নেতাদের দায়িত্বহীন আচরণের সুযোগ নেই by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন

পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, ভারত রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কী? উত্তরে নেহেরু বলেছিলেন, বিশ্ব অর্থনীতি এখন নিয়ন্ত্রণ করছে ইংল্যান্ড, এটা অদূর ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন হয়ে ভারতের অনুকূলে আসার সম্ভাবনা আছে। বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয়, পণ্ডিত নেহেরুর কথাই সত্য হতে যাচ্ছে। এ দূরদর্শিতার কারণেই জওহরলাল নেহেরুকে পণ্ডিত বলা হতো। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী- এ প্রশ্ন আজ রাজনীতিকদের কাছে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের কাছে। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর বাংলাদেশের বর্তমান নেতৃত্বের আছে বলে মনে হয় না। ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে যে নৈতিকভিত্তিহীন, ক্ষতবিক্ষত ও নড়বড়ে সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে এবং দেশে যে সাংঘর্ষিক ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তাতে নিশ্চিত বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে বাংলাদেশ। ধ্বংসের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি, মুখ থুবড়ে পড়বে কৃষি, তৈরি পোশাক শিল্প ও জনশক্তি রফতানি কার্যক্রম।
বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছে কৃষি, জনশক্তি রফতানি ও তৈরি পোশাক শিল্প। এ তিনটি খাত দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এ খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে দেশের ভবিষ্যৎ বলতে কিছু থাকবে না। এরই মধ্যে এ তিন খাতের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আঘাত আসতে শুরু করেছে। জনশক্তি রফতানি প্রায় বন্ধ, তৈরি পোশাক শিল্পের অর্ডার চলে যাচ্ছে অন্যান্য দেশে; কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে বিলাপ করছে, উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃষকের শীতকালীন সবজি জমিতে পচে যাচ্ছে। এ সময়টায় কৃষকরা ঝুঁকি নিয়ে ঋণ করে বড় ধরনের বিনিয়োগ করে থাকে। এ বিনিয়োগ উঠে না এলে কৃষকের মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে। আগামীতে চাষাবাদ তাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাতে সার্বিক কৃষি উৎপাদনে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে খাদ্য সংকটে পড়তে পারে দেশ। কৃষি ও শিল্প খাতে বিপর্যয় ঘটলে বিপর্যয় ঘটবে গোটা সামাজিক ব্যবস্থায়। তখন একটি দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না। সহিংসতার আগুনে পুড়ে, ভবন ধসে, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে মানুষ কেবল মরছেই। এর মধ্যে রয়েছে নিরীহ মানুষ, অবহেলিত পোশাক শ্রমিক, পুলিশ-বিজিবি সদস্য। তাদের শ্রম-ঘামেই বাংলাদেশের মুদ্রার ভাণ্ডার স্ফীত হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন কোন পথে হাঁটছে এবং কী কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত লাশ হচ্ছে, তা কেউ জানে না। নিরীহ মানুষকে হত্যা করে আÍতৃপ্তি লাভ করা রাজনীতিকদের জন্য কোনোভাবেই শোভনীয় নয়। এটা কোনো সংকট সমাধানের পথও নয়।
বর্তমানে দেশে যে সংকট চলছে, তা গত তিন বছর আগেও বাংলাদেশে ছিল না। সমস্যাগুলো সুকৌশলে সৃষ্টি করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মধ্য দিয়ে মূলত সংকটের আবির্ভাব। সরকার একতরফা আদালতের ওপর দায় চাপিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মত দিয়েছেন উচ্চ আদালত। কিন্তু সরকার আদালতের মতকে কোনো গুরুত্ব দেয়নি; আর তাতেই সংকটের সূত্রপাত।
বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। তাদের প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা ভারত ও চীন থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানির পেছনে ব্যয় হয়। তাতে চাঙ্গা থাকে ভারত ও চীনের অর্থনীতি। তাছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে ব্যবসা করে কোটি কোটি ডলার তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং চলমান অস্থিরতায় বাংলাদেশে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ও বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা যেমন এ অঞ্চলকে সব দিক দিয়ে অশান্ত করবে, তেমনি এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বেই। তাই বাংলাদেশে যাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে এবং সব দলের অংশগ্রহণে একটি পক্ষপাতহীন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতার হাতবদল হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে বহির্বিশ্বের।
দেশের আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নিরীহ মানুষ হত্যার পেছনে বিপজ্জনক রাজনৈতিক খেলা কাজ করছে। আমরা মনে করি, এতে কোনো অশুভ শক্তির ইন্ধন রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট ও ধর্মের ওপর আঘাত নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক খেলা। এ খেলা খেলে সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা হচ্ছে। এ উত্তেজিত মানুষরা আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে, যা বাংলাদেশে আগে কখনও দেখা যায়নি। গত কয়েক মাসে প্রচুর সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই দেশের মানুষের মধ্যে এ আত্মঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে বোঝা যায়, সুকৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যাতে এ জাতি বিপন্ন জাতিতে পরিণত হয়। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, রাষ্ট্রের ভিত্তিও জনগণ। জনগণকে বিপন্ন করে রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না। এর ফলে একসময় এ রাষ্ট্রও বিপন্ন হবে। অযাচিত শক্তি প্রয়োগ করা সমস্যা সমাধানের পথ নয়। এভাবে সমস্যার সমাধান হয়েছে- পৃথিবীতে এমন নজিরও নেই। সমস্যা কেন সৃষ্টি হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে ক্ষমতাসীনরা দমন-পীড়ন ও হত্যার পথ বেছে নেয় এবং অযাচিত শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার শেষ চেষ্টা চালায়। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলও তাই করছে। তারা রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে প্রশাসনিক শক্তির ওপর ষোল আনা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটি তাদের জন্য ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে অশনি সংকেত হয়ে আবির্ভূত হবে। যারা দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের আচরণ দায়িত্বহীন হওয়ার সুযোগ নেই। দায়িত্বহীন নেতৃত্বের কাছে দেশের অগ্রগতি আশা করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা হতে পারে। প্রশ্ন হল, দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা নয় কেন? সংবিধান অনুযায়ী দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছার যথেষ্ট সময় ও সুযোগ হাতে আছে। বর্তমান সংসদ ভেঙে দিলে সংবিধান অনুযায়ী ৯০ দিন সময় হাতে পাওয়া যাবে। সেই লক্ষ্যে সিইসি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সমঝোতা হলে ২৪ জানুয়ারির পরও নির্বাচন হতে পারে। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করা যায় অনায়াসে। তাতে বর্তমান তফসিল কোনো বাধা হতে পারে না। এ তফসিলে যারা ভোটবিহীন নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের নাম এখনও গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়নি। সুতরাং সদিচ্ছা থাকলে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবলে বর্তমান তফসিল বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণা করা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কোনো বাধাই বাধা বলে গণ্য হতে পারে না।
দেশের সর্বনাশ করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মধ্যে যে কোনো প্রশান্তি নেই- এ চিন্তাটা রাজনীতিকদের থাকতে হবে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে। সুতরাং একাদশ নয়, সমঝোতায় পৌঁছতে হবে দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে। তাহলেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে, চলমান অস্থিরতা কেটে যাবে। রাজনীতিকরা আসীন হবেন মর্যাদার আসনে।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

No comments

Powered by Blogger.