বাংলাদেশের নির্বাচন ও ভারতের দায় by ড. শরীফ মজুমদার

যুক্তরাষ্ট্রের আশপাশে কিছু দেশ আছে, যেখানকার সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতা যুক্তরাষ্ট্রকে ভাবিয়ে তোলে। যদিও তাদের ভাবনা আসে কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে। যেমন- যদি সেখানকার সরকার ব্যর্থ হয়; তাদের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা না করে এবং তাতে যদি সমগ্র উত্তর আমেরিকার জীবনমান নিয়ে বিশ্বের অন্য প্রান্তের জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির নেতিবাচক পরিবর্তন দেখা দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে। তারপরও ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সে অঞ্চলে অনেক দেশ আছে যেখানে প্রায়ই এমন সরকার গঠিত হয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের নয়। কিন্তু তাতে করে যুক্তরাষ্ট্র সেসব সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় না বা পরে সেসব সরকার নিয়ে বিদ্রুপাত্মক প্রচারণাও খুব একটা চালায় না। এর কারণ কিছুটা হলেও এই যে, তারা গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাস করে। অবশ্যই তারা চায় তাদের পছন্দের লোক ক্ষমতায় আসুক; কিন্তু সে চাওয়া বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিকভাবে দুর্বল ও চরম দুর্নীতিপরায়ণ দেশগুলোতে যতটা সহজে প্রয়োগ করা যায়, দুর্নীতিপরায়ণ নয় এবং গণতান্ত্রিকভাবে মজবুত দেশগুলোতে ততটা সহজে প্রয়োগ করার সুযোগ থাকে না। বস্তুত, তথাকথিত ‘ৎবমরসব পযধহমব’ নামের যে ডকট্রিন আজ কিছু স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সেসব দেশ গণতান্ত্রিকভাবে দুর্বল ও চরম দুর্নীতিপরায়ণ বলেই সম্ভব হচ্ছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের চিত্রটা একটু ভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রের পাশে বিশাল দেশ কানাডা হলেও রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের দিক থেকে বিশ্বে কানাডার উপস্থিতি এতটা প্রকট নয়, যতটা প্রকট ভারতের পাশের দেশ চীনের উপস্থিতি। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা দুটিই গণতান্ত্রিক দেশ; কিন্তু ভারত ও চীনের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় এবং অগণতান্ত্রিক দেশ চীন যেভাবে ক্রমান্বয়ে তার প্রভাববলয় প্রসারিত করে চলছে তাতে গণতন্ত্র নামের ‘বড়িটি’ এ উপমহাদেশে আর কতদিন সর্বরোগ নিরাময়ের ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে উল্লেখ করা যাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। গণতন্ত্র ‘বড়ি’ যদি এ উপমহাদেশে কার্যকারিতা হারায়, তাহলে তা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলবে ভারতকেই। কারণ ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা যতটা তৎপর, চীনে বিচ্ছিন্নবাদীদের তৎপরতা ততটা প্রকট নয়। তাছাড়া চীন যেভাবে ভিন্ন গোত্র, ভিন্ন কালচার এবং ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, ভারত সে ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতীয় উপমহাদেশে সত্যিকারের গণতন্ত্রের সুফল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের দায় উত্তর আমেরিকার দেশগুলোয় গণতন্ত্রের সুফল নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের দায়ের চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু বাস্তবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ভারত সে দায় মেটাতে অনেকটাই অক্ষম।
উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে ভারতীয় নীতির কথাই ধরা যাক। যে দেশটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছিল, পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল সর্বাÍক সহমর্মিতা নিয়ে, সে দেশটি আজ ৪৩ বছর পরও বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে সত্যিকারের বন্ধুপ্রতিম হিসেবে জায়গা করে নিতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার মূলে রয়েছে তাদের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের নীতি এবং অন্যসব রাজনৈতিক দলের প্রতি অসহিষ্ণুতা।
বিশ্বের সব উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেই সংখ্যালঘুরা সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করেই নিজেদের অধিকারের স্বীকৃতির ব্যাপারে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নেয়। ভারতীয় সংখ্যালঘুদের দিকে তাকালেও তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। গণতন্ত্রকে গণতন্ত্রের মূলনীতির ওপর শ্রদ্ধা রেখেই টিকে থাকতে হবে; গণতন্ত্রের স্থানীয় কোনো সংজ্ঞা নেই। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়, একমাত্র সত্যিকারের গণতন্ত্রই পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুর মধ্যকার মধ্যযুগীয় ব্যবধান কমিয়ে সাম্য ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশের সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে। এদেশের সংখ্যালঘুরা হয়তো বলবে, তারা বিশেষ রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের আস্থায় আনতে পারেন না। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান সংখ্যালঘুদের হাতেই। তাদেরই উদার মনে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে এবং আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার পর, নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার পর সেসব রাজনৈতিক দলের সংখ্যালঘু সংক্রান্ত নীতিতে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। এমনটিই পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখেছি। ইংল্যান্ডে যে লাখ লাখ মুসলমান আছে, তাদের একটি অংশ ‘টোরি’ এবং অপর অংশ ‘লেবার’ দলের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত হয়ে তাদের অধিকারের ব্যাপারে গণতান্ত্রিকভাবে লড়াই করে যাচ্ছে এবং সে লড়াই করার সুযোগ পাওয়ার আগে তাদের প্রমাণ করতে হয়েছে, তারা ‘টোরি’ বা ‘লেবার’ দলের নীতির প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল।
আজ বাংলাদেশের যে অবস্থা তাতে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বন্ধুপ্রতিম দেশ হলে ভারত সরকারের করণীয় হতো বাংলাদেশ সরকারকে বোঝানো যে, প্রধান বিরোধী দল ছাড়া একদলীয় নির্বাচন কখনোই প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক দেশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ভারতের কোনো ক্ষমতাসীন দল অবশ্যই কোনো সুস্থ বিরোধীদলীয় নেতাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে প্রধান বিরোধী দলবিহীন প্রহসনের নির্বাচন করার মতো ধৃষ্টতা দেখাবে না। বস্তুত, এগুলোই বন্ধুপ্রতিম দেশকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আস্থাহীন করে তোলে। প্রতিবেশী দেশের অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অসহিষ্ণু করে তোলে এবং তারই ফলস্বরূপ সরকার পরিবর্তনের সময় সংখ্যালঘু নিপীড়নের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার জন্ম হয়। সরকার ইচ্ছা করলেও তা আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, কারণ প্রতিবেশীদের কাছ থেকে তারা সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে কোনো সহায়তাই পায় না এবং সংখ্যালঘু নিপীড়নের মতো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা কেবল গণতন্ত্রহীনতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অবশ্য গণতন্ত্রহীনতাই সংখ্যালঘু নির্যাতনের একমাত্র কারণ নয়; কেননা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যেসব দৃষ্টান্ত রয়েছে তা বহু স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও দেখা যায় না। যা হোক, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নীতির প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেই তাদের সত্যিকারভাবে সম্পৃক্ত হতে হবে, যাতে করে অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যালঘু ইস্যুতে রাজনীতি করার সুযোগ এ দেশে ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসে। তাদের বুঝতে হবে, যখন ১০০ মূর্তি ভাঙার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রতিমন্ত্রীর ঠিক পেছনেই দেখা যায়, তখন সংখ্যালঘু ইস্যুতে রাজনীতি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকতে পারে। প্রতিমন্ত্রী অবশ্যই একান্ত পরীক্ষিত দলীয় লোক ছাড়া কাউকে অতটা নিকটে আসার মতো আস্থাভাজন মনে করবেন না। জাতি রামুর ঘটনার প্রকৃত দোষীদের এখনও চিহ্নিতই করতে পারেনি, বিচারের কথা দূরে থাক।
ভারতের অখণ্ডতার প্রতি বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের অখণ্ডতাবিরোধী কোনো কাজে কাউকে প্রশ্রয় না দেয়ার ভারতীয় দাবি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছেই সমভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিশ্চিত করার দায় অগ্রাহ্য করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ভারতের থাকতে পারে না।
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.