংসদের বিশ্বাসযোগ্যতা ধবংস করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। নির্বাচন কমিশনের এটা ভাবনায় নেয়া প্রয়োজন যা হতে চলেছে তা বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনগণের সঙ্গে গণতন্ত্রের নামে প্রতারণা।
২. শেখ হাসিনার উচিত নবম সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা খুঁজে বের করা। এটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। এটা প্রধানমন্ত্রীর সর্বদলীয় সরকার ধারণার মধ্যেই হতে পারে। একমাত্র কঠিন বিষয়টি হলো কে হবেন ওই সরকারের প্রধান? আমরা মনে করি প্রেসিডেন্ট জাতিকে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারেন যদি সবাই তাকে অনুরোধ করেন। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন সর্বদলীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় যেমন- স্বরাষ্ট্র ও সংস্থাপনও প্রেসিডেন্টের কাছে থাকতে পারে। নবম সংসদ পরবর্তী নির্বাচন ও সরকার গঠনের জন্য ৯০ দিন সময় বেঁধে দিতে পারে।
৩. যদি নবম সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা হয় তবে বিএনপির উচিত হবে কোন ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই সংসদে যোগ দেয়া এবং সবধরনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করা। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সমঝোতা প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়া উচিত।
৪. জামায়াতের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি হাইকোর্টের রায় পূরণের ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ, গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি রক্ষায় রাজনৈতিক সমঝোতাই সবচেয়ে জরুরি। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে আমরা বলতে চাই, আমাদের ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার কোন অধিকার আপনাদের নেই। বিরোধী দলকে আমরা বলতে চাই, আমাদের হত্যা, অগ্নিদগ্ধ এবং আমাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করার কোন অধিকার আপনাদের নেই। আমাদের নিজেদের আমরা বলতে চাই, আমাদের রাজনীতিবিদরা যখন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছেন এবং দেশকে অজানা গন্তব্যে নিয়ে চলছেন তখন আমরা সাইড লাইনে বসে থাকতে পারি না। আপনার উদ্বেগ শোনা ও বিবেচনায় নেয়ার জন্য আপনার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করুন।

 (ডেইলি স্টারে শুক্রবার প্রকাশিত পত্রিকাটির সম্পাদক মাহফুজ আনামের লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)

No comments

Powered by Blogger.